মুসলিম নারী চিকিৎসকেরা হারিয়ে গেলেন কেন

ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া মুসলিম নারী চিকিৎসকদের অনন্য অবদান আজও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থাকে অনুপ্রাণিত করে।
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছেন। নারীদের অবদান চিকিৎসা, নার্সিং, ওষুধ তৈরি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। এই ধারাবাহিক রচনার তৃতীয় ও শেষ পর্বে আলোচিত হয়েছে মধ্যযুগে মুসলিম নারী চিকিৎসকদের ভূমিকা, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে তাদের কাজের তুলনা এবং ইতিহাসে তাঁদের স্বীকৃতির সংকট।
কর্দোভার অলিগলিতে এক দৃশ্য
কর্দোভার এক সরু গলিতে এক নারী দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছেন। হাতে একটি কাঠের বাক্স, যার মধ্যে রয়েছে হাতে তৈরি মলম ও ঔষধি গাছ। তিনি একজন ধাত্রী, প্রখ্যাত চিকিৎসক আল-জাহরাভির কন্যা, যিনি প্রসূতি মায়েদের সেবা করছেন। তাঁর কাজ ছিল শুধু চিকিৎসা নয়, বরং সমাজে ভরসা ও মানবিকতার প্রতীক হয়ে ওঠা।
চিকিৎসা ইতিহাসে নারীদের ছাপ
রুফায়দা আল-আসলামিয়া (রা.)-এর মোবাইল হাসপাতাল ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবন। মদিনার মসজিদে নববিতে স্থাপিত এই তাঁবু স্বাস্থ্যসেবার মডেল হয়ে উঠেছিল। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারিতেও মসজিদগুলো চিকিৎসা ও টিকাকরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়—যা রুফায়দার ঐতিহাসিক মডেলেরই আধুনিক প্রতিচ্ছবি।
আব্বাসীয় যুগে শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের কন্যার মতো নারীরা হাসপাতালের নেতৃত্বে ছিলেন। আল-জাহরাভির “আত-তাসরিফ” গ্রন্থ গাইনোকোলজি ও প্রসূতিবিদ্যায় নারী চিকিৎসকদের জন্য শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ গ্রন্থ ইউরোপে অনূদিত হয়ে রেনেসাঁস যুগে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আন্দালুসের উম্ম হাসান বিনত কাজি তানজালি ১৪ শতকে চিকিৎসা শিক্ষা প্রসারে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এসব উদ্যোগই আধুনিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংযোগ
রুফায়দার মোবাইল হাসপাতালের ধারণা আজকের জরুরি মেডিকেল ইউনিট (EMUs)-এর সঙ্গে তুলনীয়। আধুনিক শল্যচিকিৎসা ও ফার্মাসিউটিক্যাল বিজ্ঞানেও মুসলিম নারী চিকিৎসকদের অবদান সুস্পষ্ট।
তুরস্কে শরফুদ্দিন সাবুনচুওগলুর চিকিৎসাগ্রন্থে বর্ণিত গাইনোকোলজিকাল অস্ত্রোপচার আধুনিক স্ত্রীরোগ চিকিৎসার সূচনা করেছে। ৭ম শতকে জয়নাব বিনতে বানি আওদের তৈরি চোখের মলম ছিল অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের প্রাথমিক রূপ।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান মুসলিম নারী চিকিৎসকদের স্মরণ ও সম্মান জানাচ্ছে। যেমন, বাহরাইনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস রুফায়দার নামে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ইরানে নার্স দিবস উদ্যাপিত হয় জয়নাব বিনত আলীর নামে।
ইতিহাসে স্বীকৃতির সংকট
যদিও আধুনিক যুগে নারী চিকিৎসকদের কাজ অনেক বেশি দৃশ্যমান, তবে মধ্যযুগীয় নারী চিকিৎসকদের অবদান প্রায়ই ইতিহাসে অবহেলিত রয়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল ১৮৪৯ সালে পশ্চিমে প্রথম নারী চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পান। অথচ তার বহু আগেই মুসলিম নারী চিকিৎসকেরা চিকিৎসাক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন—যেমন, কায়রোর আল-মানসুরি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের কন্যা।
ইবনে আবি উসাইবিয়া তাঁর প্রখ্যাত চিকিৎসক জীবনীগ্রন্থ উয়ুন আল-আনবা ফি তাবাকাত আল-আতিব্বা-তে মাত্র একজন নারী চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসে এই অনুপস্থিতির তিনটি বড় কারণ চিহ্নিত করা যায়:
-
লিখিত রেকর্ডের অভাব: অনেক নারী চিকিৎসক গ্রন্থ রচনার চেয়ে ব্যবহারিক কাজে মনোযোগ দিয়েছেন।
-
আরবি সূত্রের সীমাবদ্ধতা: নারীদের কাজ প্রধানত আরবি ভাষায় সংরক্ষিত, যা অনেকাংশেই অনুবাদ হয়নি।
-
পুরুষদের আধিপত্য: ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে পুরুষ চিকিৎসকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, ফলে নারীদের অবদান প্রান্তিক থেকে গেছে।
ভবিষ্যতের করণীয়
এই ইতিহাস পুনরুদ্ধারে আরবি উৎসে গবেষণা, অনুবাদ এবং আধুনিক শিক্ষায় এই নারীদের কাজ তুলে ধরা অপরিহার্য। ইতিহাসে তাঁদের স্থান নিশ্চিত করতে একাডেমিক ও সামাজিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
সূত্র: মুসলিম হেরিটেজ ডটকম, বিবিসি, দারুল কুতুব, ইসলামিক ইতিহাসগ্রন্থাবলি।