তওবা ও ইস্তিগফার, তওবা করার নিয়ম ও তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া
আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়েছেন এবং কিতাব দান করেছেন যেন মানুষ যেন ভালোমন্দ বুঝতে পারে। সওয়াবের কাজ থেকে গোনাহের কাজকে পৃথক করে নিতে পারে। সৎ পথে চলে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং অন্যায় পথ ত্যাগ করে পরকালের মুক্তি অর্জন করেতে পারে।
তাই যারা নবী-রাসুলগণ এবং আল্লাহর কিতাবসমুহের উপর ঈমানই রাখে না, তারা তো খোদাদ্রোহী। দ্বীন ও ঈমানের সঙ্গে তাদের কোনো সর্ম্পক নেই। সুতরাং যদি তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি পেতে চায়, দুনিয়ার শান্তি এবং আখেরাতের মুক্তি অর্জন করতে চায়, তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলগণ বিশেষত হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার আনীত শরীয়তের উপর ঈমান আনা তাদের প্রথম কর্তব্য। তা না হলে আল্লাহ পাকের সন্তুটি এবং আখেরাতের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করা ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ।
মোটকথা, কাফের-মুশরিকদের মুক্তির প্রথম শর্ত হলো কুফর শিরক ত্যাগ করে ঈমান ও তাওহীদকে জীবনের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে, দ্বীন ও শরীয়ত অনুযায়ী চলার অঙ্গীকার করেছে, তারা যদি শয়তানের ধোকায় কিংবা প্রবৃত্তির তাড়নায় গোনাহ করে বসে, তবে তাদের মুক্তির পথ হলো তওবা-এস্তেগফার।
তওবা অর্থ ফিরে আসা। এস্তেগফার অর্থ ক্ষমা চাওয়া। যখন কোনো গোনাহ হয়ে যায়, তখন আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া এবং আগামীতে সে গোনাহ না করার সংকল্প করে আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা চাওয়াকে তওবা ও এস্তেগফার বলে।
গোনাহ, তওবা এবং তওবাকারীর অবস্থা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। কেউ যদি কোনো মামুলি ক্ষোভ-দুঃখের কারণে বিষপান করে বসে আর বিষক্রিয়ার ফলে প্রচ- রকম ব্যথা-বেদনা আরম্ভ হয় এবং নাড়িভুড়ি কাটতে শুরু করে, তখন এই ব্যক্তি যেমন নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং চিকিৎসার জন্য ছটফট করতে থাকে, এমন বোকামি আর কখনো করবে না বলে পণ করে, একজন প্রকৃত তওবাকারীর অবস্থাও বিলকুল এমন হওয়া উচিৎ।
অর্থাৎ যদি কখনো গোনাহ হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলার আযাবের ভয়ে অন্তরে খুবই অনুশোচনা আসবে এবং সামনে যেন এই গোনাহের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে। আর আল্লাহ পাকের নিকট অশ্রু ঝরিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। কোনো বান্দা যদি অনুভবের এই স্তরে উঠতে পারে, তবে আল্লাহ পাক তার জন্য আপন রহমতের দরোজা উম্মুক্ত করে দেন।
যে বান্দা এমনভাবে তওবা করে, সে বান্দা গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ পাক ও পবিত্র হয়ে যায়। বরং আল্লাহ পাকের নিকট আগের চেও অধিক প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়। এমনকি যুগযুগ সাধনা করে যে স্তরে উন্নীত হওয়া কঠিন, তওবার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের কোনো কোনো বান্দা অতি সহজে সেই স্তরে পৌঁছে যায়। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট খাঁটিভাবে তওবা করো। খুব সম্ভব তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমুহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে স্থান দেবেন, যার পাদদেশে নহরমালা বহমান থাকবে। সূরা তাহরীম ৬৬/৮
অন্য আয়াতে বলেন,
أَفَلَا يَتُوبُونَ إِلَى اللَّهِ وَيَسْتَغْفِرُونَهُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
এরপরও কি তারা তওবা-এস্তেগফার করবে না? অথচ আল্লাহ পাক অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা মায়েদা ৫/৭৪
এক আয়াতে এসেছে,
وَإِذَا جَاءَكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِنَا فَقُلْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّهُ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَصْلَحَ فَأَنَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
যারা আমার আয়তসমুহ বিশ্বাস করে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তাদেরকে বলো, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের প্রতিপালক নিজের উপর রহমতের এই নীতি স্থির করেছেন যে, তোমাদের কেউ যদি অজ্ঞতাবশত কোনো গোনাহ করে ফেলে, অত:পর তওবা করে এবং আত্মসংশোধন করে, তবে তিনি হবেন তার প্রতি অতি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। সূরা আনআম ৬/৫৪
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাকের রহমতের কত বড় শান! তিনি আমাদের জন্য তওবার দরজা খুলে রেখে আমাদের ক্ষমা লাভের বিষয়টি সহজ করে দিয়েছেন। অন্যথায় আমাদের মতো গোন্হগারদের অবস্থা কী দাঁড়াতো! কোথায় আমাদের ঠিকানা হতো?
এক হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন, আল্লাহ পাক বলেন,
يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ
হে আমার বান্দা! তোমরা হয়তো দিনরাত গোনাহ করতে পারো, আর আমি পারি ক্ষমা করতে। সুতরাং আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিবো। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৭৭
অন্য হাদীসে এসেছে,
إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيْلِ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا
আল্লাহ পাক প্রতি রাতে রহমত ও মাগফেরাতের হাতছানি দিয়ে ডাকেন, যেন দিনের বেলার গোনাহগারেরা তওবা করতে পারে। তেমনি দিনের বেলা হাতছানি দেন যেন রাতের বেলার গোনাহগারেরা ক্ষমা চাইতে পারে। আর আল্লাহ পাকের রহমতের এই আচরণ অব্যহত থাকবে কেয়ামতের পূর্বে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৫৯
এক হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,
إِنَّ عَبْدًا أَصَابَ ذَنْبًا، وَرُبَّمَا قَالَ: أَذْنَبَ ذَنْبًا، فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ ذَنْبًا، وَرُبَّمَا قَالَ: أَصَبْتُ، فَاغْفِرْ، فَقَالَ رَبُّهُ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي، ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللهُ، ثُمَّ أَصَابَ ذَنْبًا، أَوْ: أَذْنَبَ ذَنْبًا، فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ، أَوْ أَصَبْتُ، آخَرَ، فَاغْفِرْهُ؟ فَقَالَ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي، ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللهُ، ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنْبًا، وَرُبَّمَا قَالَ: أَصَابَ ذَنْبًا، فَقَالَ: رَبِّ أَصَبْتُ، أَوْ: أَذْنَبْتُ، آخَرَ، فَاغْفِرْهُ لِي، فَقَالَ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثَلاَثًا، فَلْيَعْمَلْ مَا شَاءَ.
আল্লাহর এক বান্দা কোনো গোনাহ করে ফেললো। অতঃপর আল্লাহ পাকের নিকট কাতর কণ্ঠে বললো, হে আমার মাওলা! ও আমার মালিক! আমার তো গোনাহ হয়ে গেছে, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। তখন আল্লাহ পাক বলেন, আমার বান্দা তাহলে জানে, তার একজন রব আছে। তিনি গোনাহের কারণে ধরতে পারেন, মাফও করতে পারেন। আচ্ছা, আমি তাকে মাফ করে দিলাম। এরপর আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুসারে একটা সময় পর্যন্ত সে গোনাহ থেকে বিরত থাকে। তারপর আবার গোনাহ করে বসে এবং কাঁপা কন্ঠে মাফ চায়, হে আল্লাহ! আমি গোনাহ করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দাও। তখনও আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা জানে, তার কোনো মালিক আছে, তিনি ভুলের জন্য পাকড়াও করতে জানেন, ক্ষমাও কারতে পারেন। আমি আমার বান্দাকে বেকসুর খালাস করে দিলাম! অনন্তর একটি সময় পর্যন্ত সে ব্যক্তি গোনাহ থেকে বিরত থাকে। এরপর আবার কোনো সময় কোনো গোনাহ করে বসে এবং আল্লাহ নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! আমি তো আবার গোনাহ করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দাও। এবারও আল্লাহ বলেন, আমার বান্দার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তার কোনো প্রভূ আছে, যিনি গোনাহের কারনে শাস্তি দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। তাহলে ঠিক আছে, আমি তাকে মাফ করে দিলাম, সে যা ইচ্ছা যতটুকু ইচ্ছা করুক। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৭৫০৭
অন্য হাদীসে নবীজী বলেন,
التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ، كَمَنْ لاَ ذَنْبَ لَهُ.
তওবা করার দ্বারা একজন গোনাহগার ঐ ব্যক্তির মতো পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, যে ব্যক্তি কোনো গোনাই করেনি। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪২৫০
স্মর্তব্য: এই হাদীসগুলোতে আল্লাহ পাকের দয়া ও করুণা-গুণের আশাব্যঞ্জক উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এগুলো শুনে আল্লাহ পাকের ক্ষমাশীলতার বাহানা করা এবং গোনাহের বিষয়ে বেপরোয়া হয়ে যাওয়া কিছুতেই কাম্য নয়। মুমিন ব্যক্তি কখনো এমন বেশরম সুবিধাবাদী আচরণ করতে পারে না। এই হাদীসগুলি শোনার পর তো একজন মুমিনের অন্তরে আল্লাহ পাকের মুহাব্বত আরও বেশি উথলে উঠবে। কৃতজ্ঞতায় অন্তরাত্মা স্নাত হয়ে যাবে। দুনিয়াতে কোনো মালিকের দয়াদ্রতার সুযোগ নিয়ে চাকর যদি তার অবাধ্য হয়ে যায়, তবে এই অকৃতজ্ঞ আচরণের কোনো ব্যখ্যা থাকে না। এই চাকর দয়া লাভের অনুপযুক্ত এটা সবাই মানে। তেমনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ পাকের যারা নাফরমানি করে, তাদের মতো নিকৃষ্ট ও অকৃতজ্ঞ আর কেউ নেই।
উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসগুলির উদ্দেশ্য হলো, কারো যদি গোনাহ হয়ে যায়, তাহলে সে যেন নিরাশ না হয়, বরং আল্লাহ পাকের নিকট কান্নাকাটি করে তওবা করে। তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে গোনাহ থেকে পাক সাফ করে দেবেন। আল্লাহ পাক অসন্তুষ্ট হওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি আগের চেও বেশি সন্তুষ্ট হবেন। হাদীস শরীফে এসেছে,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ، مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً، فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا، قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا، قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ: اللهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ، أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
গোনাহ হয়ে যাওয়ার পর বান্দা যখন আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং খাঁটি দিলে তওবা করে, তখন আল্লাহ তার তওবার কারণে ঐ ব্যক্তির চেও বেশি খুশি হন, যে সাহারা মরুভূমির মধ্যখানে একমাত্র সওয়ারি উটটি হারিয়ে ফেলেছে। আর সেই সওয়ারির উপরই ছিলো তার খাদ্যপানীয়। এখন সে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ বৃক্ষতলে এলিয়ে দিয়েছে, হতাশ হয়ে মূত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হঠাৎ দেখে উটটি তার সামনে! অমনি লোকটি লাফিয়ে উঠে উটের লাগাম ধরে আর আনন্দের আতিশয্যে মুখে ফসকে বলে ফেলে, আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার মালিক। নবীজী বলেন এই ব্যক্তি অলৌকিকভাবে তার সওয়ারিটি পেয়ে যত খুশি হয়েছে, একজন গোনাহগার বান্দা তওবা করলে আল্লাহ পাক তার চেও বেশি খুশি হন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৪৭
এই হাদীস ও আয়াতসমুহ জানার পরও যারা গোনাহ থেকে তওবা করে আল্লাহ পাকের রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী হয় না, তাদের মতো দুর্ভাগা এবং পোড়া কপালে আর কে আছে!
অনেকে এই ধারণায় তওবা করতে বিলম্ভ করে যে, ‘এখানো তো সুস্থ-সবল আছি, মরণের আরও অনেক বাকি।’ ভাই আমার! এটা শয়তানের নিছক ধোকা, সে নিজে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে চিরতরে বিতাড়িত হয়েছে। এখন আমাদেরকেও তার সহগামী বানানোর অপচেষ্টায় আছে। মৃত্যু কবে আসবে তা কি আমরা জানি? আজকের দিনটিও তো আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারে! তাহলে কিসের ভরসায় আমি তওবা করতে বিলম্ব করছি? সুতরাং গোনাহ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তওবা করে নেয়াই বুদ্বিমানের কাজ। আল্লাহ পাক বলেন,
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا. وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
আল্লাহ পাক শুধু ঐ সমস্ত লোকের তওবা কবুল করার দায়িত্ব নিয়েছেন, যারা অজ্ঞতাবশত কোনো গোনাহ করে ফেললে জলদি জলদি তওবা করে নেয়। সুতরাং এমন লোকদেরকে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেন। আল্লাহপাক সর্ববিষয়ে জ্ঞাত এবং প্রজ্ঞাবান। কিন্তু ঐ সকল লোকের জন্য তওবা কবুলের ওয়াদা নেই, যারা অন্যায় করতেই থাকে, এমনকি যখন তাদের কারো নিকট মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয়ে যায়, তখন সে বলে ওঠে, এখন আমি তওবা করছি। আর যারা কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাদের জন্যও কোনো ওয়াদা নেই। এদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। সূরা নিসা ৪/১৭-১৮
সুতরাং জীবনের অবশিষ্ট মুহূর্তগুলেকো গনিমত মনে করে অনতিবিলম্বে তওবা করা এবং আত্মসংশোধন করে নেয়া উচিৎ। জানা তো নেই কখন মৃত্যুর ডাক এসে পড়বে।
আমার ভাই ও বোন!
আমি আপনি জীবনে কতজনকে মৃত্যু বরণ করতে দেখছি। আমাদের অভিজ্ঞতা তো বলে, যে যে-অবস্থায় জীবন কাটায়, সে অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। অর্থাৎ সাধারণত এমন হয় না যে, কেউ সারা জীবন গাফলতের ভিতর কাটাবে আর মৃত্যুর দু’একদিন আগে তওবা করে ওলী হয়ে যাবে! সুতরাং নেককার অবস্থায় মৃত্যু চাইলে নেক জীবন গড়ে তোলা উচিৎ এবং সময় থাকতেই তা করা উচিৎ। তাহলেই ভালো অবস্থায় মৃত্যু হওয়া আশা করা যায় এবং আমরা নেককারদের সঙ্গ পাওয়ার আরজু করতে পারি।
যদি কোনো গোনাহ থেকে তওবা করার পর সেই গোনাই আবার হয়ে যায়, তাহলেও আল্লাহ পাকের রহমত থেকে নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। বরং আবার তওবা করবে। এমনকি শতবার যদি একই গোনাহ হয়ে যায়, তবে শতবারই তওবা করবে। আল্লাহ পাক তওবা কবুল করার ওয়াদা করেছেন। তিনি পরম দয়ালু। আর জান্নাত অনেক অনেক বড়, অনেক প্রসস্ত। সুতরাং খাঁটি দিলে তওবা করে যাওয়া আমাদের কাজ। আমরা আদের কাজ করেই যাবো।
তওবা-এস্তেগফারের দুআ
এক.
তওবা এস্তেগফার যে কোনো ভাষায় যে কোনো শব্দে হতে পারে। তবে হাদীস শরীফেও তওবার কিছু দুআ বর্ণিত হয়েছে। সন্দেহ নেই এগুলি অনেক বরকতময় এবং আল্লাহ পাকের নিকট প্রিয়। এগুলো শিখে নেয়া উচিৎ। যেমন-
أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيَّ الْقَيُّومَ، وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি ঐ আল্লাহর কাছে যিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, স্বপ্রতিষ্ঠ বিশ্বনিয়ন্তা। আমি তার দিকে ফিরে আসছি। হাদীসে এসেছে,
যে ব্যক্তি এই কালিমা দ্বারা আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দেবেন। যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পালানোর মতো গোনাহ করে থাকে, যা আল্লাহ পাকের নিকট খুবই মারাত্মক গোনাহ হিসাবে চিহ্নিত। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫১৯
অন্য হাদীসে এসেছে,
যে ব্যক্তি শোয়ার সময় এই কালিমা দ্বারা তিনবার তওবা-এস্তেগফার করে, আল্লাহ পাক তার ছোট বড় সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন, যদিও তার গোনাহ সমুদ্রের ফেনার সমান হয়, সমস্ত বৃক্ষের পত্র-পল্লব সমপরিমাণ হয়, ঘন বালুর মিহি কণার সংখ্যায় হয় কিংবা পৃথিবী বয়সের সমান হয়। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৯৭ (এই হাদীসের সূত্র দুর্বল)
দুই.
নবীজী কখনো শুধু ‘আছতাগ ফিরুল্লাহ’ বলে এস্তেগফার করতেন। এটা সংক্ষিপ্ততম এস্তেগফার। চলতে ফিরতে এর মাধ্যমে এস্তেগফার পড়ার অভ্যাস করা যায়।
তিন.
হাদীসে এসেছে, নবীজী একটি এস্তেগফারকে ‘সাইয়িদুল এস্তেগফার তথা শ্রেষ্ট এস্তেগফার বলে মন্তব্য করেছেন। সেটি এই,
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
আয় আল্লাহ! তুমি তো আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কাউকে আমি ইবাদতের উপযুক্ত মানি না। আমি তোমারি হাতে বানানো গোলাম। তোমাকে যে ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যথাসম্ভব আমি তা পালানের চেষ্টা করছি। আর আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উপর কৃত তোমার অনুগ্রহের কথা আমি শতমুখে স্বীকার করছি এবং আজ আমার গোনাহগুলি নিয়ে তোমার দরবারে হাজির হয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি ছাড়া গোনাহ মাফ করার কেউ নেই।
হাদীস শরীফে এসেছে,
যে ব্যক্তি এই কালিমাগুলোর অর্থের প্রতি ধ্যান রেখে আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এর মাধ্যমে সকালে একবার এস্তেগফার করবে, রাত আসার আগে দিনে দিনে যদি সে মৃত্যু বরণ করে, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে সন্ধায় এই কালিমাগুলির মধ্যমে তওবা করবে, ভোরের আগে ঐ রাতে যদি সে মারা যায়, তবে সে জান্নাতী হবে। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৬৩০৬
উল্লিখিত তিনটি এস্তেগফার সবার মুখস্থ থাকা উচিৎ। হাদীসে এসেছে,
طُوبَى لِمَنْ وَجَدَ فِي صَحِيفَتِهِ اسْتِغْفَارًا كَثِيرًا.
যার আমলনামায় এস্তেগফার বেশি থাকবে তার জন্য সুংবাদ। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৮১৮
অন্য হাদীসে এসেছে,
مَنِ أكْثَرَ مِنَ الاسْتِغْفَارِ، جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا، وَمِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا، وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ. إسناده ضعيف
যে ব্যক্তি সবসময় এস্তেগফার করে অর্থাৎ বেশি বেশি আল্লাহ পাকের নিকট মাফ চাইতে থাকে, আল্লাহ তাআলা তার সকল মুশকিল আসান করে দেন, পেরেশানিগুলি দূর করে দেন এবং তাকে এমনভাবে রিযিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২২৩৪
সুবহানাআল্লাহ! আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বেশি বেশি তওবা-এস্তেগফার করার তাওফীক দান করুন, আমীন!
মুসলিম বাংলা