শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

স্পেশাল

পদ্মা সেতু: শরীয়তপুরবাসীর সব রোগের ওষুধ

 প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২২ জুন ২০২২

পদ্মা সেতু: শরীয়তপুরবাসীর সব রোগের ওষুধ

পদ্মা সেতু চালুর মধ্যদিয়ে শরীয়তপুরের সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগের শেকলই তৈরী করবে না শুধু সম্ভাবনাকে প্রশস্ত করে শিক্ষা, চিকিৎসা, সুবিচারসহ সার্বিক উন্নয়নকে দেখাবে আলোর পথ। পদ্মা সেতু শুধু নদী পারাপারের পথই না, শরীয়তপুরবাসীর সব রোগের ওষুধ। 

এই সেতুর যোগাযোগ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শরীয়তপুর জেলার উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে আশাবাদী জেলার শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, আইনজীবী, নারী উদ্যোক্তা সহ সকল সৃষ্টিশীল মানুষ। যা শরীয়তপুরকে ৬৪ নম্বর তালিকা থেকে নিয়ে যাবে দেশের শিখরের জেলার তালিকায়।

শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার কৃতি শিশু কনসালটেন্ট ডা. রাজেশ মজুমদার বলেন, শরীয়তপুর নদীবেষ্টিত জেলা হওয়ায় জরুরী উন্নত চিকিৎসা প্রার্থীদের জন্য ছিল এক দূর্গম জেলা। জরুরী রোগীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে ঢাকায় পৌঁছানো ছিল এক কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। সময় অতিবাহিত করে ঢাকায় পৌঁছালেও কখনো কখনো শেষ হয়ে যেতো জরুরী চিকিৎসা সেবা দেয়ার সময়। সময়ের ব্যবধানে প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীপ্ত পদক্ষেপ ও বিরোচিত সাহসিকতার কারনে আজ শরীয়তপুরবাসীর জন্য পদ্মা সেতু আশির্বাদে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন- এখন আর জরুরী চিকিৎসা প্রত্যাশী কোন রোগীকে ঢাকায় পৌঁছানো দিন-রাতের কোন বিষয়ই থাকবে না। ফেরিঘাটে ঘন্টার পরে ঘন্টা বসে থাকতে হবে না এখন আর কোন মূমূর্ষ জরুরী চিকিৎসা প্রত্যাশী রোগীকে। ফলে জরুরী 
চিকিৎসার অভাবে এখন আর কোন রোগীকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে না। পদ্মা সেতু শুধু নদী পারাপারের পথই না, শরীয়তপুরবাসীর সব রোগের ওষুধ। 

জেলার নড়িয়া উপজেলার কৃতি নির্মাণ প্রকৌশলী মো. ফজলুল হক বলেন, পদ্মা সেতু শুধুমাত্র শরীয়তপুরের জন্য একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয় সার্বিক উন্নয়নের প্রবেশ দ্বার। পদ্মা সেতুর হাত ধরে শরীয়তপুরের এখন শুধুই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার পালা। উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার হাত ধরে যে কোন এলকা, দেশ ও বিশ্ব উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে যায়।  উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে শরীয়তপুরবাসী এতদিন উন্নয়নের দৌঁড়ে বেশ পেছনে অবস্থান করছিল। আজ পদ্মা সেতু আমাদের শরীয়তপুরের মানুষের সকল 
প্রতিবন্ধকতাকে পরাজিত করে বিজয়ের মালা পরিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের সময় শুধু উন্নয়নের এক একটি মুক্তাকে মালার সুতোয় থরে-থরে সাজানোর পালা। সময়ের ব্যবধানে এখন শরীয়তপুরে নির্মিত হবে আধুনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্টসহ নানা প্রয়োজনীয় স্থায়ী স্থাপনা। যা শরীয়তপুর জেলাকে সমৃদ্ধ করার মধ্যদিয়ে জাতীয় উন্নয়নে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দি গ্রামের নারী উদ্যোক্তা শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বিভাগীয় জয়িতা সামসুন নাহার সুমি বলেন, পদ্মা সেতু জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অপার সম্ভার পথে লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। এখন আর নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে কোন বেগ পেতে হবে না। আগে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করতে অনেক ব্যবসায়ীর উপর নির্ভরশীল হতে হতো। তারা বাজারজাত করার ব্যবস্থা করলেও গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হতো ন্যায্যমূল্য হতে। আমার কাছ থেকে ইতিমধ্যে ছয় শয়েরও বেশি নারী কম্পিউটার গ্রাফিকস, ক্যাটারিং, ইন্টোরিয়ার ইভেন ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটিফিকেশন, দর্জি, নকশিকাঁথা, ব্লক বাটিক
স্ক্রিনপ্রিন্ট, বিজনেজ ম্যানেজমেন্ট, স্যানেটারি ন্যাপকিন, বেবি কাঁথা ও দেশীয় পিঠা-পুলি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদন করছেন। পদ্মা সেতু এখন আমাদেরকে সেই প্রতিবন্ধকতার শেকল থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। খুব সহজেই ঢাকাসহ দেশের যে কোন চাহিদার বাজারে পণ্য পাঠিয়ে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার পাশাপাশি আমরা নারীর ক্ষমতায়ণের মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারবো। পদ্মা সেতু শরীয়তপুরের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সোনারকাঠি-রূপোর কাঠির ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

জাতীয় মহিলা সংস্থা শরীয়তপুরের সভাপতি এ্যাড. রওশন আরা বলেন, বর্তমান প্রেক্ষপটে নারীর ক্ষমতায়ণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে শরীয়তপুরের অনেক নারীরাই উৎপাদনমুখী হয়েছেন। কেউ গড়ে তুলেছেন, পোলট্রি ফার্ম, ছাগলের খামার, মাছের খামারসহ করছেন নানা উৎপাদনমুখী কর্মকান্ড। সঠিক বাজার ব্যবস্থার অভাবে তারা খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পান না। পদ্মা সেতু এখন দেশব্যাপী অবাধ বাজারজাতের সুযোগ করে দিয়ে তাদের সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে। সেইদিন খুব বেশি দূরে নয় শরীয়তপুরের সকল নারী উদ্যোক্তাসহ কর্মজীবী নারীরা শরীয়তপুরের উন্নয়নকে নেতৃত্ব দেবে।

শরীয়তপুর জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এ্যাড. অমিত ঘটক চৌধুরী বলেন, কষ্টদায়ক ও অধিক সময় সাপেক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে ঢাকার খুব কাছের জেলা শরীয়তপুর হলেও আমরা পিছিয়ে ছিলাম তুলনামূলক যোজন যোজন। পদ্মা সেতু আজ আমাদের সেখান থেকে নিয়ে এসেছে অনেক কাছে। এই সেতু শুধু আমদের দূরত্বই ঘুচায়নি সুযোগ করে দিয়েছে অনেক উন্নত ও সহজ সেবা প্রাপ্তির।

কষ্টদায়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে অনেক সেবা প্রাদানকারী সংস্থার লোক শরীয়তপুর আসতে চায়নি বা অবস্থান করতেও অনাগ্রহী ছিল। পদ্মা সেতুর বদৌলতে আমাদের কাংখিত সে সব সেবা প্রদানকারীরাও এখন আসবেন ও অবস্থান করবেন। যা প্রত্যাশিত সেবাকে নিশ্চিত করবে।  

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ শরীয়তপুরের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. হারুন অর রশীদ বলেন, গৌরবের পদ্মা সেতু হয়ে উঠবে আধুনিক ও উন্নত শরীয়তপুরের প্রবেশপথ। আগে ভাল মানের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিচারকসহ নানা সরকারি সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তা শরীয়তপুরে আসতে অনীহা প্রকাশ করতো। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক সংকট ছিল। কিন্তু এই সেতুর ফলে সারা জেলার যোগাযোগ উন্নত হওয়ার মধ্যদিয়ে আশা করছি আমাদের সেই সংকট দূর হয়ে যাবে। আর সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার মধ্যদিয়ে এখন অনেক শিক্ষকই জেলায় অবস্থান করতে আগ্রহী হবেন। বাড়বে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ও উপস্থিতি। প্রয়োজনীয় শিক্ষক থাকলে বাড়বে শ্রেণী পাঠদানসহ মেধাবী শিক্ষার্থী। এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাত ধরে শরীয়তপুর
দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে উন্নয়নের বন্দরে।

মন্তব্য করুন: