বিএনপি বনাম জামায়াত-চরমোনাই-এনসিপি: ‘বাগ্যুদ্ধ’ কত দূর গড়াবে?

আসন্ন নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। একসময় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে একই প্ল্যাটফর্মে থাকা দলগুলো—বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই) ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। স্লোগান, বক্তব্য ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তাদের মধ্যে তীব্র বাগ্যুদ্ধ চলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বাকযুদ্ধের পেছনে রয়েছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ ও কৌশলগত বিরোধ। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত ও চরমোনাইয়ের মতো দলগুলো আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন চায়—এমন অবস্থানে রয়েছে।
এই মতপার্থক্যের সূত্র ধরেই ৯ জুলাই পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ভাষাগত আক্রমণ নতুন মাত্রা পায়। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির শীর্ষ নেতারা এই হত্যাকাণ্ডে বিএনপির যুবদলকে দায়ী করে বক্তব্য দেন, যা পরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
রাজনৈতিক সৌজন্য পেছনে ফেলে ব্যক্তিগত আক্রমণ
ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির ফয়জুল করীম ৯ জুলাই বলেন, "বিএনপির কী গুণ? ৯ মাসে দেড়শ খুন। চাঁদা তুলে পল্টনে, চলে যায় লন্ডনে।" এ ধরনের মন্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতারা চরমোনাই পীর ও জামায়াতের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক বক্তব্যে বলেন, “একজন পীর সাহেব যিনি একসময় বলেছিলেন জামায়াত যেখানে যাবে, সেখানে পচন ধরবে—এখন তিনি জামায়াতের কোলে বসেছেন।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিছিল-স্লোগানে তীব্র ভাষার ব্যবহার
লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মিছিল হয়, যেখানে বিএনপি ও তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে ‘যুবদল খুন করে, তারেক রহমান কী করে’ জাতীয় স্লোগান দেওয়া হয়। বিএনপির অভিযোগ, এই কর্মসূচির পেছনে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই রয়েছে।
চকরিয়ায় উত্তেজনা, এনসিপির মঞ্চ ভাঙচুর
২০ জুলাই কক্সবাজারের একটি এনসিপি পথসভায় দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে উদ্দেশ করে বলেন, “আগে শামীম ওসমান ছিল নারায়ণগঞ্জে, এখন কক্সবাজারে গডফাদার এসেছে শিলং থেকে।” এর জেরে বিএনপির কর্মীরা চকরিয়ায় এনসিপির সভামঞ্চ ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ ওঠে।
রাজনৈতিক বিভাজন ও নির্বাচন-চাপ
সম্প্রতি জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের ঢাকা সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ না জানানো রাজনৈতিক দূরত্বকে স্পষ্ট করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি সংস্কারবিরোধী—এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে বিএনপি, অন্যদিকে জামায়াত-চরমোনাই-এনসিপি—এমন বিভাজন স্পষ্ট। মতপার্থক্য ও সমঝোতার অভাব বিএনপিকে কিছুটা চাপে ফেলেছে।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা রাজনৈতিক শিষ্টাচার নষ্ট করছে এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।” তিনি রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানান।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে, পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র রুখতে রাজনৈতিক ঐক্য আরও দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন।