ড্রোন যুদ্ধ: ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নতুন অধ্যায়

প্রথমবারের মত ড্রোন যুদ্ধে জড়াল দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী— ভারত ও পাকিস্তান।
বৃহস্পতিবার রাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের তিনটি সামরিক স্থাপনায় ড্রোন হামলার অভিযোগ তোলে নয়া দিল্লি।
ইসলামাবাদ সে অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা দাবি করে বসে, তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের প্রায় ২৫টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। দিল্লি অবশ্য এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি।
বিশেষজ্ঞদের বরাতে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, ‘ইট মারলে পাটকেল ছোড়ার’ প্রবণতা কয়েক দশকের পুরনো বিরোধকে নতুন একটা স্তরে নিয়ে গেছে, যেটা খুবই ভয়াবহ।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউ. এস. নাভাল ওয়ার কলেজের’ অধ্যাপক জাহারা মতিসেক বলেন, “ইন্দো-পাক সংঘাত ড্রোন যুগে প্রবেশ করছে। ‘অদৃশ্য চোখ’ আর চালকবিহীন এসব হামলা অস্থিরতা বাড়াতেও পারে, কমাতেও পারে।
“ফলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা আকাশসামীয় যে পক্ষ ড্রোন যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নেবে, তারা শুধু নিজেদের যুদ্ধক্ষেত্রেই আটকে থাকবে না, বরং এ আকাশসীমা নতুন করে গড়ে তুলবে,” বিবিসিকে বলেন এ অধ্যাপক।
ভারতের বিমানবাহিনীর রাফাল জঙ্গিবিমান। ছবি: রয়টার্স
ইসলামাবাদ বলছে, বুধবার সকাল থেকে ভারতের বিমান ও বন্দুক হামলায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ৩৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৫৭ জনের বেশি।
অন্যদিকে ভারতের সামরিক বাহিনীর দাবি, পাকিস্তানের গোলায় তাদের বেসামরিক ১৬ ব্যক্তির প্রাণ গেছে।
ভারত বলছে, গত মাসে পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ‘প্রতিশোধ’ নিতে তারা মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘জঙ্গিদের আস্তানায়’ হামলা চালিয়েছে।
নয়া দিল্লির অভিযোগ, পেহেলগামের হামলায় পাকিস্তানের হাত রয়েছে, যদিও ইসলামাবাদ তা স্বীকার করেনি।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয়, করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিণ্ডিসহ বেশ কয়েকটি শহরে তারা ভারতের ২৫টি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
বিবিসি বলছে, ইসরায়েলের বানানো ‘হারোপ’ নামের এসব ড্রোন ধ্বংস করতে অস্ত্রের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত নানা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে।
ভারতের দাবি, তারা লাহোরের একটিসহ পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষার কয়েকটি রাডার ও কিছু ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে, যা ইসলামাবাদ স্বীকার করেনি।
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে লেজার-চালিত ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা, ড্রোন ও মানুষবিহীব আকাশযান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা সামরিক অভিযানের নিশানাকে আরও নির্ভুল ও কার্যকরী করছে।
এসব প্রযুক্তি বিমান হামলার সমন্বয়ে ভূমিকা রাখছে। প্রস্তুত থাকলে লেজার-চালিত প্রযুক্তি সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধে সহায়তা করতে পারে।
ড্রোনগুলো প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে বা তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে ব্যবহার করা যায়। এগুলো শত্রুপক্ষের আকাশে ঢুকে পড়ে তাদের রাডার চালু করাতে পারে, যেগুলোয় পরে অন্য ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো যায়।
অধ্যাপক মতিসেক বলেন, “ইউক্রেন ও রাশিয়া তাদের মধ্যকার যুদ্ধে এগুলোই করছে। দুই ধরনের ভূমিকা— নিশানা করা ও সক্রিয় করা— ড্রোনকে করে তুলেছে প্রতিপক্ষের বিমান ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার কার্যকর এক প্রযুক্তি। এখানে মানুষচালিত উড়োজাহাজ পাঠানোর মত ঝুঁকি নিতে হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ড্রোনের বহরে ইসরায়েলি প্রযুক্তির আধিপত্যই বেশি। যেমন আইএআই ও হেরন। হারপি ও হারোপ নামের ড্রোনও আছে, যেগুলো নিজেরাই ক্ষেপণাস্ত্রের মত কাজ করে। এসব ড্রোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করে তাতে আঘাতও হানতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহারে যে মনোযোগ বাড়ছে, হারোপ তার একটি উদাহরণ।
হেরন ড্রোনটিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘ভারতের চোখ’। এ ড্রোন দিয়ে যেকোনো সময় নজরদারি চালানোর পাশাপাশি যুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়।
‘আইএআই সার্চার এমকে-দুই’ ড্রোনটি তৈরি হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। এটি একটানা ১৮ ঘণ্টা আকাশে থাকতে পারে; যেতে পারে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। উড়তে পারে সাত হাজার মিটার (২৩,০০০ ফুট) উঁচুতেও।
অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধে ব্যবহারের মত ড্রোন ভারতের হাতে খুব বেশি নেই।
তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০ কোটি ডলারে ৩১টি ‘এমকিউ-নাইনবি প্রিডেটর’ ড্রোন কেনার চুক্তি করেছে ভারত। এসব ড্রোন হাতে পেলে ভারতের হামলার সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে।
এসব ড্রোন টানা ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত উড়তে সক্ষম। উড়তে পারে ৪০ হাজার ফুট উঁচুতেও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত এখন ‘সোয়ার্ম ড্রোন’ কৌশলেও গুরুত্ব দিয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থায় অসংখ্য ছোট ছোট ড্রোন একসঙ্গে পাঠিয়ে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
লাহোরভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক ইজাজ হায়দার বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানের ড্রোনের বহর “অনেক বড় ও বৈচিত্র্যময়’, যেখানে নিজেদের পাশাপাশি আমদানি করা প্রযুক্তিও আছে।
তিনি বলেন, হাজারের বেশি ড্রোন রয়েছে, যেখানে চীন ও তুরস্কের পাশাপাশি স্থানীয় মডেল রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে চীনের ‘সিএইচ-ফোর’, তুরস্কের “বেয়রাকতার আকিনসি’ ও পাকিস্তানের নিজস্ব মডেল ‘বুরাক’ ও ‘শাহপার’ উল্লেখযোগ্য।
এর বাইরে পাকিস্তান `লোইটারিং মিউনিশন' দাঁড় করিয়েছে, যা তাদের ড্রোন হামলার সক্ষমতা বাড়িয়েছে।
পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের পর ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলার সালামাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর। ছবি: রয়টার্স
হায়দার বলেন, “পাকিস্তানের বিমান বাহিনী (পিএএফ) সামরিক অভিযানে প্রায় এক বছর ধরে মানুষবিহীন ব্যবস্থা প্রয়োগ করছে।
“তারা ‘লয়্যাল উইংম্যান’ ড্রোনে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে, যেগুলো মানুষচালিত উড়োজাহাজের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবহার করা হবে।”
অধ্যাপক মতিসেক বলেন, “ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং তাদের হারোপ ও হেরন ড্রোন ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে তুর্কি ও চীনের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা চলমান অস্ত্রের মহড়াকেও সামনে আনছে।”
ড্রোনের ব্যবহারকে এক অর্থে ‘সংযত’ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষক মনোজ যোশি।
বিবিসিকে তিনি বলেন, “যুদ্ধবিমান ও কিংবা ভারী ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে (চলমান) সংঘাতে ড্রোন মোতায়েন করাটা তুলনামূলক ছোটখাটো সামরিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। মানুষচালিত যুদ্ধবিমানের চেয়ে ড্রোনে অস্ত্রশস্ত্র কম থাকে। সুতরাং এক অর্থে দেখতে গেলে এটা ‘সংযত’ একটা পদক্ষেপ।
“কিন্তু এটা যদি বিস্তৃত বিমান হামলার অংশ হয়, তাহলে সব হিসাবনিকাশ পাল্টে যাবে।”
ইজাজ হায়দারের বিশ্বাস, জম্মুতে পাকিস্তানি ড্রোনের সাম্প্রতিক তৎপরতা ভারতের ‘উসকানির’ একটা কৌশলগত জবাব, এটা সর্বাত্মক কোনো প্রতিশোধ নয়।
“ভারতের বিরুদ্ধে পুরো দস্তুর হামলা হলে তা সম্ভবত আরও ব্যাপক হবে, যেখানে মানুষচালিত ও মানুষবিহীন- উভয় ধরনের প্লাটফর্মই ব্যবহার করা হবে।”
অন্যদিকে যোশি মনে করেন, “আমরা যে ড্রোনের লড়াই দেখছি, সেটা সম্ভবত খুব বেশি দিন চলবে না। এটা বড় কোনো সংঘাতের সূচনাও হতে পারে।
“এটা উসকানি হতে পারে, আবার সংযত হওয়ার ইঙ্গিতও হতে পারে। আমরা এমন একটা সময়ে আছি, পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা নিশ্চিত নয়।”