ভারত মুসলিমদের ‘বিদেশি’ হিসেবে বেছে বেছে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে - আসামের সংকট

ভারতে মুসলিমদের ‘বিদেশি’ আখ্যা দিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে
আসাম থেকে শুরু হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বিতাড়নের অভিযোগ তীব্র হচ্ছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী বাংলাদেশি না হলেও, তারা মুসলিম এবং বাংলাভাষী হওয়ায় ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
২৪ জুন আল–জাজিরার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসামের ৬৭ বছর বয়সী সাইকেল মেকানিক আলী গত ৩১ মে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন, যদিও বাংলাদেশে কাটানো চারটি দিন তাঁর জন্য ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আসামের ‘বিদেশি নাগরিক’ ধরে নিয়ে পুলিশ তাকে আটক করে এবং পরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ ফেলে দেয়, যেখানে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ১২ ঘণ্টা কাটাতে হয়। আলীর মতো আরও তিনশোর বেশি মুসলিম নাগরিককে এভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্বীকার করেছেন।
আসামে বহু বছর ধরে বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা বিদ্যমান। ২০১৬ সালে বিজেপি সরকারের ক্ষমতায় আসার পর এই উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আসামে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, যা ভারতের অন্য কোথাও এতটা নেই।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার ‘অবৈধ বিদেশি’ শিকার করার নামে শুধুমাত্র মুসলিমদের লক্ষ করে নিপীড়ন করছে। কংগ্রেস এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই অভিযানের ধরণকে ধর্মভিত্তিক নিপীড়ন হিসেবে নিন্দা জানায়।
বিজেপির পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয় এবং দাবি করা হয়, অভিযান কোনও ধর্মভিত্তিক নয় এবং অবৈধ বাংলাদেশিদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবে হিন্দুদের ঠেলে দেওয়ার ঘটনা পাওয়া যায়নি।
আসামে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনাল’ নামে বিশেষ আদালত রয়েছে, যেখানে নথিপত্রে ছোটখাটো ভুল দেখিয়ে মানুষকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তালিকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাদ পড়েন, যার মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মুসলিম।
ভুক্তভোগী সোনা বানু বলেছেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি, জন্মভূমি আমাকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেবে।’ অনেকেই এখনো বিচারাধীন থাকলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপের কারণে তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব হারিয়ে ভীতির মধ্যে রয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য রাজ্যেও এমন অভিযানের খবর পাওয়া গেছে, যেখানে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বিদেশি’ বলে আটক করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে কিছু মানুষকে ফেরত আনা হলেও অধিকাংশের জন্য নিরাপত্তাহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মুছে না।
আসামের মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ‘মিয়া’ শব্দটি অপমানসূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রতীক।
বাংলাদেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া ভারতীয় নাগরিকরা অভিযোগ করেছেন, বিজিবি ও বিএসএফ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ভারত সরকারকে কূটনৈতিক বার্তা প্রেরণ করেছে, যেখানে এসব পদ্ধতির আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন দাবি করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ ‘জোরপূর্বক বহিষ্কার’ বা ‘পুশ ব্যাক’ নয়; এটি একটি প্রেতাত্মক ‘বিধ্বংসী নিপীড়ন’ যেখানে ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মীরা এই পরিস্থিতি মানবিক সংকট বলে বর্ণনা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বেগ প্রকাশের আহ্বান জানাচ্ছেন।