শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবী

 আপডেট: ২০:৫২, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবী

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ দশজন সৌভাগ্যবান সাহাবী ছিলেন, যারা তাদের বিশেষ আমল এবং সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে পার্থিব জীবনেই লাভ করেছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় অনেক সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেও এই ১০ জন সাহাবী-কে একত্রে একই মজলিসে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সৌভাগ্যবান এই ১০ জন সাহাবী-কে ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ বা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবী বলা হয়।

এই ১০ জন সাহাবী-র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

আবু বকর সিদ্দিক (রাযিঃ)
আবু বকর(রাযিঃ)-এর পুরো নাম আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা। আমরা জানি যে, আবু বকর মূলত তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম। এছাড়া খলিফাতুর রাসুল এবং সিদ্দিক নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ৫৭৩ খ্রিষ্ট্রাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের ‘বনু তাইম’ গোত্রে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

অন্যান্য সকলেরই ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু আবু বকর(রাযিঃ) বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকর(রাযিঃ) ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে কাছের সাহাবি এবং ইসলামের প্রথম খলিফা। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে মহব্বতের স্ত্রী আয়েশা(রাযিঃ)-এর পিতা ছিলেন।

এছাড়া আবু বকর(রাযিঃ) মিরাজের ঘটনা শোনামাত্রই বিশ্বাস করেছিলেন বলে, তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় আবু বকর(রাযিঃ) বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাবুকের যুদ্ধে তিনি তার সমস্ত সম্পদ দান করে দেন।

৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্ট ৬১ বছর বয়সে তিনি মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। মসজিদে নববিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারকের পাশেই তার সমাধি।

উমর ইবনুল খাত্তাব(রাযিঃ)
উমর(রাযিঃ) ফারুক এবং খেলাফত লাভের পর আমিরুল মুমিনিন নামে পরিচিত ছিলেন। ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে, মক্কার কুরাইশ বংশের ‘বনু আদি’ গোত্রে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

উমর(রাযিঃ) ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৩৯ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি প্রধান সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম। আবু বকর(রাযিঃ)-এর ইনতেকালের পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন। ইসলামি আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন তিনি। ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা ‘বিশ্বাসীদের নেতা’ উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

উমর(রাযিঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পর, প্রকাশ্যে কাবার সামনে সালাত আদায় করাতে মুসলিমরা আর বাধার সম্মুখীন হননি। ইসলাম গ্রহণের পর গোপনীয়তা পরিহার করে, প্রকাশ্যে তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাইরে আসেন এবং কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। সেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘ফারুক’(সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়।

উমর(রাযিঃ) এমন ব্যক্তিত্ব যে, শয়তানও তাকে ভয় পেত। দ্বীনের বিষয়াবলিতে উমর(রাযিঃ) ছিলেন বেশ কঠোর। ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর মুসলিম জাহানের খলিফা থাকা অবস্থায় ঘাতকের আঘাতে তিনি ইনতিকাল করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজার পাশে তাকেও সমাহিত করা হয়।

উসমান ইবনে আফফান(রাযিঃ)
উসমান(রাযিঃ) যিননুরাইন (দুই নূরের অধিকারী), আল-গনি (উদার) এবং আমিরুল মু’মিনুন নামে পরিচিত ছিলেন। ৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। তিনি সেই ৬ জন সাহাবির মধ্যে অন্যতম, যাদের ওপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মুহূর্তের জন্যও অসন্তুষ্ট হননি। উসমান(রাযিঃ) ‘রুমা’ নামক কুপ খরিদ করে, মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন জিহাদে তিনিই সবচেয়ে বেশি দান করতেন। তিনি মসজিদে নববী পূনঃনির্মাণ ও প্রশস্ত করেছিলেন। ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ জুন ৭৯ বছর বয়সে তিনি কুচক্রীদের হাতে নিহত হন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।

আলী ইবনে আবু তালিব(রাযিঃ)
আলী(রাযিঃ) আবুল হাসান, আবু তুরাব, আসাদুল্লাহ নামে পরিচিতি ছিলেন। ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মক্কার বিখ্যাত ‘হাশেমি’ বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং সম্পর্কে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাত ভাই ছিলেন।

যুবকদের মধ্যে আলী(রাযিঃ) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। বদর যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘জুলফিকার’ নামক তরবারি উপহার দিয়েছিলেন।

খাইবারের সুরক্ষিত ‘কামুস দুর্গ’ জয় করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধি দেন। হজরত আলী(রাযিঃ) ছিলেন ইসলামের ৪র্থ খলিফা। বিচার-ফায়সালার ক্ষেত্রে আলী(রাযিঃ) ছিলেন সাহাবাদের মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। নবীজী তাঁকে ‘ইলমের দরজা’ বলেও অভিহিত করেছেন।

তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ(রাযিঃ)
তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ(রাযিঃ)-এর জন্ম ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায়। ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬২ বছর।

তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন ঘনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। উহুদ যুদ্ধে ও জামালের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। জঙ্গে জামালে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

যুবাইর ইবনুল আওয়াম(রাযিঃ)
যুবাইর ইবনুল আওয়াম(রাযিঃ)-এর উপাধি ছিল ‘রাসুলের হাওয়ারি(সঙ্গী)’। প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাওয়ারি ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও সাবধানতার কারণে খুব কমসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। দানশীলতা, উদারতা, আমানতদারিতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণে তিনি ছিলেন গুণান্বিত।

দুঃসাহসী একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলেন যুবাইর(রাযিঃ)। বদর যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। শত্রুপক্ষের কাছে ‘যুবাইর’ নামটাই ছিল মারাত্মক ত্রাস সৃষ্টিকারী। তিনি যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সে সব ক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।

যুবাইর(রাযিঃ)-এর শাহাদাতের সনটি ছিল ৩৬ হিজরী। শাহাদাতের পর তার লাশ ‘সিবা’ উপত্যকায় দাফন করা হয়।

আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রাযিঃ)
তার মূল নাম ছিল ‘আবদুল আমর’ বা ‘আবদুল কাবা’। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান’। আনুমানিক ৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।

আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রাযিঃ) ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ৮ জন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম।

আবদুর রহমান(রাযিঃ)-এর বিচক্ষণতার কারণে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা থেকে মুসলিম সমাজ রক্ষা পেয়েছে। যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। তিনি মদিনাবাসীর জন্য প্রচুর খরচ করতেন। অনেক ধনী ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দুনিয়া বিরাগী এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তি।

তিনি ৩৩ হিজরি মোতাবেক ৬৫৩-৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমান জর্ডানের আম্মানে তাকে দাফন করা হয়।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রাযিঃ)
সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রাযিঃ)-এর ডাকনাম আবু ইসহাক। আনুমানিক ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭তম ব্যক্তি।

৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য বিজয়ের নেতৃত্ব ও শাসনের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। ৬১৬ ও ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে তাকে কুটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীন পাঠানো হয়েছিল।

বদরের যুদ্ধে হজরত সা’দ(রাযিঃ) অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন। উহুদের যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও যে সমস্ত সৈনিক সাহাবা নবীজিকে হেফাজত করার জন্য তাকে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, নিজেদের জানকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, সা’দ(রাযিঃ) ছিলেন তাদেরই একজন। তাকে উহুদ যুদ্ধের বাঘও বলা হয়ে থাকে।

বিলাল(রাযিঃ)-এর অনুপস্থিতিতে তিনি ৩ বার আজান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি প্রথম সৌভাগ্যবান, যিনি আল্লাহর রাস্তায় তীর চালিয়েছেন। আনুমানিক ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ৮৫ বছর বয়সে মদিনা থেকে দশমাইল দূরবর্তী আকিক উপত্যকায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

সাঈদ ইবনে যায়িদ(রাযিঃ)
সাঈদ ইবনে যায়িদ(রাযিঃ)-এর ডাকনাম ‘আবুল আওয়ার’। ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ মতান্তরে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, সাঈদ ইবনে যায়িদ(রাযিঃ) তাদেরই একজন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি ছিলেন হানিফ অর্থাৎ তৎকালীন পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থাকা।

সাঈদ ইবনে যায়িদ(রাযিঃ) ছিলেন বীর মুজাহিদ। তিনি ছিলেন ‘মুসতাজাবুদ দা’ওয়াহ’ অর্থাৎ তিনি দোয়া করলে, মহান আল্লাহ্ অবশ্যই কবুলই করতেন। ৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে প্রায় ৮০ বছর বয়সে সৌদি আরবের মদিনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ(রাযিঃ)
আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ(রাযিঃ) তার বাবা আবদুল্লাহ’র নামে পরিচিত না হয়ে, দাদার নামে অর্থাৎ ইবনুল জাররাহ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাকে বলা হয় আমিনুল উম্মাহ বা উম্মাহর তত্ত্বাবধায়ক। আনুমানিক ৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় কুরাইশের বনু আল হারিস ইবনে ফিহর গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহাবীদের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাবান ছিলেন। উমর(রাযিঃ)-এর খেলাফতকালে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: