সাবেক আইজিপির জবানবন্দিতে জুলাই আন্দোলন

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের দেওয়া এক জবানবন্দি থেকে জানা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। তখন আন্দোলন দমনে প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়েছে। আন্দোলনপ্রবণ এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। গত ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ জবানবন্দি দেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় তাঁর দেওয়া এ জবানবন্দির বিস্তারিত সম্প্রতি জানা গেছে।
২০২২ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকারের পতন পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর আগে র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তার জবানবন্দিতে জুলাই আন্দোলন দমনের বিভিন্ন কৌশল, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ভূমিকার কথা উঠে আসে। সাবেক এই আইজিপি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হয়েছেন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে একপর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনকে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি র্যাবের ডিজি (মহাপরিচালক) হারুন অর রশিদের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশপ্রধান হিসাবে আমি উক্ত কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।’
প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আমার সামনে অতিরিক্ত ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার) প্রলয় জোয়ারদার উপস্থিত ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা জানতে পারেন।’
সাবেক আইজিপির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, ‘ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। ১৮ জুলাই (২০২৪) ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চায়নিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে জবানবন্দিতে বলা হয়, সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। মূলত ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ওবায়দুল কাদের ও নানক সাহেব ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন। তাঁরাসহ কিছু নেতা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন।
সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের আগ্রাসী বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক হতো বলে জানান সাবেক আইজিপি। রাত ৮টা, ৯টার দিকে এ বৈঠক হতো। তিনি সদস্য হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকতেন।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, ‘বৈঠকে স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর সাহেব, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদ, র্যাবের ডিজি হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বিজিবির ডিজি ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা জানাতেন এবং পরামর্শ করতেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় কোর কমিটির এমন এক বৈঠক থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এটা উল্লেখ করে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আটকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিজিএফআই এবং ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে। পরে তাঁদের (সমন্বয়কদের) আটক করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় এবং সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতনসহ চাপ দেওয়া হয়। তাঁদের আত্মীয়স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়।’
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘কোর কমিটির বৈঠকে তাদের আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তাদের আটক করা হয়। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিল। আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে “জিন’’ নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।’
এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় অফিশিয়াল বৈঠকবহির্ভূত হিসেবে কতিপয় পুলিশ অফিসার, ওসি, এনটিএমসির তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের তৎকালীন ডিজি এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন বলেও জবানবন্দিতে এসেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনা দুই দফা বৈঠক করেছিলেন বলে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়।
সেখানে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান এবং আমিসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন পরিস্থিতি এবং তা দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায়, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিংয়ে থাকাবাস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে ও বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।’
দ্বিতীয় বৈঠকের বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর বোন শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি এবং আইজি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। জেনারেল মুজিব (লে. জেনারেল মুজিবুর রহমান) উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। সেখানে খোলামেলা কথা হয়। এসবির প্রধান মনিরুল ও ডিজিএফআইয়ের ডিজি বাইরে ছিলেন।’
৪ আগস্টের ওই বৈঠকে কীভাবে পরদিনের অর্থাৎ ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয় জানিয়ে সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, ‘ওই বৈঠকে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, র্যাবের ডিজি, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।’
সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের (পুলিশ) শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশমুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসাররা ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা নির্দেশনা প্রদান করেন।’
ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘বেলা ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে গণভবনমুখী জনস্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি। বেলা একটার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। আমি ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে সরকারের পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।’
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল বেলায় জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হেলিকপ্টার আসবে। আমি উক্ত হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি।’
জবানবন্দি শেষে সাবেক আইজিপি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বিচার নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার ভূমিকাসহ সার্বিক চিত্র বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে এই জবানবন্দি প্রদান করলাম।’