বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১১ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

কোন্ পথে সৌদি আরব

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

 আপডেট: ২২:১০, ১৬ জানুয়ারি ২০২২

কোন্ পথে সৌদি আরব

ডিসেম্বর ২০২১-এর মাঝামাঝিতে বিবিসির একটি প্রতিবেদন- ‘কোনো বিদেশীনী আক্রান্ত হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দেশীয় নারীদের ক্ষেত্রে তেমনটি করা হয় না।’ এটি সৌদি যুবতীদের বক্তব্য, যারা উন্মুক্ত কনসার্টগুলোতে গিয়ে পুরুষদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছে। বিবিসি উর্দূ এ বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন করেছে। তারা বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি যুবরাজের বদলে দেওয়া নীতির আলোকে সে দেশে নারী-পুরুষের মিশ্রণে উন্মুক্ত সব ‘বিনোদনের’ আয়োজন হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বড় বড় ‘তারকা’রা সেখানে আমন্ত্রিত হচ্ছে। কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা একাকার হয়ে তাদের মন-পছন্দ পোশাকে নেচে গেয়ে এসব অনুষ্ঠান ‘উপভোগ’ করছে। কিন্তু এগুলোতে হর হামেশাই নারীদের হেনস্তা ও নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ উঠছে।

 

বিবিসি এমন কিছু আক্রান্ত নারীদের সাথে কথা বললে তারা জানিয়েছে, অভিযোগ করেও তারা কোনো সুবিচার পায়নি; বরং কেউ কেউ তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেছে। পক্ষান্তরে কোনো বিদেশীনীর ক্ষেত্রে এমন অভিযোগের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। এ নিয়ে বিবিসি এমবিএস তথা সৌদি যুবরাজের নিকটস্থদের সাথেও কথা বলেছে। তারা বলেছে, সৌদিআরব এখন একটি সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ উত্থানের মধ্যে রক্ষণশীল সৌদি সমাজের লোকদের নিজেদের মানিয়ে নিতে একটু সময় তো লাগবে। সুতরাং বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।

 

উপরের প্রতিবেদনটি বৃটিশ গণমাধ্যম বিবিসি উর্দূর। হয়তো অন্য ভাষায়ও এটি প্রচারিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি পড়ার পর মনের কষ্ট থেকে এ বিষয়ে দু-চারটি কথা বলার ইচ্ছা হয়েছে। না হয় ডিসেম্বর ২০২১-এ রিয়াদের বৃহত্তর ‘মিউজিক স্ট্রম কনসার্ট’ বিষয়ে আলকাউসারের পাতায় লেখার জন্য অনেক পাঠকবন্ধুই ফরমায়েশ করেছিলেন। কিন্তু লেখার ইচ্ছা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত রিয়াদের  এ কনসার্টটিতে পুরো পৃথিবীর নামকরা ‘তারকা’দের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। ব্যয় করা হয়েছে শত শত কোটি ডলার। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এটি ছিল সর্ববৃহৎ নারী-পুরুষ মিশ্রিত ‘বিনোদন’ আয়োজন। সাত লাখের বেশি মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করেছে। অর্থাৎ সৌদিআরব এক্ষেত্রে দুবাই, আবুধাবী এবং আগে থেকেই অনেকটা খোলামেলা পরিবেশে থাকা অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটি সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান হলেও এ ধরনের অনুষ্ঠান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদিআরবের বড় বড় নগরী রিয়াদ, জেদ্দাসহ অন্যান্য নগরীতে নিয়মিতই আয়োজন হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো নিয়েই ছিল বিবিসির উপরোক্ত প্রতিবেদন।

 

প্রসঙ্গত আরজ করছি, নাচ-গানের এসব আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে লাখলাখ লোকের অবাধ সমাগম হলেও পবিত্র মক্কা-মদীনায় কিন্তু এখনো প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত। মসজিদে যেতে ‘তাওয়াক্কালনা’ অ্যাপ, রওজা শরীফে সালাম পেশ করার পূর্বোনুমতিগ্রহণ, এরপর দীর্ঘ লাইন, মসজিদুল হারামের শুধু দোতলা ও ছাদে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকার, হাজরে আসওয়াদ-হাতীম নিষিদ্ধ, কাবা শরীফের আশপাশে ঘেঁষতেও মানা, আবার সকল জায়গায় মাস্কের বাধ্যবাধকতা তো আছেই। কিন্তু নাচ-গানের বেলায় মহা সমাগমে কোভিডের কোনো ভয় নেই!

 

ফিরে আসি মূল কথায়, এ ধরনের অশ্লীল আয়োজন তো বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে। কিন্তু সৌদিআরবের ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ, সে দেশে রয়েছে মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থান মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারা। পুরো বিশ্বের মুসলিমদের হৃদয়ের সম্পর্ক এ স্থানগুলোর সাথে। এ স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ সৌদি সরকার নিজের হাতেই রেখেছে। এমনকি সৌদিআরবের বাদশাহগণ নিজেদের রাজকীয় খেতাব হিসেবে ‘খাদিমুল হারামাইনিশ শারীফাইন-দুই পবিত্র হারামের সেবক’ বাক্যটিও গ্রহণ করেছেন।

 

সে দেশের বিগত দিনের শাসকগণের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক কাজের ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও কিছু বিষয়ে তাদের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। প্রকাশ্যে গান বাদ্য সিনেমা ইত্যাদির মতো উন্মুক্ত প্রকাশ্য কোনো গুনাহের আয়োজনের সুযোগ ছিল না সেখানে। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থায়ও তারা সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল। নারী এবং পুরুষকে পৃথক ক্যাম্পাসে শিক্ষা দেওয়া হতো। নারীরা ঘর থেকে বের হলে পর্দা রক্ষা করে চলতেন। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আযীয তার ছেলে মুহাম্মাদ বিন সালমানকে যুবরাজ (মনে করা হয়ে থাকে কার্যত তিনিই হচ্ছেন সৌদিআরবের শাসক) নিযুক্ত করার পর থেকে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সৌদিআরবের চিত্র। মুসলমানদের ইহ ও পরজগতের ধ্বংসের কারণ সকল নিষিদ্ধ বেহায়াপনা ও নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের প্রচার-প্রসারে লেগে পড়েছেন লোকটি। মূলত অপরিপক্ব বোধের সৌদি কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের জযবাকে নিয়ে খেলছেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, ঐ শ্রেণির লোকদের সমর্থন নিয়ে নিজের জবরদস্তি ক্ষমতায় থাকাকে সুদৃঢ় করতে চাচ্ছেন। শুধু সৌদিআরব নয় পুরো বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্তর্জ্বালা বাড়ছে এসব অপকর্ম দেখে। যে জাযিরাতুল আরব থেকে কুফর ও শিরক এবং যাবতীয় অশ্লীলতাকে বিতাড়িত করেছিলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খলীফাগণ; সেটিকে আবার কলুষিত হতে দেখার কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না বিশ্বের মুসলিম সমাজ। সৌদি সরকারের কি এসব কিছু করার অধিকার রয়েছে? এর উত্তর নিশ্চয় না-বাচক।

 

কেউ হয়তো বলতে পারে, সৌদিআরব একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিজ রাষ্ট্রে যে কোনো কাজের ব্যাপারেই সে স্বাধীন। অন্যদের এতে নাক গলানোর কী আছে? কিন্তু ব্যাপারটি মনে হয় তত সোজা নয়। কারণ সৌদিআরব আর দশটি রাষ্ট্রের মতো সাধারণ রাষ্ট্র নয়; বরং আগেই বলা হয়েছে, এখানে রয়েছে মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্রগুলো- পবিত্র কা‘বা শরীফ ও মসজিদে হারাম, প্রিয়নবীর রওজা মোবারক ও তাঁর পবিত্র মসজিদের অবস্থান। যেগুলোতে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকে পুরো বিশ্বের মুসলিমদের প্রাণ। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম পবিত্র হজ্জ্ব পালিত হয়ে থাকে এখানে। যার পুরো ব্যবস্থাপনায় থাকে সৌদি সরকার। তাই তো সৌদি বাদশাহগণ নিজেদেরকে ‘খাদেমুল হারামাইনিশ শারীফাইন’ আখ্যা দিতে পছন্দ করেন। তো যে সরকার পুরো বিশ্বের মুসলিমদের এ পবিত্র জায়গাগুলোর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত তারা যদি নিজ দেশে প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে থাকে, সেক্ষেত্রে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই তো স্বাভাবিক। খুব স্বাভাবিক কারণেই বিশ্বের মুসলিমগণের এ দাবি জোরালো হতেই থাকবে যে, তোমরা হয়তো এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করো, না হয় হারামাইন শারীফাইন ও হজ্জ-ওমরার ব্যবস্থাপনা ভিন্ন কোনো মুত্তাকী লোকদের হাতে ছেড়ে দাও এবং নিজেদের হারামাইন শারীফাইনের খাদেম বলাও বাদ দাও।

 

এ তো গেল মুসলমানদের মনের অনুভূতির কথা। কিন্তু এসব করে আসলে সৌদিআরব যাচ্ছে কোন্ পথে। ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পর থেকেই সৌদি যুবরাজ ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, কর নীতি, অভিবাসন নীতি, ইয়েমেন নীতি, কাতার নীতি, ইহুদী ও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগতভাবে বিদেশের বড় বড় ক্লাব খরিদ এবং অন্যান্য তথাকথিত প্রমোদ-বিনোদনসহ যেসমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন তা দেখে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন থাকছে, তিনি আসলে সুখী-সমৃদ্ধ এবং আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বলতে গেলে যুগ যুগ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উপরে থাকা একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।

 

দেশের ফৌজদারী আইনগুলো কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক হওয়ার কারণে অপরাধের হার ছিল খুবই নিচের দিকে। আজকে সেখানে নারীরা পুরুষদের হাতে হেনস্তা ও নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপক অভিযোগ করছে। কেন এসবের কোনো বিচার হয় না? তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর নাম করে, বিদেশীদের সেখানে ডেকে যেসব তথাকথিত বণিজ্যিক ও বিনোদন কর্মকাণ্ড চালু করা হয়েছে, মুসলিম দেশের লোকদের সেখানে প্রবেশে হরেক রকমের কড়াকড়ি অব্যাহত রেখে মুসলিম ধনাঢ্য দেশগুলোকে অন এরাইভেল ভিসায় সরাসরি সৌদী দেখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এরপরও কেন চলতি বছরে রেকর্ড পরিমাণ তেল উত্তোলন ও বিক্রি করতে হয়েছে? কেন সেখানে এখন বাড়ি মালিকদের বাড়ি খালি হয়ে যাচ্ছে? হোটেল মালিকরা, ভিনদেশী ব্যবসায়ীরা তাদের কারবার বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে? কাতারের ওপর অবরোধ দিয়ে কয়েক বছর পর কেন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন যুবরাজ। প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ কেন কোনোক্রমেই শেষ করা যাচ্ছে না?

 

আসলে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, অর্থনীতি, বিদেশনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও সৌদি আরবের বেহাল অবস্থা করে ফেলছেন এ যুবক। তাহলে কি তার নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এবং অপকর্ম ও ব্যর্থতাগুলো ঢাকার জন্যই এসব তথাকথিত ‘বিনোদনের’ আয়োজন? তিনি হয়তো মনে করেছেন এভাবে এক ঢিলে দুটি শিকার হয়ে যাবে- নিজ দেশের একশ্রেণির বিপথগামী যুব সমাজের সমর্থনও তার পক্ষে থাকবে এবং ইসলামের নীতি ত্যাগ করে বেহায়াপনাকে জায়গা দেওয়ার কারণে বিদেশীরাও তার প্রতি খুশি থাকবে।

 

বিলাসিতা কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ

দেশব্যাপী বিলাসিতা ও নাচ-গান, সিনেমা ইত্যাদি গুনাহের কাজে বিশাল অর্থ ব্যয় হলেও, যুবরাজ কর্তৃক বিলিয়ন রিয়াল খরচ করে বিদেশী ক্লাব খরিদের অর্থ থাকলেও হারাম শরীফের উন্নয়ন কাজে কিন্তু স্থবিরতা বিরাজ করছে চরমভাবে। মনে হচ্ছে, এটি এখন আর তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কিছু নয়। আগের বাদশাহদের সময় যে গতিতে হারামাইনের উন্নয়ন হয়েছে বর্তমানে তা একেবারেই অনুপস্থিত। এর পরেও তারা হারামাইনের নিয়ন্ত্রক!

আসলে কি শেষ রক্ষা হবে?

আমরা আগেও বিভিন্ন সময় বলেছি, সব কিছু সবাইকে মানায় না। সৌদি যুবরাজ যে পথে তার দেশ ও জাতিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, জাযিরাতুল আরব আসলে সে পথে যাওয়ার মত নয়। এসব ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্বারা অল্প কিছু লোককে কিছুদিন অন্ধকারের ঘোরে রাখা গেলেও অচিরেই ব্যর্থতার খোলস উন্মোচিত হতে বাধ্য। জাযিরাতুল আরবে কোনোক্রমেই এসব অপকর্ম স্থায়িত্ব পাবে না ইনশাআল্লাহ। 

প্রসঙ্গ তাবলীগ জামাত

সম্প্রতি সৌদির ধর্মমন্ত্রণালয় কর্তৃক নতুন করে তাবলীগ জামাতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও অপপ্রচারের সূত্র এসবের সাথেই গাঁথা বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। যেহেতু তাবলীগ জামাতের লোকজন সাধারণত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামী জীবনে অভ্যস্থ থাকেন এবং অন্যদেরকে এ পথে দাওয়াত দিয়ে থাকেন তাই প্রকাশ্যে আন্দোলন-বিপ্লবে না গেলেও রাষ্ট্রের ধর্মবিরোধী কার্যক্রমে তারা ব্যাপকভাবে ব্যথিত হন এবং তাদের ঘরোয়া মজলিসগুলোতে এসব নিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভের সঞ্চারও হয়ে থাকে। এ চাপা ক্ষোভ ও দুঃখ যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্যই হয়তো নীরিহ তাবলীগীদের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার ও বিষোদ্গার। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, সৌদিআরবের তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম অন্যান্য দেশের মতো নয়। সেখানে অনেক বছর থেকেই রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের কারণে এ কাজ মসজিদভিত্তিক পরিচালিত হয় না; বরং তাবলীগ জামাতের সদস্যগণ মহল্লায় মহল্লায় নির্ধারিত ঘরে তাবলীগের কাজগুলো করে থাকেন। এ আধা গোপনীয় নিছক দ্বীনী কাজকেও এখন ভয় করছে এমবিএসের সরকার।

প্রসঙ্গ ইস্তিসকার নামায

১৩ ডিসেম্বর ২০২১ সোমবারের একটি ঘোষণা অবাক করেছে সৌদি তথা বিশ্বের দ্বীনদার লোকজনকে। বাদশাহ সালমান সেদিন দেশব্যাপী ইস্তেসকার নামায আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও এ সময়ে এটি ছিল কাক্সিক্ষত। কারণ, সৌদিতে চলছে ব্যাপক খরা ও অনাবৃষ্টি। কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টির জন্য হারামাইনের ইমামদের অনেকের অনুনয়-বিনয়পূর্ণ দুআ থেকেও বিষয়টি অনুভব করা যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক একই সময়ে চলছিল রিয়াদের সেই সাউন্ড স্ট্রম কনসার্ট। যেখানে প্রায় আট লাখ যুবক-যুবতীকে আল্লাহর নাফরমানীতে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কারণেই এ বছর এ সময় সৌদি বাদশাহর ইস্তিসকা নামাযের ডাকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সকলেই জানে, ইস্তিসকার অর্থ হল, বৃষ্টি প্রার্থনা করা। মুসলমানগণ খরা ও অনাবৃষ্টিতে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়লে দু’রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর দরবারে ইস্তিসকা করে থাকে। তারা নিজেদের সকল অন্যায়-অবিচার, গুনাহ-খাতার জন্য পরম করুণাময়ের দরবারে তওবা করে দু’হাত তুলে আল্লাহর স্মরণাপন্ন হয়। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মাঝে তখন আর কোনো আড়াল থাকে না। আল্লাহ সে দুআ কবুল করে নেন। রাসূলের সময় থেকে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইস্তিসকা চলতে থাকা অবস্থায়ই বৃষ্টি বর্ষিত হয়। কিন্তু একটি দেশের রাজধানীতে উন্মুক্ত কবীরা গুনাহের আয়োজন চালু রেখে ইস্তিসকার ডাক দেওয়া এক প্রকারের প্রহসন নয় কী?

سبحہ بر کف، توبہ بر لب، دل پر از ذوق گناه

معصیت را خنده می ‌آید بر استغفار ما

অর্থাৎ মুখে তাওবা, হাতে তাসবীহ, আর অন্তরাত্মা গুনাহের কামনায় পূর্ণ। আমাদের এরূপ ইস্তেগফারের প্রতি স্বয়ং গুনাহও হাসে!

শুধু সৌদিআরব নয়; বরং দেশে দেশেই এ ধরনের প্রহসন চলছে। জোর জবরদস্তি ক্ষমতা আকড়ে থাকা লোকেরা একদিকে যেমন রাষ্ট্রকে লুটেপুটে খাচ্ছে, গণমানুষের ওপর জুলুমের স্টিম রোলার চালাচ্ছে, বেহায়াপনা ও বদদ্বীনীর সয়লাব করে ফেলছে, অন্যদিকে আবার মাঝে মাঝে ধর্মকর্মের বাণীও শোনাচ্ছে। এ যেন-

حج بھی کعبہ کا کیا اور گنگا کا سنان بھی

رحمن بهى راضى رہے اور شيطان بهى بے زار نہ ہو

কা‘বায় গিয়ে হজও করেছি, করেছি গঙ্গায় স্নানও।/আল্লাহ্ও রাজি থাকুক, শয়তানও নারাজ না হোক।

কিন্তু এ নেফাকী-কপটতা আর কতদিন? পৃথিবীর মুসলমানরা যদি সত্যিকারভাবে মুমিন হয়ে ওঠে, যদি তারা নিজেদের জীবনে ইসলামের অমীয় বাণীগুলো ধারণ করা শুরু করে, যদি তারা সত্যিকার মর্দে মুমিনের মতো জেগে ওঠে তাহলে কি ওদের রক্ষা হবে? আর তারা যে বিদেশী ‘প্রভু’দেরকে খুশি করতে চায়, তারা কি আসলেই কখনো এদের ওপর সন্তুষ্ট হবে?

আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

وَ لَنْ تَرْضٰی عَنْكَ الْیَهُوْدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ .

ইহুদী ও নাসারা তোমার প্রতি কিছুতেই খুশি হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। -সূরা বাকারা (২) : ১২০

সুতরাং আমরা বিশ্বের মুসলিম শাসকদের এবং বিশেষভাবে সৌদির শাসকবর্গকে উদাত্ত আহ্বান জানাব, তারা যেন এসব নেতিবাচক চিন্তাধারা ও কর্মকান্ড থেকে ফিরে এসে কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের শিক্ষাকে ধারণ করেন। তবেই তারা খাদেমুল হারামাইন থাকার, হজ-উমরা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকার অধিকারী থাকবেন। অন্যথায় পরিস্থিতি পাল্টাতে দীর্ঘদিন নাও লাগতে পারে। নাগরিকদের ইহ ও পরকালীন সফলতা, মানব উন্নয়ন, সত্যিকারের মানবাধিকারের বাস্তবায়ন, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ইত্যাদির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন: