গণমুখী আইন ও প্রশিক্ষণ ছাড়া আধুনিক পুলিশ সম্ভব নয়

বাংলাদেশ পুলিশকে একটি জনবান্ধব, মানবিক ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কাঠামোগত ও সময়োপযোগী সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
শনিবার (৫ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এই অভিমত দেন।
মূল প্রবন্ধে অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি ড. মো. মতিয়ার রহমান বলেন, “পুলিশ বাহিনীর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—ঔপনিবেশিক আইন ও কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব, অতিরিক্ত কর্মচাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।”
তিনি আরও বলেন, “এক্ষেত্রে আধুনিক ও গণমুখী আইন প্রণয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও মনোভাব পরিবর্তন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি, যেখানে বিচারপতি, মানবাধিকারকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন।”
তিনি বলেন, “একটি মানবিক ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীই পারে একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে।”
প্রধান আলোচক মাহমুদুর রহমান (সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ) বলেন, “পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাদের যথাযথ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। আধুনিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। র্যাব থেকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার এবং পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আলাদা কমিটি গঠনের প্রয়োজন আছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন বলেন, “পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ের জন্য পুলিশের নিজস্ব আইন প্রয়োজন। তবে কোনো সরকারই পুলিশ কমিশন করতে চাইবে না। পুলিশকে সামরিক ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।”
খেলাফতে মজলিস বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ড. আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, “পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সংস্কার।”
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য জারিফ বহমান বলেন, “ঐকমত্য কমিশন থেকে পুলিশ সংস্কারকে বাদ দেওয়া জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে বেঈমানি।”
সাবেক বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, “বিগত সরকার আমলে পুলিশের ভূমিকার কারণে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এখন আর বিলম্ব নয়, পুলিশ সংস্কার অনিবার্য।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. কামরুল আহসান বলেন, “পুলিশে অনেক ভালো মানুষ থাকলেও ব্যবস্থার কারণে তারা সুযোগ পান না। পরিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে।”
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, “নিয়োগ ব্যবস্থায় সংস্কার দরকার। সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।”
বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল বলেন, “শেখ হাসিনা পুলিশকে গণশত্রুতে পরিণত করেছেন। ফিট লিস্টের মাধ্যমে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চালু করা দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, “ঔপনিবেশিক আইন বাতিল করে প্রশাসনিক সংস্কারসহ পুলিশ সংস্কার করতে হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, “পুলিশে নিয়োগ ও পদোন্নতি মেধার ভিত্তিতে হতে হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে ড. আকবর আলী বলেন, “১৮৬১ সালের পুলিশ আইনে শুধুই নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে, জনসম্পৃক্ততার কথা নেই। এখন সময় এসেছে পুলিশকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অধীনে এনে মানবিক ও গণমুখী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার। এর জন্য সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”