শুক্রবার ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ২৯ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম

 আপডেট: ২০:৫৮, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ. ১৯৩৮ ঈসাব্দে হবিগঞ্জ জেলাধীন কাটাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা-বাবা উভয়দিকেই তাঁর পরিবার ছিল ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভ্রান্ত। দ্বীনদারি ও পরহেজগারিতে খ্যাতনামা। পিতার নাম মৌলবী আব্দুন নূর রাহ.। সাদাসিধে নেককার বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। জীবনের দীর্ঘ সময় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

তাঁর রত্নগভার্ মা’ও ছিলেন ফিরিশতা-ছিফত নারী। নানা মাওলানা আসাদুল্লাহ রাহ. ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসেনানী। মামারাও ছিলেন তাঁদের পিতার যোগ্য উত্তরসূরি।

নানা-মামাদের ঐতিহ্য ও মীরাছের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.। দীর্ঘ বিরাশি-তিরাশি বছরের জীবনে তিনি দ্বীনী খেদমতে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার তুলনা একালে সত্যিই বিরল।

প্রবল সাহসিকতার সাথে সদাচঞ্চল ও দুর্বার গতির এ মানুষটি বিরামহীন পথচলার এক দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি টেনে বিগত ৫ জানুয়ারি ২০২০ ঈ. রবিবার আল্লাহ তাআলার হুকুমে এই দুনিয়া ত্যাগ করেন। তাঁকে বিদায় জানাতে এবং তাঁর জানাযায় শরিক হতে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে।

৬ জানুয়ারি সোমবার তাঁর প্রাণময়তার কেন্দ্র জামিয়া ইসলামিয়া উমেদনগর মাদরাসার জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে পূর্বনির্ধারিত নিজস্ব মালিকানাধীন এক টুকরো জমিতে তাঁকে দাফন করা হয়। যা দীর্ঘকাল থেকে তাঁর ব্যবহৃত কামরার ঠিক সামনেই অবস্থিত।

এ কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব ছিলেন কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে দিয়েছিলেন দুহাত খুলে। জন্ম ও তরবিয়ত পেয়েছেন একটি আলোকিত পরিবারে। শিক্ষা-জীবনে প্রখর মেধা ও বিপুল সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। ইলম ও জ্ঞানার্জনে নিজেকে ফানা ও বিলীন করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইলম অর্জনের জন্য উসতাযদের সাহচর্য লাভের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে। তাঁর যুগে তিনি কালের শীর্ষ আকাবির উলামায়ে কেরামের সাহচর্য ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

শিক্ষকতার জীবনটা যেন ছিল আরো বেশি আলোকিত। একাধারে প্রায় ৫৫ বছর সহীহুল বুখারী পড়ানোর সৌভাগ্য কজনের হয়! ইনতিকালের দিনেও রুগ্ণ শরীরে বুখারী শরীফের সকালের দরস সম্পন্ন করেই তবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। মাঝের পুরো সময়টা ছিল বর্ণাঢ্য ইতিহাস।

কুরআনুল কারীমের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কুরআন পড়া ও পড়ানো এবং সাধারণ মানুষের জন্য দরসে কুরআনের সাথে তাঁর জীবনের বড় একটি অংশ জড়িত। কুরআনের বহুমাত্রিক খেদমতেও তাঁর অবদান অনেক।

বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর দেশ শিরক-বিদআত ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তখনকার কঠিন সঙ্কটকালে দেশের যে মুষ্টিমেয় আলেম ওয়াজ ও ইরশাদের মাধ্যমে মূর্খতার অন্ধকার ছিন্ন করে হকের আলো প্রজ্বালিত করার জন্য দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনিও শামিল হন তাঁদের মিছিলে। তাঁর এ সফরে ক্ষান্তি ছিল না। ক্লান্ত-শ্রান্ত এ মুসাফির মৃত্যু পর্যন্তই এ পথের সফল অভিযাত্রী ছিলেন।

সব ধরনের বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন বলিষ্ঠ নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে ইলম ও প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও দূরদর্শিতা দৃশ্যমান ছিল তার মধ্যে সবসময়।

জীবনের বড় একটি অধ্যায় ছিল, সালিহীনের সোহবত। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনে দেশ-বিদেশের বড় বড় আকাবির বুযুর্গদের একটি বড় জামাতের সাহচর্য গ্রহণ করার সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন। ফলে তাআল্লুক মাআল্লাহ্র ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আকাবিরের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সাথে নিজেকে লুকিয়ে রাখার যে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আকাবিরে দেওবন্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হতো, তাও তিনি রপ্ত করতে পেরেছিলেন। তাই শুধু নিকটজনেরাই জানেন আল্লাহ্র সামনে তাঁর আত্মসমর্পণের ধরন, রাতজাগা, রোনাযারী ও মুজাহাদার কথা। রবের সামনে নিজেকে পেশ করার যে মনোজ্ঞ পথ ও পদ্ধতি তিনি অর্জন করেছিলেন, বস্তুত তাই ছিল তাঁর জীবনের সফলতার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।

মোটকথা, তাঁর জীবন ছিল নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বহুমুখী প্রতিভায় মুখর এবং দ্বীনী ইলম ও দাওয়াতের বিভিন্ন ময়দানে যার পদচারণা, এমন ব্যক্তির জীবনের কোন্ দিক নিয়ে আলোচনা করব আর কী বাদ দিব, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর অবশেষে ঠিক করলাম, তাঁর মধ্যে বিদ্যমান আকাবির ও আসলাফের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমানে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সে ধরনের কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

(এক) দ্বীনী ইলমের কথা

মাওলানা তাফাজ্জুল হক (রাহ.)-কে মানুষ হবিগঞ্জের মুহাদ্দিস সাহেব নামেই চিনত। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি পুরো সিলেট জুড়ে অল্প ক’জন আলেমকে, বিশেষভাবে দু’জনকে ‘মুহাদ্দিস সাহেব’ নামে ডাকা হত। একজন গওহরপুরের হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন রাহ. আর অপরজন হবিগঞ্জের মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.। তখনকার সময়ে এটি ছিল হক্কানী আলেমদের কাছে প্রচলিত সবোর্চ্চ উপাধিগুলোর একটি।

উচ্চস্তরের আলেম থেকে অতি সাধারণ লোক সবার কাছেই তিনি ‘মুহাদ্দিস’ হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন। আমরাও তাই জানতাম। কিন্ত যখন থেকে আমার বোঝার শক্তি বেড়েছে, তখন থেকেই লক্ষ্য করেছি, তিনি শুধু মুহাদ্দিস নন, বরং ইসলামের জ্ঞানভাণ্ডারের মৌলিক শাখাগুলোর প্রত্যেকটিতেই যে আসন দখল করে আছেন, তা এ কালে বিরলই বটে। হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, সীরাত ও ইতিহাস, বিশেষত উলামায়ে সালাফের ইতিহাসÑ প্রায় সব বিষয়েই তাঁর পাঠের বিপুলতা, জ্ঞানের প্রাচুর্য ও যে কোনো বিষয় গভীর থেকে বোঝার দক্ষতা আমাদের মত তালিবে ইলমদের জন্য বিস্ময়কর ছিল। বিশেষ করে একবিংশ শতকের সূচনাকালে আমাদের মত যারা কিতাব-পত্র ও ইলমের উপকরণের প্রাচুর্য দেখে প্রতারিত, তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে, প্রায় শত বছর আগে কিতাব-পত্র ও উপায়-উপকরণের সঙ্কটকালে বাংলাদেশে এমন লোক তৈরি হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর আগে রচিত তাঁর ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ গ্রন্থটির তাহকীক ও প্রস্তুত করার সময় আমি নিজেও একথাগুলো অনুভব করে কখনো বিস্মিত আবার কখনো পুলকিত হয়েছি। তাঁর ইলমের ব্যাপ্তি ও গভীরতার দৃষ্টান্ত দেওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবে কীভাবে তিনি এ উচ্চতায় পৌঁছলেন, এর কিছু দিক এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

(ক) ইলমের জন্য ত্যাগ ও অধ্যবসায়

বুদ্ধিমত্তা, মেধা ও স্মৃতিশক্তিতে তিনি ছিলেন প্রবাদতুল্য। মুহূর্তেই যে কোনো কিছুর গভীরে পৌঁছে যাওয়া, বহুকাল আগের দেখা যে কাউকে এক নজর দেখেই তাঁর নাম-পরিচয় ঠিকানাসহ বলে দেওয়া এবং অশীতিপর বয়সেও শৈশবের ঘটে যাওয়া গল্প অবলীলায় বলতে পারা ছিল তার জন্য অতি স্বাভাবিক।

ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর মেধার বিকাশ শুরু হয়। সঙ্গে ছিল নিরলস অধ্যবসায় ও অসম্ভব মেহনত। মেধা ও মেহনতের অসাধারণ সমন্বয়ে তাঁর জন্য ইলমের দ্বারগুলো একে একে অবারিত হতে থাকে। সাথে যুক্ত হয় সফর। ইলম অর্জনের জন্য কৈশোরেই চলে যান চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায়। তারপর পাকিস্তানের লাহোর ও করাচি। অতঃপর ভারতের সাহারানপুর ও দেওবন্দ। এককথায় তাঁর কালে ইলমের সেরা কেন্দ্রগুলোর কোনোটিই বাদ যায়নি। 

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা ও মেহনতের অনেক গল্প আমরা তাঁর সাথী-সঙ্গীদের মুখে শুনে আসছি। এমন অনেক কথাও শুনেছি, যা স্বাভাবিকভাবে অবিশ্বাস্য মনে হত।

তাঁর উস্তায হাটহাজারী মাদরাসার মরহুম মুহতামিম হযরত মাওলানা আহমদ শফী রাহ. একদিন বলেন, ‘আমি হলফ করে বলতে পারব, মাওলানা তাফাজ্জুল হক এক দিনে যত মেহনত করেছেন, আপনারা এক বছরেও তা পারবেন না’। [মাওলানা যাকওয়ান]

মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-এর কাছ থেকেই শোনা, দারুল উলূম দেওবন্দে অবস্থানকালে তিনি বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্রায়শই রাতের বেলা সেখানকার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে থেকে যেতেন। রাতভর অধ্যয়ন করতেন। তখনই তিনি তাঁর ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ গ্রন্থটির সংকলন পূর্ণ করেন। যার সূচনা করেছিলেন করাচিতে হযরত বানূরী রাহ.-এর দিকনির্দেশনায়।

হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি সব পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকার করতেন। সেকালের প্রচলিত নিয়মে অসাধারণ কৃতিত্বের নিদর্শন-স্বরূপ অনেক সময়ই এক পত্রে ৫০ নম্বরের মধ্যে ৫৪/৫৫ নম্বরও পেয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি, ‘তিনি হেদায়া কিতাবের পরীক্ষায় ৫০-এর মধ্যে ৪৭ নম্বর পাওয়ার কারণে আবার হেদায়া পড়েন এবং পরবর্তী বছর পরীক্ষায় ৫০-এর মধ্যে ৫৪ নম্বর পান।

ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনার যে গতি ও ধারা রপ্ত করেছিলেন, তাতে আর কোনো বিরতি ছিল না। পড়াশোনার এ ধারা মওত পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। পাহাড়সম দায়িত্ব ও হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সামান্য ফুরসত পেলেই কিতাব হাতে বসে পড়তেন। প্রায় ১৯ বছর আগের কথা। একদিন তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন তাঁর ভায়রা ও দ্বীনী কাজের ঘনিষ্ঠ সহচর, আমার আব্বাকে দেখতে। আব্বার কামরাতেই শোকেসের উপর আমার একটি কিতাব ‘মু‘জামুন্ নাহ্বি ওয়াস-সারফ’ রাখা ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে শোকেসের উপরে রেখেই কিতাবটা দেখা শুরু করলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আগা-গোড়া পুরো কিতাবটিই প্রায় দেখে ফেললেন। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলাম আর দেখতে থাকলাম, এভাবেই বুঝি মানুষ মনীষীতে রূপান্তরিত হয়। সম্ভবত সেদিনই আমি বিষয়টি কোনো একটি ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম।

২০০৭ সনে একবার মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার তত্ত্বাবধানে দেশের বড় বড় মাদরাসায় শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ সম্পাদিত ২৬ খণ্ডের ‘মুছান্নাফে ইবনে আবি শাইবা’ কিতাবটি বিতরণ করা হয়। ২৬খণ্ডের এ বিশাল কিতাবের সাথে একটি খণ্ডে রয়েছে, শায়েখ রচিত কালের গর্ব ও যুগান্তকারী গ্রন্থদ্বয় ‘আসারুল হাদীসিশ শরীফ’ ও ‘আদাবুল ইখতিলাফ’। এর কিছুদিন পর একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সিলেটের অনেকগুলো মাদরাসায় আমার সফর করার সুযোগ হয়। সে সুবাদে তখন আমি সব মাদরাসার লাইব্রেরিগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমার একরকম ধারণা ছিলÑ ২৬ খণ্ডের এ মহামূল্যবান গ্রন্থের সাথে থাকা মনি-মুক্তা জোড়ার খোঁজ হয়ত অনেকেই পাবে না। নজরে পড়লেও কেউ হয়ত এর বিশেষ গুরুত্ব দেবে না।

কিন্তু বিশেষভাবে দুজন ব্যক্তি আমাকে থমকে দিয়েছিলেন। একজন মাওলানা আব্দুল আজীজ দয়ামিরী রাহ.। সিলেট শহরের দারুস সালাম খাসদবীর মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম ছিলেন। অত্যন্ত জ্ঞান-পিপাসু ও নিভৃতচারী মুহাক্কিক আলেম ছিলেন। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। শেষ অবস্থায় এসে দেখেছি, তাঁর টেবিল অনেক কিতাবপত্রে ঠাসা। সামনেই আছে ‘মুছান্নাফের’ সাথে যুক্ত সেই খণ্ডটি। তিনি যতটুকু পড়েছেন চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন। হযরাতুল উসতায মাওলানা আবদুল মালেক হাফিযাহুল্লাহু তাআলার ‘আলমাদখাল’ কিতাবটিও পাশেই রাখা ছিল। তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। এক সাক্ষাতেই তাঁর প্রতি আমার যে দুর্বার আকর্ষণ ও ভালবাসা তৈরি হয়েছিল তা নাড়ির টানের চেয়ে বেশি অনুভূত হত। আফসোস তাঁকে আর দেখতে পারিনি।

অপরজন ছিলেন, মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.। তাকেও দেখলাম, বিশেষ খণ্ডটি ঠিকই তিনি বের করে এনে পড়তে শুরু করেছেন।

এভাবেই সারাটা জীবন তাঁর পাঠাভ্যাস ছিল ব্যাপক। বলা যায় ‘মিনাল মাহদি ইলাল লাহদ’Ñ দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানান্বেষণÑ কথাটি তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

(খ) উসতায ও উসতাযের প্রতি ভালবাসা

উসতাযগণই ছিলেন তাঁর ভাগ্যাকাশের উজ্জ¦ল নক্ষত্র। আমার জানামতে তাঁর কালে তিনি ছিলেন সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের অন্যতম, যারা সময়ের শীর্ষ আকাবির মনীষীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পেরেছেন। বরং আরো স্পষ্ট করে বললে ১৯৪৭ সনে ভারতভাগের পর বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই তিন দেশের শীর্ষ ও বরেণ্য আকাবির উলামার সামনে ছাত্ররূপে বসার সৌভাগ্য যাদের লাভ হয়েছে, তিনি ছিলেন তাদের শীর্ষে।

হবিগঞ্জের শীর্ষ আলেমদের পর হাটহাজারী মাদরাসায় তার উসতায ছিলেন- মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ., শাহ আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহ., মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম রাহ. ও মাওলানা আবুল হাসান রাহ. প্রমুখ। যারা তখন ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম।

পাকিস্তানে তখন ইলমের নগরী ছিল লাহোর ও করাচি। জামিআ আশরাফিয়া লাহোরে তাঁর উসতায ছিলেন, শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর শিষ্য আল্লামা রাসূল খান রাহ., আল্লামা কাশ্মিরী রাহ.-এর বিশিষ্ট শিষ্য, দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক শাইখুত তাফসীর মাওলানা ইদরীস কান্দলভী ও মাওলানা মুহাম্মাদ হাসান আি¤্রতসারী রাহ. প্রমুখ। করাচিতে মুহাদ্দিসুল আসর মাওলানা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর সোহবত লাভ করেন। মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর থেকেও খুসুসী ইসতিফাদা করেন। খানপুরে হাফিজুল হাদীস নামে খ্যাত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সভাপতি আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রাহ.-এর কাছে তাফসীরের দরস গ্রহণ করেন।

ভারতের সাহারানপুরে ‘হায়াতুস সাহাবা’ রচয়িতা হযরতজী মাওলানা ইউসুফ রাহ.-এর সোহবত ও শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রাহ.-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অবশেষে দারুল উলূম দেওবন্দে তৎকালীন সদরুল মুদাররিসীন ও শাইখুল হাদীস মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী ও আল্লামা ইবরাহীম বালয়াবী এবং কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখের সামনে ছাত্র হিসেবে বসার সুযোগ গ্রহণ করেন। দেওবন্দে অবস্থানকালীন দীর্ঘ সময় ফেদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানী রাহ.-এর বিশেষ সোহবত লাভ করেন।

পরবতীর্ কর্মজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য আকাবির উলামায়ে কেরাম থেকেও ইস্তিফাদা ও ইস্তিফাযা অব্যাহত রাখেন। তাঁদের মধ্যে বিবাড়িয়ার ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম ও কানাইঘাটের মাওলানা মুশাহিদ বায়ামপুরী রাহ., ময়মনসিংহের মাওলানা আরীফ রাব্বানী রাহ. এবং শায়খে বরুণী, শায়খে কৌড়িয়া, শায়খে কাতিয়া ও সিলেটের অন্যান্য আকাবির বুযুর্গানেদ্বীনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কী বিরাট সৌভাগ্য। বাংলার এক অজপাড়াগাঁয়ের সন্তান। কিন্তু পড়েছেন শাইখুল হিন্দ, আশরাফ আলী থানবী, আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, হুসাইন আহমদ মাদানী, খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহিমাহুমুল্লাহসহ বিশ্বসেরা মনীষীদের বাছাই করা সব ছাত্রদের কাছে। আবার শুধুই কি পড়েছেন? বরং তাঁদের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করেছেন এবং তাঁদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

উসতাযের সামনে ও উসতাযের জন্য নিজেকে মিটিয়ে দেওয়ার প্রাবল্য বুড়ো বয়সেও আমরা তাঁর মধ্যে দেখেছি। দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ও শীর্ষ মুরুব্বী হযরত মাওলানা আহমদ শফী রাহ. ছিলেন তাঁর জন্য তখনকার সময়ে নবীন উস্তায। বুড়ো বয়সেও তাঁর এ উস্তাযের প্রতি সামনে পিছনে সমানভাবে যে ব্যাকুলতা তিনি রাখতেন, সত্যিই তা ছিল দেখা ও উপলব্ধি করার মত বিষয়।

ইলমের জন্য নিজেকে বিলীন করে দেওয়া এবং খুলুছ ও মহব্বতের কারণে তিনি সবসময়ই তাঁর উসতাযদের প্রিয়পাত্র হয়ে ছিলেন। উসতাযের মন জয় করা ও হৃদয়ে আসন পোক্ত করে নেওয়ার মত সব গুণই তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এতদসংক্রান্ত অনেক গল্প শুনে আমরা বিমোহিত হতাম। এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

১. মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ.। তৎকালীন আলেমকুলের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। ইতিমধ্যে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় স্বাভাবিক নিয়মের পাঠদান প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবুও মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. তাঁর সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং হৃদয়ে জায়গা করে নেন। সেই সুবাদেই তিনি মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-কে ছাত্রাবস্থায় কুরআনুল কারীম হিফজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। ব্যতিক্রম হিসেবে ছাত্রাবস্থায়ই তাকে বায়আত করেন। তাঁর রচিত কিতাবে ‘তাকরীজ’ তথা প্রশংসাবাক্য লিখে দেন। তিনি তাকে দিয়ে প্রশিক্ষণমূলক ফাতাওয়া লেখাতেন এবং তাতে দস্তখতও করতেন। এমনকি তাঁর বিশেষ সুপারিশেই মাওলানা তাফাজ্জুল হক ও মুফতী আব্দুল হান্নান রাহ.-কে হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরা-মিশকাত একসাথে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। শুধু মিশকাত ছাড়া এ জামাতের অন্য প্রায় সব কিতাবই তাদের পড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই তাদের উপর অত্যধিক আস্থা থাকার কারণে এবং হযরত মুফতী সাহেবের বিশেষ সুপারিশে দুজনকেই দাওরায়ে হাদীসের সাথেই মিশকাত কিতাবের দরসেও অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাঁর অনুরোধেই হযরত মুফতী সাহেব তাঁদেরকে পূর্ণ কুতুবে সিত্তাহ পড়ে বিশেষ ‘ইজাযত’ গ্রহণের সুযোগ দেন। ফলে সপ্তাহে এক দিন করে তাঁরা হযরতের বাড়িতে গিয়ে কুতুবে সিত্তাহ পড়ে ‘ইজাযত’ লাভ করেন। এ বিশেষ দরসে হাটহাজারী মাদরাসার অনেক উস্তাযও শরীক ছিলেন।

২. মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ.। দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুত তাফসীর ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের শীর্ষ আলেম ও জামেয়া আশরাফিয়া লাহোরের শাইখুল হাদীস। আকাবিরে দেওবন্দের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শিক্ষকতা ও রচনা-সংকলনের ক্ষেত্রে মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর অন্যতম উপযুক্ত ওয়ারিস। তাঁর কাছে মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরে বুখারী শরীফ পড়েন। শুরু থেকেই হযরতের দরসে বুখারী শরীফের ইবারত পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেন এবং হযরতের প্রিয়ভাজন হয়ে যান। মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-এর পুরো জীবনেই তাঁর এ উস্তাযের একটি প্রতিচ্ছবি দীপ্তিমান ছিল। মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হযরতের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয়তম ছাত্রের আসনটি পাকাপোক্ত করে নেন।

জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরের বর্তমান মুহতামিম, তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বয়োবৃদ্ধ আলেম মাওলানা ফজলুর রহীম সাহেবের মুখে আমি নিজেই শুনেছি, তিনি বলেছেন, একবার মাওলানা হবিগঞ্জী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফলে বুখারীর দরসে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। হযরত কান্ধলবী রাহ. যখন দরসে এসে দেখেন হযরত মাওলানা নেই তখন তার জন্য পরবর্তী দু’দিন দরস স্থগিত রাখেন। তিনি সুস্থ হয়ে আসলে তবেই আবার হযরত পড়াতে আসেন। একদিনের ছুটে যাওয়া অংশটি হযরত মাওলানাকে আবার পড়িয়ে দেন। একজন মাত্র ছাত্রের অসুস্থতার জন্য এত বড় প্রতিষ্ঠানের বুখারী শরীফের দরস স্থগিত রাখা এবং পরে একাকী তাঁকে পড়িয়ে দেওয়া সত্যিই অস্বাভাবিক। আবার হযরত কান্ধলবীর দরস।

পাকিস্তান থেকে দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করার সময় আবার যখন তিনি হযরত কান্ধলবী রাহ.-এর সাক্ষাতে এলেন তখন হযরত তাঁকে অনেক কিতাব হাদিয়া দেন এবং অনেক দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে দেন। তখনি তিনি তাকে তের ভলিউমের এক সেট ‘ফাতহুল বারী’ [বুখারী শরীফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা গ্রন্থ] হাদিয়া দিয়ে বললেন, যদি কখনো বুখারী শরীফ পড়াও তাহলে কিতাবটি দেখে নিয়ো।

৩. হযরত মাওলানা ইউসূফ বানূরী রাহ.। জামে তিরমিযীর বিশ্ববিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মাআরিফুস সুনানের’ লেখক। বিশ্ববরেণ্য আলেম আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী। মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. লাহোরে দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীস পড়ার পর করাচিতে হযরত বানূরির কাছে যান। প্রথম সাক্ষাতেই হযরত বানূরী রাহ.-এর নিকটতর ছাত্রের অবস্থানে পৌঁছে যান। হযরত রেজিস্ট্রি খাতায় তাঁদের কজনের নাম উস্তাযদের নামের সাথে যোগ করেন এবং উস্তাযগণের মত মাসিক ভাতাও ঠিক করে দেন। তখনি হযরত বানূরী রাহ.-এর মাআরিফুস সুনানের কিছু অংশের প্রম্নফ দেখারও সুযোগ লাভ করেন। হযরত তাঁর ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ গ্রন্থের খসড়া দেখে সুপরামর্শ দেন এবং এটি পূর্ণ করার তাকিদ করেন। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই হযরতের এত কাছে পেঁৗছে যান, যাতে কিছু লোকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে তাঁর এখানে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। আবার হযরত বানূরী তাঁকে চলে আসার অনুমতিও দিচ্ছেন না। অবশেষে হযরত মাওলানার আব্বা মরহুম আব্দুন নূর রাহ. পত্রের মাধ্যমে হযরত বানূরীর কাছ থেকে তাঁর জন্য বিদায় চাইলে হযরত খুশি মনে বিদায় দেন।

৪. ফিদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানী রাহ.। শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর বংশীয় ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। মুসলিম বিশ্বের এবং বিশেষত ভারতের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা। সাহারানপুরে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর খেদমতে থাকাকালেই হযরত ফেদায়ে মিল্লাত রাহ.-এর সাথে তার সাক্ষাৎ লাভ হয়। প্রথম মোলাকাতেই তিনি ফেদায়ে মিল্লাতের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন। হযরত ফেদায়ে মিল্লাত তাঁকে দেওবন্দে মাদানী মঞ্জিলের মেহমান হিসেবে থাকার দাওয়াত দেন। তিনি যখন দেওবন্দে আসেন তখন সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই ফেদায়ে মিল্লাতের দাওয়াতে মাদানী মঞ্জিলেই থাকা শুরু করেন।

হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী রাহ.-কে তিনি পাননি। তিনি দেওবন্দ যাওয়ার কয়েক বছর আগেই হযরত ইনতিকাল করেছেন। কিন্তু হযরত ফেদায়ে মিল্লাত ও মাদানী পরিবারের যে আতিথেয়তা ও নৈকট্য তিনি দেওবন্দে থাকাকালীন পেয়েছেন তা ছিল তাঁর জন্য অনেক বড় পাওয়া। কারণ হযরত শাইখুল ইসলামের সাথে তাঁর নিসবত ছিল, নানা-মামা, তাঁর উস্তায এবং সিলেটি হওয়ার সুবাদে এতদঞ্চলের সকল আলেম-উলামার মাধ্যমে, পরবতীর্তে তাঁর শায়েখ ও তাঁর শ্বশুরের মাধ্যমে এ নিসবত আরো গভীর হয়। হযরত শাইখুল ইসলাম ছিলেন তাদের সকলের প্রাণের স্পন্দন। ফলে ফেদায়ে মিল্লাতের এ ভালবাসা এবং মাদানী মঞ্জিলে থাকতে পারাটা তাঁর জন্য ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিগুলোর একটি।

ফেদায়ে মিল্লাতের এ ভালবাসা এবং হযরতের প্রতিও মাওলানা তাফাজ্জুল হকে সাহেবের প্রবল আকর্ষণ এখান থেকে শুরু। যা আমৃত্যু অপরিবর্তিত ছিল; বরং দিনেদিনে তা বেড়েছে বৈ কমেনি। আমরা সারা জীবন দেখেছি, হযরত ফেদায়ে মিল্লাত বাংলাদেশে এলে তাঁর এখানে আসতেন এবং তাঁর ঘরে মেহমান হতেন। তিনি হযরতের মেহমানদারি করে পরম তৃপ্তি অনুভব করতেন। অপরদিকে হযরত ফেদায়ে মিল্লাতও হযরত মাওলানাকে অসম্ভব মহব্বত ও কদর করতেন।

(গ) শিক্ষকতাই নেশাশিক্ষকতাই জীবন

কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমানভাবে কর্মতৎপর, দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টা দেখলেই মনে হত তাকে বুঝি এ কাজের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশেষ করে দ্বীনী ইলমের খেদমত তথা শিক্ষকতা ও শিক্ষা বিস্তারে জীবনভর তাঁর নিমগ্নতা ছিল সবচেয়ে বেশি।

১৯৬৩ সনের শেষের দিকে তিনি দেশে ফেরেন। তখনই কুমিল্লার বিখ্যাত বড়–রা মাদরাসায় উচ্চস্তরের উস্তায হিসেবে নিয়োগ পান। প্রথম বছর থেকে অত্যন্ত সুনামের সাথে জামে তিরমিযীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দরস দিতে শুরু করেন। এ সময়ে তিনি দরসে ও দরসের বাইরে অনেক কিতাব পড়াতেন। আশপাশের মাদরাসা থেকেও অনেক ছাত্র তাঁর কাছে পড়তে আসত। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও সকলের আস্থাভাজন দরদী মুরব্বী মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ. তাঁর তখনকার ছাত্র।

হাটহাজারী মাদরাসার তখনকার মুহতামিম, তাঁর উস্তায মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রাহ.-এর আদেশে ১৯৬৬ সনের শেষের দিকে তিনি বুখারী শরীফের উস্তায হিসেবে ময়মনসিংহের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বালিয়া মাদরাসায় চলে যান।

১৯৬৯ সনে মুরব্বীদের পরামর্শে ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় বুখারী শরীফের দরস দানের উদ্দেশ্যে নিয়োগ পান।

১৯৭১ সনের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পূর্বে তিনি হবিগঞ্জে আসেন এবং মুরব্বীদের পরামর্শে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত নিভুনিভু প্রায় উমেদনগর জামেয়া ইসলামিয়া মাদরাসার পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে দাওরায়ে হাদীসের সূচনা করেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুপ্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, হবিগঞ্জের সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও সুবক্তা মাওলানা আব্দুল খালেক চলিতাতলী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ প্রমুখ তাঁর তখনকার সময়ের ছাত্র। আল্লাহ্র মেহেরবানীতে এই সূচনা থেকে আজ ২০২০ ঈসাব্দ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর উমেদনগর মাদরাসা নিয়ে তাঁর বিরামহীন অক্লান্ত পথচলা ছিল দুর্দান্ত ও ঈর্ষণীয়।

বুখারী শরীফ ও মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.

ছাত্রজীবন থেকেই হযরত মাওলানার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তখন থেকেই হাদীসে নববী ও বিশেষ করে বুখারী শরীফের সাথে তাঁর একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সর্বপ্রথম তিনি হাটহাজারীতে মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম রাহ. ও তারপর মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ. দুজনের কাছেই পূর্ণ বুখারী পড়েন। অতঃপর পাকিস্তানের লাহোরে মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ.-এর কাছে আবার পড়েন। সবশেষে করাচিতে মুহাদ্দিসুল আসর মাওলানা ইউসুফ বানূরী  ও দেওবন্দে মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহ.-এর কাছেও বুখারী শরীফের উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ার সুযোগ লাভ করেন। এভাবে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঁচবার সহীহ বুখারী পড়েন। মাঝে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর খেদমতেও কয়েকদিন থেকে বুখারী শরীফের দরসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, তাঁর বুখারী শরীফের উপরোক্ত ছ’জন উস্তাযই ছিলেন কালের সেরা আলেম ও যুগের শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ। এটি ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ প্রাপ্তি।

পাকিস্তান ত্যাগের সময় মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ. তাঁর প্রিয় ছাত্র মাওলানা তাফাজ্জুল হকের ভবিষ্যতের বিষয়ে যেমনটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, দেশে ফিরে তাই সত্যি হল। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে তখন দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত মাদরাসা ছিল হাতেগোনা। তখন দাওরায়ে হাদীসের কিতাব পড়ানোর জন্য প্রবীণ ও অভিজ্ঞ উসতাযকেই নির্বাচন করা হত। কিন্তু ব্যতিক্রমের মধ্যে মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. শিক্ষকতার প্রথম বছর হাদীসের প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিরমিযী শরীফের পাঠদানের দায়িত্ব পান। তিন বছর পার হওয়ার আগেই মুরব্বীগণ তাঁকে প্রথম ১৯৬৬ সনে ময়মনসিংহের বালিয়া মাদরাসায়; পরে ময়মনসিংহ শহরের জামিয়া ইসলামিয়াতে বুখারী শরীফের দরস প্রদানের দায়িত্ব দেন। তাঁর হাদীসের পাঠদান ও বুখারী শরীফ পড়ানোর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭১ সনে উমেদনগর মাদরাসা, হবিগঞ্জে চলে আসেন। এখানেই আমরণ বুখারী শরীফের দরসদান অব্যাহত থাকে। ২০০৪ সন থেকে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত জামেয়া শারইয়্যাহ মহিলা মাদরাসা, মাদানীনগর হবিগঞ্জে প্রায় সতের বছর যাবৎ এবং ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে তাঁর শায়েখের মাদরাসা, সিলেটের বিখ্যাত ও বৃহত্তম জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় প্রায় এক বছর বুখারী শরীফের দরস প্রদান অব্যাহত রাখেন। এভাবেই তিনি ছাত্রাবস্থায় ৩ বছর এবং শিক্ষকতায় ৫৫ বছর সহীহুল বুখারী পড়েন এবং পড়ান।

তিনি ছিলেন একজন যশস্বী মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদীস

ইলমে দ্বীনের পঠন-পাঠনের অঙ্গনে মুহাদ্দিস শব্দটি একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা। যারা হাদীস-শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন, এ শাস্ত্রকে নিজের ইলমী ও দ্বীনী কাজের মূল লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছেন, হাদীস পড়েন ও পড়ান, হাদীসশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য রাখেন তাদেরকেই প্রকৃত অর্থে ‘মুহাদ্দিস’ বলে। আর এক্ষেত্রে অনন্য যোগ্যতার স্তরে পেঁৗছে গেলে তাঁকে ইমাম বলা হয়। এ থেকেই কালের ইমাম মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-কে ‘মুহাদ্দিসুল আস্র’ তথা যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস বা ‘ইমামুল আস্র’ও বলা হত। পরবর্তীতে মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ. পুরো জীবন বিশেষ পাণ্ডিত্য ও নৈপুণ্যের সাথে হাদীসের খেদমতে কাটিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর উপাধিই হয়ে গেছে ‘শায়খুল হাদীস’। তিনি এ উপাধির উপযুক্তও ছিলেন বটে। কারণ তিনি ইলমে হাদীসে বিশেষ পাণ্ডিত্য, হাদীস চর্চায় ব্যাপক অবদান, হাদীসের পাঠদান এবং হাদীস ও সুন্নাহকে নিজের জীবনের প্রধান আদর্শ বানিয়ে রেখেছিলেন। এর আগেও এমন উপযুক্ত ব্যক্তি অনেক ছিলেন। কিন্তু তখন ‘শায়খুল হাদীস’ নামের খুব প্রচলন ছিল না। বরং কোনো মাদরাসার প্রধান উসতায ও বড় আলেমকে ‘সদরুল মুদাররিসীন’ বলা হত।

এ কারণে আমরা অত্যন্ত আস্থার সাথেই মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-কে ‘শায়খুল হাদীস’ তথা হাদীসের শায়েখ বলে স্বস্তি ও তৃপ্তি বোধ করি। কারণ দীর্ঘ প্রায় ষাট বছর অত্যন্ত নিমগ্নতার সাথে বুখারী শরীফসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবের পাঠ দানে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেগে থাকা, জনসাধারনের মধ্যে ব্যাপকভাবে হাদীস ও হাদীসের শিক্ষার বিস্তার ঘটানো এবং হাদীসের আদর্শকে নিজের জীবনে সতত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় লেগে থাকাই ছিল তাঁর জীবন।

এর চেয়ে বড় কথা, হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত একজন ব্যক্তির জীবনে যদি হাদীস ও সুন্নাহ্র প্রতিফলন না হয়, তাহলে হাদীসের সাথে সম্পৃক্ত কোনো উপাধি পাওয়ার অধিকার তিনি রাখেন না। আলহামদু লিল্লাহ, মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-এর জীবন ছিল সুন্নাহ্র আদলে সাজানো পরিপাটি। তাই তিনি মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জী এবং শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জীও।

পাঠদানের গুরুত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা

মাওলানার জীবনের বড় অবাক করা বিষয় ছিলÑ পাঠদানের গুরুত্ব। যৌবনে তাঁর পাঠদানের অবস্থা আমরা দেখিনি। আমরা তাঁকে দেখেছি, বৃদ্ধ বয়সেও অসম্ভব সব ব্যস্ততা মাড়িয়ে নিয়মিত ও সময়মত হাদীসের পাঠদানকে সবচে বেশি গুরুত্ব দিতে। যে বয়সে ও যে সময়ে শিক্ষকতাকে অতিরিক্ত কাজ মনে করা হয়, শ্রেণীকক্ষে হাজির হতে পারাই বরকতের জন্য যথেষ্ট মনে করা হয়, সে সময়েও তাঁকে দেখেছি, পূর্ণ উদ্যম নিয়ে শিক্ষকতার কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। এর কয়েকটি উদাহরণ আমি পেশ করছি।

১. তাঁর সময়ের বড় একটি অংশ দেশ-বিদেশে ওয়ায-নসীহত ও দাওয়াতের সফরে কাটত। তবুও তিনি উমেদনগর মাদরাসায় বুখারী শরীফ প্রথম খণ্ড পূর্ণাঙ্গ ও তাফসীরে বায়যাবীসহ আরো একাধিক কিতাব এবং মহিলা মাদরাসায় বুখারী শরীফ উভয় খণ্ড পূর্ণাঙ্গ নিজে পড়িয়ে শেষ করতেন। শত কষ্ট সহ্য করেও পড়াতেন। কখনোই অন্য কাউকে দিয়ে পড়িয়ে কিতাব শেষ করতেন না।

২. বছর কয়েক আগে আমেরিকার এক সফরে দুর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙে ফেলেন। দীর্ঘ সময় সেখানে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন। তখনো তিনি অনেক অসুস্থ। ভালোভাবে বসতেও পারেন না। দুই মাদরাসার বুখারী শরীফের অনেক পড়া বাকি। ইতিহাস ভিন্ন হবার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, সে বছরও তিনি ঘরে বসে অবশিষ্ট সবক পড়াতে শুরু করেন। কি কষ্ট করে আগাগোড়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো পা নিয়ে কিতাবগুলো শেষ করেনÑ তা আমার কাছেও অবিশ্বাস্য ছিল।

৩. সাধারণত যারা ওয়াজ নসীহতের কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা পড়ানোর কাজ যথাযথ করতে পারেন না। কারণ ওয়াজের জন্য রাতবিরাত সফর করতে হয়। রাত জাগার কারণে ভোর বেলা লম্বা ঘুম দিতে হয়। আবার বিকালে নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সফর করতে হয়। কিন্তু তাঁর কথা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি যত রাতই জেগে থাকতেন, ফজরের আগেই মাদরাসায় চলে যেতেন এবং ফজর নামাযের কিছু সময় পর থেকে যথানিয়মে বুখারী শরীফের পাঠদানের কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। কোনো ব্যস্ততাই তার এ কাজে ব্যত্যয় ঘটাতে পারত না।

যাকওয়ান হযরত মাওলানার বড় মেয়ের দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর আওলাদের মধ্যে সে বড় সৌভাগ্যবান। ছেলে নাতিদের মধ্যে সেই তাঁর কাছে পূর্ণ বুখারী শরীফ পড়েছে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে সফরে-হাযারে, ঘরে-বাইরে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাহচর্যও পেয়েছে। একদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে তার বক্তব্য ছিল এমন, আমি চিটাগাং থেকে রাতে ড্রাইভ করে নানাকে নিয়ে হবিগঞ্জে এসে ফজর নামায আদায় করি। ফজরের পর ভাবলাম, যেহেতু সারারাত সফরেই কেটেছে, তাই আজ হয়ত সময়মত দরস হবে না। আমি মাদরাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘণ্টা দেড়েক পর যথাসময়ে নানাজি এসে হাজির দরস নেওয়ার জন্য। আমি ঘুমিয়ে আছি শুনে খুব রাগ করে বললেন, এভাবে দাওরায়ে হাদীস পড়া হবে না!

৪. সময়মত ও নিয়মিত দরস করার কতটা গুরুত্ব তাঁর কাছে ছিল এর জন্য আমার দেখা সহজ একটি উদাহরণ আমি দিয়ে থাকি। তা হল, তিনি প্রতি বছর নিয়মিত দুই-তিন বার বিদেশ সফরে যেতেন। সফরে যাওয়ার অনেক সময় তাঁর নিয়ম ছিলÑ প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে মাদরাসায় সবক পড়িয়ে তারপর এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা করতেন। ফেরার সময় প্রায় নিয়মিতই আমেরিকার মত দেশ থেকে ফিরে,  দেড়-দুই দিনের পথ বিমানে পাড়ি দিয়ে এসে, প্রথমে মাদরাসায় উপস্থিত হয়ে সবক পড়িয়ে তারপর বাসায় যেতেন। এরপর কোনো বিশ্রাম ছাড়াই আবার নিয়মিত পড়ানো শুরু করে দিতেন। ২০১৯ সনে জীবনের শেষ বছরে এবং জীবনের শেষ সফরে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় অসুস্থ অবস্থায়ও সিলেটের রেঙ্গা মাদরাসায় উপস্থিত হয়ে সবক পড়িয়ে তারপর বাড়ির দিকে রওয়ানা করেন। কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারলে এটি সম্ভব একথা কেবল তারাই বুঝবেন, যারা আমেরিকার মত দেশে সফরের ব্যস্ততা ও ফেরার সময়কার কষ্টের কথা উপলব্ধি করতে পারেন।

এভাবেই তিনি হাদীসের পাঠদানের মাধ্যমে যে কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন হাদীসের পাঠদানের মাধ্যমেই এ জীবনের পরিসমাপ্তিও হয়েছে।

ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়ন

উন্নত ও মানসম্মত পাঠদানের জন্য ব্যাপক ও গভীর অধ্যয়নের বিকল্প নেই। অনেকসময় ব্যস্ততা বেড়ে গেলে অধ্যয়নের সুযোগ কমে আসে। তাই অনেকেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকেই তখন পাঠদান করে থাকেন। কিন্তু হযরত মাওলানা এক্ষেত্রেও ছিলেন ভিন্ন। তিনি সবসময়ই ব্যাপক ও গভীর অধ্যয়নে অভ্যস্ত ছিলেন। ব্যস্ততম জীবনে যখনই ফুরসত পেতেন, অযথা গল্প না করে কিতাব অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতেন। বাসায়, মাদরাসায় বা মসজিদে, যেখানেই তিনি বসতেন দু-চারটি কিতাব তাঁর কাছে থাকতই। কিতাব সংগ্রহেও তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। তিনি যেখানেই থাকতেন সেখানেই নতুন নতুন কিতাব দেখতে পাওয়া যেত। বিষয়টি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। আমি যখনই তাঁর কাছে যেতাম, আমার নজর থাকতো বুকসেলফে। সবসময়ই কিছু নতুন নতুন কিতাবের সন্ধান পেতাম। প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। তখনকার সময়েও তাঁর আলমারিতে ৩০ ভলিউমের উমদাতুল কারি ও ১৩ ভলিউমের ফাতহুল বারী আমাকে বেশ আকর্ষণ করত। আমি কিতাবের মলাটের সুন্দর নকশায় মুগ্ধ হয়ে বারবার দেখতে থাকতাম। হাতে স্পর্শ করে দেখার বড় শখ হত। কিন্তু ভয়ে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারিনি।

দরসদানের মনোজ্ঞ পদ্ধতি

হযরত মাওলানার পাঠদান ও দরসের পদ্ধতি কেমন ছিল সেকথা তাঁর দীর্ঘকালের ছাত্ররাই বলবেন। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, ওয়াযের ময়দানে তাঁর ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল এজন্য যে, তার ওয়াযের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকত  কুরআন আর হাদীস। সাধারণ মানুষকে কুরআন-হাদীসের জটিল জটিল বিষয় যেভাবে পানির মত সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন আর মানুষ যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিশ্চুপ বসে থাকত; তাতে স্পষ্ট যে, তাঁর দরসও ছিল মনোজ্ঞ। সাথে ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি ও ইলমের বিভিন্ন শাখায় বিস্তর পড়াশোনা।

ধুলিয়াখালে তার মহিলা মাদরাসায় আবু সালেহ সাদী সাহেবের সাথে একদিন দেখা হল। তিনি মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-এর মামাত ভাই। সুযোগ্য আলেমেদ্বীন ও রায়ধর মাদরাসার পরিচালক। তিনি তখন হযরত মাওলানার মহিলা মাদরাসায় মুসলিম শরীফ পড়ান। কথার ফাঁকে আফসোস করে আমাকে বললেন, ‘মুহাদ্দিস সাহেবের বুখারীর দরসের তাকরীরগুলো সংকলন করা জরুরি ছিল। এগুলো একটা বড় সম্পদ। পরে আফসোস করতে হবে’।

 তিনি একটানা বলে যাচ্ছেন। তারপর বলেন, ‘আমি আগে জানতাম না, তাঁর দরস এতো চমৎকার ও এত আকর্ষণীয়। সেদিন মহিলা মাদরাসায় তার বুখারী শরীফের দরসে উপস্থিত ছিলাম। ভেবেছিলাম, মেয়েদেরকে হয়ত কোনোরকম দায়সারা গোছের পড়িয়ে দেবেন। কিন্তু তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ দরস ছিল সেটি! আমি অবাক হয়েছি। তাই আমার মনে হয়, অবহেলা না করে এখনই তাঁর দরসগুলো সংকলন করে কিতাব আকারে প্রকাশ করা উচিত। নয়তো পরে আফসোস করতে হবে’।

আমি এ বিষয়ে মাওলানা আবু সালেহ সাহেবের সমর্থক। তিনি তার মূল্যায়নে যথার্থই বলেছেন এবং তিনি এর উপযুক্তও বটে। আফসোস, ইলমের বড় সংগ্রহ নিয়ে তিনি চলে গেলেন। সংগ্রাহকের অভাবে সেই সংগ্রহশালা থেকে কিছু সঞ্চয়  রাখার সুযোগ আমাদের হয়নি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনলাইন নিউজ পোর্টাল