শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, শ্রাবণ ১২ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৬

বিজ্ঞান

ইন্টারনেট ও আমাদের সমাজ

মাওলানা তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 আপডেট: ০৬:৫৬, ২৫ অক্টোবর ২০২২

ইন্টারনেট ও আমাদের সমাজ

(নিকট অতীতের অত্যন্ত বুযুর্গ আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা আশেক এলাহী বুলন্দশহরী রাহ.-এর একটি কিতাব কিছুদিন আগে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কিতাবটির বাংলা নাম ‘তালীমুন নিসা’। তাতে মহিলাদের জন্য জরুরী দ্বীন শিক্ষা ও আবশ্যকীয় দ্বীনী বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয়েও রয়েছে দরদভরা সতর্ক বার্তা। সেই প্রসঙ্গে নভেল-উপন্যাস, রেডিও ও গ্রামোফোনের ক্ষতি সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। ঠিক সেখানে বাংলা অনুবাদে একটি জরুরী টিকা যুক্ত করা হয়েছে। টিকাটি লিখেছেন মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে সেটি আলাদাভাবে এখানে তুলে ধরা হলো।-উপস্থাপক)

আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে তাঁর সময়ের অবস্থা ও পরিবেশ হিসাবে নভেল-উপন্যাস, রেডিও ও গ্রামোফোন ইত্যাদি সম্পর্কে লিখেছেন এবং দরদভরা কষ্ট প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজ নভেল উপন্যাস আর রেডিও গ্রামোফোনের সেই ক্ষতি ছাড়িয়ে ভয়াবহ এক ক্ষতির শিকার হয়ে গেছে। ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ এবং পুরো বিশ্ব এখন এই ক্ষতির তীব্র ধাক্কায় বেসামাল। উত্তরহীন অধঃপতনে মুমূর্ষ। এ ক্ষতির ছদ্মনাম ইন্টারনেট।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো সমাজে রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ভয়াবহ। কারণ রাজনৈতিক আগ্রাসনের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, বিবাদ-বিসংবাদ বাড়ে কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটে। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে একেকটি জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।

বর্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। এর ক্ষতি বহুমুখী এবং বহু বিস্তৃত। সেগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতে গেলে উল্লেখযোগ্য শিরোনামে আসবে-সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয়, চোখের গোনাহ, দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি, শারীরিক-মানসিক চাপ, চরিত্র ও চিন্তা -চেতনার বিপর্যয় এবং ঈমানের ভয়াবহ অধঃপতন। এছাড়া কত ঘর-সংসার যে এর মাধ্যমে টুকরো টুকরো হয়েছে, কত জীবন যে বিপন্ন হয়েছে, কত মা- বাবা সন্তান হারিয়েছেন, কত সন্তান হারিয়েছে তার ভবিষ্যৎ এবং কতভাবে কত মানুষ কত ভয়ংকর জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে- সেই ফিরিস্তি শেষ হবার নয়।

দেখা যায়- অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট প্রয়োজনীয় কাজের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়। এমনকি যারা কঠিনভাবে নিয়ম মেনে চলেন, মজবুত রুটিন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেন, তারাও এখানে সময় বাঁচাতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হন প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে। না চাইলেও এতে সময়ের অপচয় হয়, লক্ষ্যমুখী কাজে বিঘ্ন ঘটে। এটা তো হল সময়- সচেতন ও লক্ষ্যে অবিচল মানুষের ক্ষেত্রে। আর যারা অসচেতন এবং অসতর্ক- তারা যে কত রকমের ক্ষতির শিকার হয়, হিসাব করে বের করা যাবে না।

প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের যে আশ্চর্য মিশ্রণ ঘটেছে ইন্টারনেটে, সত্যিই তা নজিরবিহীন।

ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলোর একটি হলো, চোখের গোনাহ। নেট ব্যবহার করেও এই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এমন মানুষ বোধহয় হাজারে একজন পাওয়া দুষ্কর হবে। কারণ এখানে সর্বব্যাপী আয়োজনটাই এমন যে, এই গুনাহমুক্ত হয়ে থাকা সম্ভব নয়। ফলে বার বার গুনাহটি করতে করতে এক সময় খুব সহজ হয়ে যায়। এবং এটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। অথচ হাদীস শরীফে কত কঠিন কথা বলা হয়েছে এ প্রসঙ্গে-
زنا العين النظر
‘দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো চোখের যিনা’-(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬২৪৩)
চোখের গোনাহের যে সকল ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মনোজগতে পড়ে, এখানেও তা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান।

খুব তিক্ত হলেও সত্য যে, এর দ্বারা সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে আমাদের পর্দানশীন পরিবারগুলো। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে, দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে উঠা পর্দানশীন নারীরা আগে অন্তত এই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পেত না। বাবা, স্বামী, ভাই এবং মা ও সংসারের অন্য অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানেই তাদের জীবন পরিচালিত হতো। সম্পূর্ণ ঘরোয়াভাবে থাকার কারণে গায়রে মাহরাম কোনো পুরুষকে দেখা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু এই মোবাইল ইন্টারনেটের কারণে এখন আর কোনো তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ কিংবা কোনো নজরদারি তাদের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছে না

এ ক্ষেত্রে মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত অজুহাত সবচে বড় ভূমিকা পালন করে। আর ভূমিকা পালন করে “ইসলামিক ভিডিও” ও “ইসলামী সংগীত” দেখার অজুহাত। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন এইসব অজুহাত কতটা অনর্থ! এইসব অজুহাতের নামে শয়তান আমাদেরকে কত মারাত্মক ধোঁকায় ফেলছে!


আর ইসলামী সংগীত দেখার ক্ষতিও কি কম হচ্ছে? সঙ্গীত শিল্পীদের সাজ-সজ্জা ও অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দুঃখজনক বহু ঘটনার সংবাদও তো পাওয়া যায়। তাছাড়া নিজের স্বামী, ভাই ও সন্তানকে হুবহু সেই বেশভূষায় সজ্জিত হওয়ার উৎসাহ দিতেও শোনা যায়। এমনকি সেই পোশাক-সজ্জা ছাড়া তাদের ‘স্বপ্ন-পুরুষ’ হওয়া সম্ভবই নয়- এ অভিযোগও আসে অনেকের পক্ষ থেকে। তাহলে এর ভালো দিকটা কোথায়? একটু দরদের সাথে, পর্দানশীন নারীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিভাবকগণ কি বিষয়টি ভেবে দেখবেন?

ইন্টারনেটের ক্ষতিকে আরো বাড়িয়ে দেয় তার সহজলভ্যতা ও অভিভাবকদের সহজ দৃষ্টি।


হাতের নাগালে স্মার্টফোন থাকার কারণে ছোট বড় যে- কেউ যে- কোনো সময় তা ব্যবহার করতে পারে। যে-কোনো সুযোগে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে তার ক্ষতির দিকসমূহে। পরিবারের ছোট থেকে ছোট কোনো সদস্যও ইমু, মেসেঞ্জার কিংবা ইউটিউবের ছুঁতোয় নেটে প্রবেশ করতে পারে। অভিভাবকগণও এটাকে সহজভাবে নেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখেন।
অথচ এর মাধ্যমেই কত বড় বড় ক্ষতির শিকার হয়ে যায় তারা।

ইদানীং দ্বীনদার অনেক মা-বাবার মুখেও শোনা যায়, শিশুরা নাকি ইউটিউবে মজার ভিডিও আর কার্টুন না দেখে খাবারই খেতে চায় না! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

অনেক পরিবারে মা-বাবা দুইজনই চাকরি করেন। সন্তানকে তেমন সময় দিতে পারেন না। তাই সন্তানরা যেন লেখাপড়ার সময় বাদে বাকি সময়টাও আনন্দে কাটাতে পারে, কিংবা বাড়তি কিছু শিখতে পারে (!) সেজন্য তাদের হাতে ইন্টারনেট সংযোগসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দেন। এসবের পরিনাম যে কত ভয়াবহ আকারে প্রকাশ পায়, তা বোধহয় আলোচনার অপেক্ষা রাখে না।

শুধু এক ইন্টারনেটের মাধ্যমেই দ্বীনি-বদদ্বীনি কত পরিবারের কত সদস্যের চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটেছে, তা কি হিসাব‌ করে বের করা সম্ভব? শারীরিক ক্ষতি আর নৈতিক ক্ষতির হিসাব তো আরও বড়।


এজন্য প্রথম কাজ ‌হলো, যথাসম্ভব ঘরকে ইন্টারনেট মুক্ত রাখা। অন্তত সন্তানের সামনে মা-বাবার নেট ব্যবহার বন্ধ রাখার চেষ্টা করা।
মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট এক বিষধর সাপ। এর এক ছোবলে যে কারও প্রাণনাশ হতে পারে। সাপের বিষকে কাজে লাগানো তো সবার সাধ্যের বিষয় নয়!

হে আল্লাহ! এই উম্মতকে আপনি হেফাজত করুন। যমানার এই ভয়াবহ ফেতনা থেকে রক্ষা করুন। প্রাণনাশক এই সাপের ছোবল থেকে পরিবার ও সমাজকে আপনি মুক্ত রাখুন। আপনি ছাড়া আর কারও পক্ষে এই ফিতনা রোধ করা সম্ভব নয়। হে আল্লাহ! আমরা আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আমাদের পরিবার গুলোকে আপনার হাওয়ালা করছি।