মোসাদের অভিযান: ইরানে শীর্ষ নেতাদের হত্যার পেছনের পরিকল্পনা

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের তেহরানে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন। ছবি: রয়টার্স
শুক্রবার (১৩ জুন) যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখনই ইরানের অভ্যন্তরে সক্রিয় হয়ে ওঠে এক বিশাল গোপন পরিকল্পনার চূড়ান্ত ধাপ। দেশটির ভেতরে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ছদ্মবেশী সশস্ত্র এজেন্ট, বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন এবং সাধারণ যানবাহনের মধ্যে গোপনে রাখা বিস্ফোরক বের হয়ে এসে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হয়।
ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া বিবরণে এক জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই পরিকল্পিত অভিযান ছিল ইরানি শাসনব্যবস্থার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গোপন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শুরু হওয়া বহুমাত্রিক একটি সামরিক তৎপরতার অংশ। অভিযানটির কোডনাম ছিল—‘রাইজিং লায়ন’।
ইরানের সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (IRGC) শীর্ষ নেতারা ছিলেন হামলার মূল লক্ষ্য। বেশিরভাগই ছিলেন ঘুমন্ত অবস্থায় নিজ বাড়িতে। বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তারা নিহত হন।
প্রথম ধাপে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন: মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি (সেনাবাহিনীর প্রধান), মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি (IRGC প্রধান), মোহাম্মদ মেহদি তেহরাঞ্চি (ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও পদার্থবিজ্ঞানী)
হামলার আগে থেকেই এসব লক্ষ্যবস্তুর বিস্তারিত ঠিকানা, চলাচল, নিরাপত্তা রুটিন—সবই মোসাদের কাছে ছিল। তাদের বাসা, বাংকার ও গোপন আশ্রয়স্থলের তথ্য-সংবলিত বিশদ ফাইল তৈরি করা হয়।
অভিযানের নেতৃত্বে ছিল ইসরায়েলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, তবে পুরো তৎপরতা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন অস্ত্র, বিস্ফোরক, ড্রোন এবং প্রযুক্তি ইরানের অভ্যন্তরে গোপনে পাচার করা হয়—যা সপ্তাহ বা মাস নয়, বহু বছর ধরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মজুত ছিল।
হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে এগুলো সক্রিয় করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে চালানো হয় সুনির্দিষ্ট আঘাত।
হামলার পর দ্বিতীয় স্তরের ইরানি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মোসাদ সরাসরি হুমকি পাঠায়—কারও বাড়ির দরজার নিচ দিয়ে চিঠি, কারও ফোনে সরাসরি কল, আবার কারও স্ত্রীর ফোনে ভয়ভীতিমূলক বার্তা। এতে জানিয়ে দেওয়া হয়: "তোমরা সবাই নজরদারিতে আছো।"
ড্রোন ঘাঁটি, বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিস্ক্রিয় করার অপারেশন
ড্রোন ঘাঁটি: তেহরানের কাছে এসফাজাবাদ এলাকায় গড়ে তোলে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয়।
বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি: সাধারণ যানবাহনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা বিস্ফোরক দিয়ে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস বা বিপর্যস্ত করা হয়।
ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহনকারী ট্রাক: এদের ধ্বংস করা হয় পরিকল্পিতভাবে। কারণ, একটি ট্রাক ধ্বংস মানেই চারটি ক্ষেপণাস্ত্র অকার্যকর।
এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ না নিলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সামাজিক মাধ্যমে হুমকির সুরে বলেন: ‘তারা সবাই এখন মৃত। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করলে আরও ভয়াবহ হামলা আসবে।’
পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা ইরানের কথিত পারমাণবিক কর্মসূচিকে বড় ধাক্কা দিলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনও নিশ্চিত নয়। ইরান অবশ্য বরাবরই বলে এসেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ।
‘রাইজিং লায়ন’ ছিল একটি বহুস্তরবিশিষ্ট অভিযান। শুরুতে গোপনে টার্গেট হত্যা, পরে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলায় রূপ নেয় পুরো অভিযানটি। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, ইরান নিজেদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও বৈজ্ঞানিকদের সুরক্ষা দিতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরায়েলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন—"তারা কোথায় আছেন, আমরা জানতাম।"