শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৬ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

আজ হিজরি নববর্ষ, খোশ আমদেদ ১৪৪৪

 আপডেট: ১২:১১, ৩১ জুলাই ২০২২

আজ হিজরি নববর্ষ, খোশ আমদেদ ১৪৪৪

আজ ইসলামিক বছরের প্রথম দিন। হিজরি ১৪৪৪ সনের প্রথম দিন। আরবী বছরের প্রথম মাস মুহররমের প্রথম দিন। মুসলমানদের নতুন বছর তাই আজ শুরু।

মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে হিজরি সনকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও এই অঞ্চলে হিজরি বছরের গণণা অধিকাংশ মানুষ জানে না। ইংরেজি সন দিয়েই কাজ চলে। তবে অনেকে বাংলা বছরের হিসেবও জানেন। এমন মুসলমান অধ্যুষিত দেখে মুসলমানদের সন হিজরির হিসেব বেশিরভাগ মানুষের জানা না থাকা আসলে দুঃখজনক।   

হিজরি বর্ষপঞ্জি (আরবি: ٱلتَّقْوِيم ٱلْهِجْرِيّ‎‎ আত-তাকউইম আল-হিজরি), যা চান্দ্র হিজরি বর্ষপঞ্জি ও (ইংরেজিতে) ইসলামি, মুসলিম বা আরবীয় বর্ষপঞ্জি নামেও পরিচিত, হল একটি চন্দ্র নির্ভর বর্ষপঞ্জি যার এক বছর ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন বিশিষ্ট ১২টি চান্দ্র মাস নিয়ে গঠিত। এই বর্ষপঞ্জি ইসলামি ছুটির দিন ও অনুষ্ঠানের সঠিক দিবস নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়, যেমন বার্ষিক রোজা রাখার সময়কাল ও হজ্জ করার সঠিক তারিখ। প্রায় সব মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো যেখানে সাধারণ বর্ষপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার হয়, অন্যদিকে পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও মেসোপটেমিয়ায় (ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ফিলিস্তিন) সিরীয় মাসের নাম সমেত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়।

ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে হিজরি সন ব্যবহার করা হয় যার আদর্শ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ইসলামি নববর্ষে নির্ধারিত হয়েছে। এই বছরে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তার সাহাবিরা মক্কা থেকে মদিনায় স্থানান্তরিত হয়ে প্রথম মুসলিম সম্প্রদায় (উম্মাহ) প্রতিষ্ঠা করেন, এই ঘটনাটিকে হিজরত নামে অভিহিত করা হয়। পশ্চিমে বিশ্বে এই সনের তারিখগুলোর পেছনে এএইচ (লাতিন: Anno Hegirae, "হিজরতের বছর") লেখা হয় যা খ্রিস্টীয় সাল (এডি), কমন এরা (সিই) এবং ইহুদি সাল (এএম) এগুলোর পশ্চিমা সংক্ষিপ্ত রূপের অনুরূপ। মুসলিম দেশগুলোতে একে কখনো ইংরেজিতে এইচ এর আরবি শব্দ (سَنَة هِجْرِيَّة থেকে, সংক্ষিপ্ত করে ھ) হিসেবে লেখা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে হিজরতের আগের বছরকে বিএইচ ("হিজরতের পূর্বে") হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

হিজরতের ১৭ বছর পরে, বসরার গভর্নর আবু মুসা আশয়ারী (রা.) পত্রযোগে খলিফা উমর (রা.) কে জানান “হে আমীরুল মুমিনীন, আমাদের কাছে বহু পত্র আসে, যাতে তারিখ লেখা থাকে, কিন্তু তাতে সাল লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন।"

অভিযোগটি পাওয়ার পর খলিফা নামভিত্তিক বছর গণনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে একটি নতুন সংখ্যাভিত্তিক বছর গণনা ব্যবস্থা প্রচলন করার পদক্ষেপ নেন। এক হাদিস অনুসারে উমর (রা.) পরামর্শ সভা আহবান করেন। সভায় সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুবরণের বছর, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রা.) নবুয়তের বছর এবং আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। অতঃপর সভার সকলে আলীর (রা.) প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন। উমর (রা.) নতুন পঞ্জিকা সালের প্রথম বর্ষ হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার ৭০ জন সাহাবির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছরকে গ্রহণ করেন। 

আরেক হাদিস অনুসারে উসমান (রা.) ও আলী (রা.) প্রচলিত মাসের ক্রম ঠিক রেখে পঞ্জিকা সাল অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন যা গৃহীত হয়। এরপর উমর (রা.) কর্তৃক এই পঞ্জিকা সাল ব্যবহার মুসলিম সাম্রাজ্যে বাধ্যতামূলক করা হয়।

ইসলামি দিন শুরু হয় সূর্যাস্তের সময়। মুসলিমরা ইয়োম আল-জুমাহ বা সমাবেশের দিনের দুপুরে মসজিদে প্রার্থনার জন্য জড়ো হয় যা দিনের চন্দ্র শুরুর সাথে মিলে যায় যা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, সূর্য সম্পূর্ণরূপে অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে ঘটে। এ দিন শুরু হয় মাগরিবের মাধ্যমে।

এইভাবে জুমার দিন প্রায়ই সাপ্তাহিক ছুটি হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি প্রায়শই সরকারি ছুটির দিন করা হয়েছে, অনেক মুসলিম দেশ শুক্রবার ও শনিবার (যেমন, মিশর, সৌদি আরব) বা বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারকে সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসাবে গ্রহণ করে এবং সেই সময়ে অফিস বন্ধ থাকে; অন্যান্য দেশ (যেমন ইরান) শুধুমাত্র শুক্রবারকে বিশ্রামের দিন হিসেবে বেছে নেয়। আরও কিছু দেশ (যেমন, তুরস্ক, পাকিস্তান, মরক্কো, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া) শনিবার-রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং শুক্রবারকে একটি দীর্ঘ মধ্যাহ্ন বিরতির সাথে উপাসনার জন্য ছুটি দেওয়ার জন্য একটি কার্যদিবস বানিয়েছে।

ক্রম    নাম    আরবি    অর্থ    গ্রেগরীয় সমতুল্য
১    আল-আহাদ    ٱلْأَحَد‎    প্রথম    রবিবার
২    আল-ইসনাইন    الاِثْنَيْن‎    দ্বিতীয়    সোমবার
৩    আস-সুলাসা    ٱلثُّلَاثَاء‎    তৃতীয়    মঙ্গলবার
৪    আল-আরবিয়া    ٱلْأَرْبِعَاء‎    চতুর্থ    বুধবার
৫    আল-খামিস    ٱلْخَمِيس‎    পঞ্চম    বৃহস্পতিবার
৬    আল-জুমাহ    ٱلْجُمْعَة‎    সমাবেশ    শুক্রবার
৭    আশ-সাবত    ٱلسَّبْت‎    বিশ্রাম    শনিবার


বারোটি হিজরি মাসের চারটিকে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়: রজব (৭ম), এবং তিন ক্রম মাস জিলক্বদ (১১তম), জিলহজ্জ (১২তম) ও মুহররম (১ম)। যেহেতু একটি ক্রান্তীয় বছরের গড় সময়কাল হল ৩৬৫.২৪২১৯ দিন, আবার অন্যদিকে একটি সিনোডিক মাসের দীর্ঘমেয়াদী গড় সময়কাল ২৯.৫৩০৫৮৭৯৮১ দিন তাই একটি গড় চন্দ্র বছর গড় সৌর বছর থেকে ১০.৮৭৫১৩ দিন (৩৬৫.২৪২১৯ - ১২ × ২৯.৫৩০৫৮৭৯৮১ ≈) ছোট হয়ে থাকে, যার ফলে প্রতি পঞ্জিকা বছরে হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলো গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির চেয়ে প্রায় এগারো দিন করে এগিয়ে যেতে থাকে। "ফলস্বরূপ, বারো চান্দ্র মাসের চক্রটি একই ঋতুতে ৩৩ (সৌর) বছরে প্রত্যাবর্তন করে।

নং    মাসের নাম    আরবি নাম    অর্থ    টীকা
১    মুহররম    محرّم    নিষিদ্ধ    এই মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ (হারাম) বিধায় এটি পবিত্র মাস বলে বিবেচিত। এ মাসের ১০ম দিনে আশুরা পালিত হয়।

২    সফর    صفر    রিক্ত, শূন্য, ভ্রমণ    এ মাসের এরূপ নামকরণের কারণ সম্ভবত এটি যে, প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবীয় ঘর-বাড়ি এই সময়ে শূন্য থাকতো যখন গৃহস্থরা খাবার সংগ্রহ করতো। অন্যমতে, তারা তাদের শত্রুদের যুদ্ধে পরাজিত করে সবকিছু লুট করে নিয়ে যেত বলে এ মাসের নাম সফর।
সফর শব্দের আরেকটি অর্থ হল ভ্রমণ। এ মর্মে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হলো,তৎকালীন আরবরা এ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বেশি ভ্রমণ করত বলে এ মাসের নাম রাখা হয়েছে সফর।


৩    রবিউল আউয়াল    ربيع الأولي    প্রথম বসন্ত    অন্য অর্থ চারণ, কেননা এই সময়ে গবাদি পশু চারণ করা হতো। মাসটি মুসলমানদের জন্য পবিত্র একটি মাস বলে বিবেচিত কারণ মুহাম্মাদ এই মাসে জন্মগ্রহণ করেন।

৪    রবিউস সানি    ربيع الاخري    দ্বিতীয় বসন্ত    

৫    জমাদিউল আউয়াল    جمادى الأولی    প্রথম শুকনো ভূমিখণ্ড    প্রাক-ইসলামিক গ্রীষ্মকাল হিসেবে বিবেচিত।

৬    জমাদিউস সানি    جمادي الآخر ي    দ্বিতীয় শুকনো ভূমিখণ্ড    

৭    রজব    رجب    শ্রদ্ধা, সম্মান    এটি আরবি বছরের দ্বিতীয় মাস যখন যুদ্ধ নিষিদ্ধ। 'রজব' শব্দের অন্য অর্থ 'সরিয়ে নেওয়া'। কেননা প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবরা এ মাসে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য বর্শার মাথা সরিয়ে রাখতো।

৮    শা'বান    شعبان    বিক্ষিপ্ত    এর নামকরণের সম্ভাব্য কারণ এ মাসের পানির অভাব। তৎকালীন আরবেরা এ মাসে পানির সন্ধানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। তাই এর নাম 'শাবান'। এর অন্য অর্থ দুইয়ের মাঝামাঝি, কেননা এটি রজব এবং রমজান মাসের মাঝখানে।

৯    রমজান    رمضان    দহন    দহন বলতে উপবাস বা রোজাকে বোঝানো হয়েছে, কেননা উপবাস বা রোজার মাধ্যমে ব্যক্তির পার্থিব লালসা দগ্ধ হয়। রমজান মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র মাস। মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এ মাসে পবিত্র কুরআন নাজিলের সূচনা হয়। এ মাসে মুসলমানদেরকে সুবহে সাদিক(শেষরাত) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাধ্যতামূলক রোজা রাখতে হয়।

১০    শাওয়াল    شوّال    উত্থিত    এ নামের কারণ এই সময়ে স্ত্রী-উট বাচ্চা প্রসব করে এবং লেজ উত্থিত করে।

১১    জ্বিলকদ    ذو القعدة    সাময়িক যুদ্ধবিরতির মাস    এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ, তবে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা বৈধ।

১২    জ্বিলহজ্জ    ذو الحجة    হজ্জের মাস    এই মাসে মুসলমানরা মক্কায় কাবার উদ্দেশ্যে হজ্জ করতে যায়। এ মাসের ৮, ৯ ও ১০ তারিখে হজ্জ হয়। ঈদুল আযহা এই মাসের ১০ তারিখে শুরু হয় এবং ১২ তারিখ সূর্যাস্তের সাথে সাথে শেষ হয়। এই মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ।

মন্তব্য করুন: