রোববার ০৪ মে ২০২৫, বৈশাখ ২১ ১৪৩২, ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

স্পেশাল

‘মানবিক করিডোর’: যে কারণে বিতর্ক, বাস্তবতা কী?

 প্রকাশিত: ০৫:১০, ৪ মে ২০২৫

‘মানবিক করিডোর’: যে কারণে বিতর্ক, বাস্তবতা কী?

দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডোর’ দিতে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার পর দেশের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের’ ক্ষেত্রে ঝুঁকির প্রশ্ন তুলে বির্তক উঠেছে, বিরোধিতাও এসেছে রাজনৈতিক দলের তরফে।

এই করিডোর কোন প্রক্রিয়ায় হবে, কোন এলাকায় হবে তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি সরকারের তরফে। তবে এটি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরফে কিছু শর্ত দেওয়ার কথা বলেছে সরকার।

এ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের স্পষ্ট বিরোধিতার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এই করিডোর তৈরিতে যুক্ত হওয়া নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যেও আছে মতভিন্নতা। এটাকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলছেন অনেকে।

তারা বলছেন, দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে গেলে সবার আগে মিয়ানমারের সরকারের সম্মতি লাগবে। আর জাতীয় সংসদ সচল না থাকায় রাজনৈতিক দলের মতৈক্যও প্রয়োজন।

 

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মার্চে বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার দপ্তরে সাক্ষাত করেন গুতেরেস। 

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মার্চে বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার দপ্তরে সাক্ষাত করেন গুতেরেস। 

মিয়ানমারের সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এখানে প্রধান দুটি পক্ষ মিয়ানমার জান্তা সরকার এবং রাখাইনের নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।

“আমাদের জানামতে, মিয়ানমার সরকারের থেকে এ ব্যাপারে কোনো সম্মতি পাওয়া যায় নাই। কাজেই সে সম্মতি ছাড়া যদি আমরা তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের ভেতরে প্রবেশ করি, সেটা তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হবে এবং এটা আন্তর্জাতিক আইনে সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ হবে।”

মিয়ানমারের সংঘাতে চীন, রাশিয়া ও ভারতের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মুনীরুজ্জামান বলেন, এটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

সেটি আইনসম্মত না হলে জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনায় ‘করা উচিত হবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গেলেও জাতীয় সংসদ বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এটা করতেও যদি হয় কোনো সময়, অবশ্যই জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

“যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো পার্লামেন্ট চালু নাই, বা কাজ করছে না, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে বড় রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের সাথে সংলাপ করে তাদের সম্মতি নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া, কোনোভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া একেবারে সমীচীন হবে না।”

 

মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি।

মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি।

করিডোর প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উপর জোর দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশ যদি রাজি থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের ‘এক ধরনের অনুমতি’ লাগবে।

“এখন মিয়ানমার সরকারকে আপনাকে মোটিভেট করতে হবে, কনভিন্স করতে হবে যে, আমরা এটা পাঠালে ভালো কাজ হবে। দুই রাষ্ট্রে বিষয়ে নতুন উপাদান যোগ হয়ে আছে আরাকান আর্মি। এখন আরাকান আর্মি রাজি হবে কি-না, মিয়ানমার সরকার রাজি হবে কি-না, তবেই না আপনি চালু করতে পারবেন। কারণ আমার একার ইচ্ছাইতো এটা হয় না।”

পুরো বিষয়টি এখনও পরিষ্কার না হওয়ার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, “জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে। কাজে, বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘের মধ্যে একটা আলোচনা হয়েছে।

“কিন্তু আমরা অথবা জাতিসংঘ কি মিয়ানমারের সরকার বা আরাকান আর্মির সাথে কথা বলেছে? না হলে চতুর্ভুজের দুইটা অংশ থাকলেতো হবে না, চারটা একসাথ হতে হবে। সেই চারটা একসাথে হওয়ার মতো কোনো সুযোগ কি আছে? এগুলো কি আমরা এক্সপ্লোর করে দেখেছি? কাজে, আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেতো এই বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে।”

মানবিক করিডোর যেভাবে আলোচনায়

২০২১ সাল থেকে সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধে বিপর্যপ্ত বাংলাদেশের পূর্বের প্রতিবেশী মিয়ানমার। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের পুরোটা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। শুধু এ রাজ্যের কায়ুকফায়ু সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে সামরিক জান্তা।

রাখাইনে যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে গত নভেম্বরে ‘রাখাইন: গড়ে উঠছে একটি দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আসন্ন দুর্ভিক্ষের হুমকিতে রাখাইন। অনুমান হচ্ছে, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন কেবল ২০ শতাংশ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। বীজ ও সারের অভাব, বাজে আবহাওয়া এবং বাস্তুচ্যুতির কারণে মানুষ কৃষি কাজ থেকে দূরে থাকায় ধান উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বাণিজ্য প্রায় বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। তবে, রাখাইনের প্রবেশপথের পাশাপাশি একমাত্র সমুদ্রবন্দরটি দখলে আছে মিয়ানমার জান্তা সরকারের। এর ফলে রাখাইনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্যে ঢোকার পথ বন্ধ।

এর মধ্যে মানুষের আর্থিক সংকট এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি উপার্জন আর স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকমাত্রায় কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কথা বলা হয় ওই প্রতিবেদনে।

এর মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।

৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম আসার কথা তুলে ধরে ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন তিনি।

“তাকে আমরা বলেছি, রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা, যে সংকট সেটা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নাই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে।”

 

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

তার ওই বক্তব্যের প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি এটুকু আপনাদেরকে বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এটাতে সম্মত। কারণ, মানবিক প্যাসেজ হবে।

“কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেটার বিস্তারিততে যাচ্ছি না, সেই শর্তাবলী যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।”

তার ওই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।

‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের যে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের কাছ থেকে।

রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বিরোধিতার মুখে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ’ বা ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়া নিয়ে ‘জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার’ সঙ্গে সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি।

 

 

এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ যৌক্তিক পরিকাঠামোগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।”

এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার এক বার্তায় রাখাইনে মানবিক সহায়তা নেওয়ার পথ তৈরির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ যদি জড়িত হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হওয়ার কথা বলেছে বৈশ্বিক সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়।

এরপর প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, “মানবিক করিডোরে আমরা রাজি যদি জাতিসংঘ এটার উদ্যোগ নেয়। এই পুরো জিনিসটা হবে দুইটা দেশের সাথে কথা বলে।

“জাতিসংঘ যখন কাজ করে তারা সেখানে সংশ্লিষ্টদের সাথে অর্থাৎ মিয়ানমার সরকারের সাথেও কথা বলবে, আমাদের সাথেও কথা বলবে। বলে তারপরই তো সিদ্ধান্তে আসবে।”

যেসব শর্তের কথা বলছে বাংলাদেশ

‘মানবিক করিডোর’ তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ, বৈষম্যহীন এবং শর্তহীনভাবে সবাইকে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ত্রাণ পরিবহন এবং বিতরণের জন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হলে ত্রাণ সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এজন্য যুদ্ধ বিরতি বা এমন একটি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের মাধ্যমে ত্রাণ পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থায় কোনও ধরনের বিরূপ প্রভাব না ফেলে।

রাখাইনে আরাকানি, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের কাছে যেন বৈষম্যহীনভাবে ত্রাণ পৌঁছে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেছে বাংলাদেশ। যাতে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মির কারণে অন্য জনগোষ্ঠী বঞ্চিত না হয়।

‘শর্তহীন ত্রাণ বিতরণের’ উপর জোর দেওয়ার কথা তুলে ধরে এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ চাইছে, ত্রাণ বিতরণের সময়ে কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো ধরনের কাজ করলে বা না করলে ত্রাণ বিতরণ করা হবে- এমন কোনো শর্ত দেওয়া যাবে না।

রাখাইনে দুর্ভিক্ষ হলে সেখানকার মানুষের বাংলাদেশমুখী ঢল তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেও মানবিক করিডোরের বিষয়টি বিবেচনার করার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের মিয়ানমার উইংয়ের এক কর্মকর্তা।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট।

এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে আংশিক যাচাই বাছাইয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা এপ্রিলে জানিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশের খবর আসে।

 

প্রায় আট বছর আগে মিয়ানমারে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে।

প্রায় আট বছর আগে মিয়ানমারে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে।

‘মানবিক করিডোর’ কী, কীভাবে কাজ করে

আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্টভাবে মানবিক করিডোরের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে, সেখানে বলা আছে, বেসামরিক লোকজনের কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণ দ্রুত এবং বাধাহীনভাবে যাওয়ার ব্যবস্থা কোনো সংঘাতে জড়িত সবপক্ষকে করতে হবে। এ কাজে ত্রাণকর্মীদের স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেডক্রসের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “মানবিক করিডোর বা নিরাপদ চলাচলের পথ হল-সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্য হওয়া চুক্তি, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় নিরাপদে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। বেসামরিক ব্যক্তিদের চলাচল, মানবিক সহযোগিতা নেওয়া কিংবা হতাহতদের উদ্ধারের করা হয় এর মাধ্যমে।”

এই করিডোর কোন প্রক্রিয়ায় হবে এবং কীভাবে পরিচালনা করা হবে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তা ঠিক করে থাকে।

বিশ্বের আলোচিত করিডোরগুলোর মধ্যে একটি আজারবাইজানের ভূখণ্ড নাগর্নো-কারবাখের সঙ্গে আর্মেনিয়া এবং সারাবিশ্বের যোগাযোগের পথ ছিল লাচিন করিডোর। স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে নাগর্নো-কারবাখের অধিকাংশ অধিবাসী জাতিতে আর্মেনীয়।

১৯৮৯ সালে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার মধ্যকার প্রথম যুদ্ধের পর করিডোরটি চালু হয়েছিল। এর নিরাপত্তায় যুক্ত হয়েছিল রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীও। ২০২০ সালে এক যুদ্ধে আজারি বাহিনী লাচিন করিডোর দখলে নেয়।

শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও এরপর সেটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করে কয়েক বছর পরই তা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করে আর্মেনিয়াসহ অন্যরা।

এরপর ২০২৩ সালে নাগর্নো-কারাবাখ পুরো দখলে নেয় আজারবাইজান। সেখানকার অধিবাসীদের বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুত হয়ে লাচিন করিডোর দিয়ে আর্মেনিয়া কিংবা অন্যত্র চলে যান।

বসনিয়া যুদ্ধের সময়ে ১৯৯৩ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোবিনাতে স্রেব্রেনিকা ছিটমহলসহ কয়েকটি ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ।

নিরাপত্তা পরিষদের দুটি প্রস্তাবের আলোকে যে ছয়টি এলাকাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় সেগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী।

জাতিসংঘের সেই ‘নিরাপদ এলাকা’ গঠনকে বর্তমানে ওই যুদ্ধের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কেননা, কোন নিরাপদ এলাকাকে সুরক্ষিত রাখা হবে, তা সুস্পষ্ট ছিল না জাতিসংঘের প্রস্তাবে।

ওই প্রস্তাবের কারণে জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। যেসব দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, অনেকটা রাজনৈতিক কারণে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি তারা।

১৯৯৫ সালের দিকে নিরাপদ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে, যার পথ ধরে স্রেব্রেনিকা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

 

 

মানবিক করিডোর কতটা ঝুঁকির?

মিয়ানমার যদি এই মানবিক করিডোরের অনুমতি না দেয়, তাহলে দেশটির ভূখণ্ডে ঢুকলে বাংলাদেশ বেআইনি কাজে জড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনীরুজ্জামান।

একইসঙ্গে, মানবিক করিডোর কীভাবে করা হবে, তা স্পষ্ট না হওয়ার কথা তুলে ধরে বিআইপিএসএস সভাপতি বলেন, “করিডোরটা কীভাবে স্থাপন করা হবে, কে পরিচালনা করবে এবং এটার নিরাপত্তা কারা প্রদান করবে- এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কোনো ধারণা দেওয়া হয় নাই। তবে, যদি বাংলাদেশের সৈন্যরা এর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়, তাহলে তাদের উপর বড় ধরনের ঝুঁকি আসার আশঙ্কা আছে।

“এবং এটা শুধু আমাদের সেনাদের নিরাপত্তার সাথে জড়িত হবে না, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে এটা জড়িত হয়ে যাবে। কাজে সেদিক থেকে এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা বিষয় হবে।”

এমনটা হলে কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলো নয়, বড় বড় শক্তিগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ চলে যেতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেখানে সবকিছু মাথায় রেখে বিশ্লেষণ করতে হবে। এ কারণে যে আমরা যদি এ ধরনের কোনো কাজে লিপ্ত হই এবং সে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ এখানে জড়িত আছে, তারা এটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে।

“সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যাদের কথা শুনে আমরা এখানে যাচ্ছি, তাদের পক্ষে আমরা একটি প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারি, এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই, সেক্ষেত্রেও বলতে পারি যে নিরাপত্তার দিক থেকে এটা একেবারে সমীচীন হবে না।”

তিনি বলেন, “এ ধরনের কোনো কার্যক্রমের সাথে যদি আমরা আইনসম্মত না হওয়া সত্ত্বেও লিপ্ত হই, সেটা আমাদের এই অঞ্চলের জন্য এবং আমাদের জন্য ভুল নিদর্শন হিসেবে থেকে যাবে।

“ভবিষ্যতে যদি কেউ এই নিদর্শন অনুসরণ করে আমাদের ভেতরে করিডোর স্থাপন করতে চায়; উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ মনে করে যে, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে যে গোষ্ঠীগুলো আছে, তারা কোনো হুমকির সম্মুখীন, তাদের সাহায্য করার জন্য করিডোর স্থাপন করতে চায়, সেখানে আমরা খুব নাজুক একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যেতে পারি। এটা সেদিক থেকেও কোনোভাবে সমীচীন হবে না।”

 

 

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান

 

মুনীরুজ্জামান বলেন, “করিডোর পরিচালনায় যে ধরনের সম্পদ ব্যবহার করতে হয় তা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা শুধু স্থলভাগে নিরাপত্তা দিতে হয় না, এটা আকাশপথেও নিরাপত্তা দিতে হয়, এটার জন্য আকাশ প্রতিরক্ষা লাগে, এটার জন্য অনেক কিছু লাগে।”

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “মিয়ানমারের যেটা সীমান্ত, আমরা স্বীকার করি। কাজেই, একটা ‘নন-স্টেট অ্যাক্টরের’ সম্মতি নিয়ে একটি রাষ্ট্রের সীমান্ত লঙ্ঘন করাটা বেআইনি কাজ।

“এখানেতো রাষ্ট্র আছে এবং রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে। সেই রাষ্ট্রের সীমান্তকে আমরা এখনও স্বীকার করি। কাজেই, সেই রাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া কোনো কিছু করাইতো বেআইনি কাজ হবে।”

আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের যোগাযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তব কারণে হয়ত নিচু পর্যায়ে নন-স্টেট অ্যাক্টরের সাথে সমন্বয় বা কাজের জন্য কিছু যোগাযোগ থাকতে পারে।

“এটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হয় না। যেমন-আমাদের বিজিবি হয়ত করে। আবার রাষ্ট্র যোগাযোগ করার কথা না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মিয়ানমারের রাষ্ট্র বা সরকারকে স্বীকার করি।”

মানবিক করিডোরকে ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও গভীরভাবে চিন্তা করার কথা বলছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তিনি বলেন, “বিষয়টা হচ্ছে, মিয়ানমারেতো একটা যুদ্ধাবস্থা চলছে। যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আপনাকে যদি কাজ করতে হয়, তাহলে যে পরিমাণ দক্ষতা দরকার, যে পরিমাণ দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিচ্ছন্নতা বা স্বচ্ছতা দরকার, এগুলো আমাদের আছে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ আশ্বস্ত হতে পারছি না।

“তার কারণ হল-মিয়ামনার সরকারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখতে হবে। যেহেতু মিয়ানমারের ভূখণ্ড সে কারণে, মিয়ানমার সরকারের এক ধরনের অনুমতি আপনাকে নিতে হবে। বা তাদেরকে এটা গ্রহণ করতে হবে।”

রাখাইন আরাকান আর্মির দখলে থাকায় মিয়ানমার সরকারের দিক থেকে খাদ্যশস্যের আসা-যাওয়া বন্ধ থাকার কথা তুলে ধরে এই বিশ্লেষক বলেন, “কারণ তারা মনে করে আরাকান আর্মি হচ্ছে সন্ত্রাসী। তারা এটাকে ওইভাবে চিহ্নিত করে।”

তিনি বলেন, “কূটনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে, মানবিক করিডোর ‘সম্ভাব্য’ ভালো। কিন্তু রাজনৈতিক জায়গায়ও আপনাকে কাজ করতে হবে। সে জায়গাতে আমার ধারণা, যথেষ্ট পরিমাণ কাজ না করার ফলে আজকে এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। আজকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি সমর্থন না করে, আপনি এটা কীভাবে করবেন?”

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ বলতে মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে দ্বিস্তরভিত্তিক কাজ করতে হবে। আমার কি সেই দক্ষতা আছে? সেই অভিজ্ঞতা আছে এবং সেটা করার মত আমার সেই রাজনৈতিক পুঁজি আছে?

“এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করবে, না ওখানে গিয়ে এই কাজ করতে যাবে। এটাতে অনেকগুলো জটিলতা এর মধ্যে ঢুকে গেছে।”

রাজনৈতিক দলের অবস্থানের কারণে মানবিক করিডোর করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ পর্যন্ত যেতে পারবে কি-না, তা নিয়ে ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করে হুমায়ুন কবির বলেন, “তার কারণ ওই যে বললাম, এটা করতে গেলে সরকারের প্রচুর পরিমাণে সময়, শ্রম দিতে হবে। এখনকার পলিটিক্যাল কনটেক্সটে বা এখনকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে দায়দায়িত্ব, সামনে যেই ধরনের কাজ, এগুলো করবেন, না ওইটা করবেন।

“এখন এ বিষয়টাই যেহেতু বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ হচ্ছে, আলোচনার ভিত্তিতে সামনে কীভাবে আগানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।”