সাহাবিদের সাহসিকতার রহস্য

সাহাবিদের অদম্য সাহসিকতা: ইমান, ধৈর্য এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাসের ফল।
ইসলামের সূচনালগ্নের সাহাবিদের জীবনে যে সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা দেখি, তা আজকের সময়ের মুসলমানদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁদের সাহস ছিল কেবল বাহ্যিক শক্তির নয়, বরং গভীর ইমান, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য থেকে উৎসারিত।
কোরআনে সাহসিকতার শিক্ষা
কোরআনে সাহসিকতা ও ধৈর্যের প্রতি অনেক জায়গায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন: “হে মুমিনগণ, ধৈর্য ধারণ করো, দৃঢ় থাকো, সীমান্তে প্রহরায় স্থির থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”
— সুরা আলে ইমরান, আয়াত ২০০
এ আয়াতে চারটি উপদেশ—ধৈর্য, অবিচলতা, প্রহরাদান ও আল্লাহভীতি—সবই সাহসিকতার ভিত্তি।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন: “যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমা প্রদর্শন করে, সেটাই হচ্ছে সত্যিকারের সাহসিকতা।”
— সুরা শুরা, আয়াত ৪৩
এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, সাহসিকতা কেবল যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং জীবনযুদ্ধে ধৈর্য, সহনশীলতা ও সত্যে অবিচল থাকার মধ্যেও নিহিত।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহসিকতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সাহসিকতার প্রতীক। গোটা কুরাইশ জাতি যখন তাঁর দাওয়াত বন্ধ করতে চেয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন: “তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাঁ হাতে চাঁদ দিয়েও বলে দাওয়াত থেকে সরে যেতে, তবুও আমি থামব না, যতক্ষণ না আল্লাহ বিজয় দেন বা আমি এতে শহীদ হই।”
— ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন-নাবাবিয়্যাহ
তাঁর সাহসিকতা শুধু বক্তব্যে নয়, বাস্তব জীবনেও ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছেন: “সর্বোত্তম জিহাদ হলো—একজন জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।”
— তিরমিজি, হাদিস ২১৭৪
সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, “নবীজি ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী, উত্তম ও উদার।”
সাহাবিদের জীবনে সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহচর্যে থাকা সাহাবিরাও ছিলেন অসম সাহসী। তাঁদের কাছে দুনিয়া তুচ্ছ, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ছিল সবচেয়ে বড়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, প্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সাতজনের মধ্যে ছিলেন—রাসুল (সা.), আবু বকর, আম্মার, সুমাইয়াহ, সুহাইব, বিলাল ও মিকদাদ।
বিশেষ করে বিলাল (রা.)-এর সাহস ছিল অসাধারণ। তাঁকে যখন নির্যাতন করা হতো, তখন তিনি শুধু বলতেন: “আহাদ, আহাদ”—আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।
— ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৫০
উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে কাবায় নামাজ পড়েন এবং হিজরতের সময় বলেন: “যে চায় তার মা সন্তানহারা হোক, স্ত্রী বিধবা হোক আর সন্তান এতিম হোক—সে আমার পিছু আসুক।”
— উসদুল গাবাহ
তিনি খুতবায় বলেন: “সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার হক আদায় করে দেই। আর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিও আমার কাছে দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে অন্যের হক আদায় করি।”
তিনি সাহস গড়ে তোলার জন্য বলতেন: “তোমাদের সন্তানদের সাঁতার, তিরন্দাজি ও ঘোড়সওয়ারি শেখাও এবং এমন কবিতা শেখাও, যা চরিত্র উন্নত করে।”
নারী সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ইসলামের ইতিহাসে নারীরাও সাহসিকতায় পিছিয়ে ছিলেন না।
-
হজরত আসমা (রা.) হিজরতের রাতে ঝুঁকি নিয়ে খাবার ও সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিলেন।
-
খাউলা বিনতে আযওয়ার (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে সমান কাঁধে লড়েছেন।
-
সুমাইয়া (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম নারী শহীদ। তিনি নির্যাতনের মুখেও ইমান ত্যাগ করেননি।
শেষ কথা
সাহসিকতা কেবল বাহ্যিক শক্তির নাম নয়—এটি হলো ইমানের দৃঢ়তা, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা। সাহস মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়, আত্মবিশ্বাস জোগায় এবং জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের পথ অনুসরণ করে আমাদের নিজেদের ভেতর সেই সাহসিকতা গড়ে তুলতে হবে।