দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র সৈকত কেন্দ্রিক পর্যটন স্পট পর্যটকদের টানছে
সমুদ্র তটরেখায় অপরূপ ব-দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ বঙ্গোপসাগর। সাগরের নোনাজল তেল, গ্যাস, খনিজ বালি, প্রবাল, সামুদ্রিক শৈবাল, মাছসহ অনেক সম্পদ দিয়েছে এদেশের মানুষকে।
সমুদ্র উপকূলের জনপদ ঘিরে এদেশে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে ্র। দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলরেখা লাগোয়া চট্টোগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে রয়েছে সমুদ্র সৈকতগুলো। সৈকতগুলো বাংলার মুক্ত প্রকৃতির সুখ্যাতি ছড়িয়েছে, টানছে দেশ-বিদেশি অগণিত পর্যটক।
বরিশাল বিভাগের সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে সবার আগে নাম আসে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটার কথা। জেলার কলাপাড়া উপজেলায় অবস্থিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দৈর্ঘে ১৮ কিলোমিটার। এ সৈকত থেকে দেখা যায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য। সৈকতের পূর্ব দিকে আছে গঙ্গামতির বন। এ বনটি আগে বৃহত্তর সুন্দরবনের অংশ ছিল। যা এখন কুয়াকাটার প্রাকৃতিক ঢাল স্বরূপ; ঢেউ এর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে জনপদকে।
বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু দ্বীপ’টি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক ও অভিযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হতে পারে। সমুদ্রগামী জেলেরা এ দ্বীপটির আবিস্কারক হলেও ঠিক কত সালে তারা প্রথম দ্বীপটি খুঁজে পেয়েছিলেন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও জেলেদের কাছে থেকে জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত, মালেক ফরাজী নামের এক মৎস্য শিকারি ১৯৯২ সালে দু’জন জেলেকে নিয়ে দ্ব ীপে কোন কারণে অবতরণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘বঙ্গবন্ধু দ্বীপ’। দুবলার চর থেকে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে দ্বীপটি অবস্থিত। এ দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই মিটার উঁচু দ্বীপটি। বহু পর্যটক সেখানে ঘুরতে যাচ্ছেন।
বরগুনার তালতলী উপজেলার ফকিরহাটে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের কোলে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি বনাঞ্চল। এ বনে এসে কান পাতলে শোনা যায় সাগরের গর্জন। টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে। এ বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪ হাজার ৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। বনাঞ্চলের সখিনা বিটে ২০১১ সালে ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে পর্যটকদের জন্য আগেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি ডাকবাংলো। বনের ভিতরে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য দুইটি সেতু (সকিনা ও সুদরিয়া খালে), দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক, পুকুরে পাকা ঘাট, সাগরপাড়ে জেটি, ৩ টি টয়লেট, বনের মধ্যে বিশ্রামাগার, হরিণ, শুকর, ছোট মাংশাসী প্রাণী আর বাঘের বেষ্টনী এবং কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও বেষ্টনীসহ মানববান্ধব বনজপ্রাণীর আশ্রায়স্থল রয়েছে। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের অভয়ারণ্যে ১০টি হরিণ, ২৫টি শূকর, ৩টি চিতাবাঘ, ২৫টি অজগর, ২টি কুমির, শতাধিক বানর, ২টি শজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। সারি সারি গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, হেতাল, তাম্বুলকাটা গাছের মধ্যে এখানে ঘুরে বেড়ায় নানা প্রজাতির জীবজন্তু।
সোনাকাটা চরাঞ্চল নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাকেন্দ্র। তালতলী সদর থেকে খুব কাছেই বঙ্গোপসাগরের কোলে সোনাকাটা। সোনাকাটায় দেখা যাবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সৌন্দর্য। সোনাকাটার সাগর সৈকতে দাঁড়ালে চোখে পড়বে, বড়বড় ঢেউয়ের মাথায় চড়ে ট্রলার নিয়ে মাছ শিকারের জন্য জেলেরা ছুটছেন সাগরের গভীরে। সকালের সূর্যরশ্মি ঢেউয়ের ফেনার সঙ্গে মিশে সাগরে ঝকমকে সোনালী আভা ছড়ায়। তীরবর্তী চরাঞ্চল থেকে পাখিরদল সোনালী রোদেঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায় আকাশে, নীচেসাগরে তীরের কাছাকাছি ছোট ছোট নৌকা নিয়েজাল ফেলেন স্থানীয় জেলেরা। সূর্যাস্তের সময় সোনাকাটার দৃশ্য পুরোটাই পাল্টে যায়।
অস্তগামী সুর্যালোক সাগরের নীল জলরাশির সাথে মিশে সাগরকে আরও নীল করে তোলে। অন্ধকারের সাগরের পানিতে যে কোন আলোড়ন, আলো বিচ্ছুরন করে। কুয়াকাটার বাইরে দেশে একমাত্র সোনাকাটা থেকেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই উপভোগ করা যায়।
তালতলী সদর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে সাগর ও নদী মোহনায় অবস্থিত আশারচরে আছে শুঁটকির সাম্রাজ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে দূর সাগরের বুকে মাছ ধরারত নৌকোগুলোর টিমটিমে আলো দেখলে মনে হয় ভাসমান কোনো বন্দর। বালিহাঁস, গাঙচিল, পানকৌড়িসহ হরেক পাখির কুজনে সব সময় মুখর থাকে আশারচর।
তালতলীর সোনাকাটা সাগরতীর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে আরেকটি চর; -বিজয়। এখানকার সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা উত্তাল সাগর পাড়ি দিতেও পিছ পা হন না।
সমুদ্রের কোলঘেঁষা প্রান্তিক জেলা বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়াতে অবস্থিত শুভসন্ধ্যা সৈকত। সাগর তীরের বালুকণা পর্যটকদের দু-পায়ের অলংকার হয়ে সঙ্গে থাকে।
সীমাহীন সাগর, তীরের মুক্ত বাতাস আর চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক শোভা যেন সৈকতটির দৃষ্টি আকর্ষণের টোপ। বরগুনা জেলার প্রধান তিনটি নদী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরের মিলিত জলমোহনায় সৈকতটি দাঁড়িয়ে; -যৌবনা রূপ নিয়ে। এখানকার বেলাভূমিটি প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা। একদিকে সমুদ্রের জলরাশি অন্যদিকে ঝাউবন এখানে আসা স্বল্প সংখ্যক পর্যটকদের দিচ্ছে বাঁধ ভাঙা আনন্দ।
লালদিয়া সমুদ্র সৈকতটি বরগুনার পাথরঘাটায় অবস্থিত। বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মোহনায় লালদিয়া বনের পাশে এ স্বর্গরাজ্যের অবস্থান। এখানে একপাশে সমুদ্র, অন্য পাশে বন, মাঝে সৈকত, এমন সৌন্দর্য প্রকৃতিতে বিরল। লালদিয়া সৈকতে গড়ে তোলা হয়েছে ঝাউবন। হরিণঘাটা বনে নির্মিত ৯৫০ মিটার দীর্ঘ ফুটট্রেইল ব্রিজ সম্প্রসারিত করে লালদিয়া সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত নেয়া হয়েছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় তারুয়া সমুদ্র সৈকতের অবস্থান। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। ১৩৫ কিলোমিটার পাকা সড়কের পর ১৫ কিলোমিটার নৌ-পথ পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। এ সৈকতে পর্যটকরা একই সঙ্গে উপভোগ করতে পারেন বিশাল সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি, নানা ধরনের পাখিদের কলকাকলি, বালুকাময় মরুসম পথ আর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ছায়াঘন নিবিড় পরিবেশ। বৈচিত্রময় প্রাণি দেখার পাশাপাশি সাগরের উত্তাল গর্জন দ্বীপটিতে আগত পর্যটকদের মনকে শান্ত করে। তাইতো তারুয়া দ্বীপটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর বরিশাল কার্যালয়ের পরিকল্পনাবিদ মো. বায়েজীদ জানান, বরগুনার পাথরঘাটা, আমতলী, তালতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরতুফানী, জাহাজমারা প্রভৃতি পর্যটন আকর্ষণ এলাকাকে সমন্বিত সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় নেওয়া হবে।
বরগুনা ১ আসনের সাংসদ গোলাম সরোয়ার টুকু বলেছেন, সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করার জন্য কেন্দ্রগুলোর তালিকা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব এলাকার অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য নানা মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চলছে।