“নোবেলজয়ী সরকারপ্রধানের অধীনেই সাংবাদিক নিপীড়ন”: প্রবাসী সাংবাদিকদের উদ্বেগ

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা হচ্ছে, তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ এবং নজিরবিহীন বলে মনে করছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ৮৮ জন প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও অধিকারকর্মী। ২ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে সাংবাদিকদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন নেমে এসেছে। সাংবাদিকদের উপর মামলা, গ্রেফতার, চাকরিচ্যুতি এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু গণমাধ্যমে নয়, সামাজিক মাধ্যমেও কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় এসেছে। এসব নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই লিখিত নয়, কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহভাবে তা প্রতিফলিত করছে। এসব ঘটনাকে তারা লজ্জাজনক ও ঘৃণ্য পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, প্রবাসে থেকেও তারা দেশের প্রতি দায়বদ্ধ এবং দেশের কল্যাণে নিবেদিত। তাই দেশের ভেতরে কোনো অনাচার, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিক নির্যাতনের মতো ঘটনায় মুখ না খোলা অনৈতিক মনে করছেন তারা।
তারা জানান, গত ১১ মাসে অন্তত ৪১২ জন সাংবাদিককে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলায় আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে এমনকি হত্যা মামলাও রয়েছে। ৩৯ জন সাংবাদিক ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া বহু সাংবাদিককে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে নানা হেনস্তার শিকার করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। ঢাকাসহ সারা দেশে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি, ১৬৮ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও অন্যান্য ক্লাব থেকে ১০১ জন সাংবাদিকের সদস্যপদ স্থগিত, বাতিল বা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি মিডিয়া হাউজগুলোকে দখলে নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও এসেছে।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী সময়ে ১০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং অনেক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এসব আক্রান্ত সাংবাদিক বা তাদের পরিবারের প্রতি কোনও ধরনের সহযোগিতা বা সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয়নি। ফলে অনেক সাংবাদিক ও তাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন—মুখ বন্ধ রাখার মূল্য দিতে হচ্ছে জীবন ও জীবিকার বিনিময়ে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, এইসব দমনমূলক কর্মকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে এবং এই সরকারের প্রধান হলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন ব্যক্তি। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেই অতীতে সাংবাদিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। অথচ আজ তারা নীরব। এই পরিস্থিতিকে তারা হতাশাজনক ও বেদনাদায়ক বলে অভিহিত করেছেন।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের ৮৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের মধ্যে আছেন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান, লেখক ও গবেষক ড. মুকিদ চৌধুরী, সাংবাদিক ও সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, মানবাধিকার কর্মী জেসমিন চৌধুরী, ব্লগার বাঁধন মুন্সি, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ও বিজ্ঞানী ড. নূরুন নবী, গীতিকার তাজুল ইমাম, কলামিস্ট সৈয়দ মাহমুদউল্লাহ, সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর, অজয় দাশগুপ্ত, ফজলুল বারীসহ আরও অনেকে।
তারা প্রত্যেকে মনে করেন— বাকস্বাধীনতা কোনো রাজনৈতিক সুযোগ নয়, এটি নাগরিক অধিকার। এবং এই অধিকার রক্ষায় দেশে-বিদেশে সচেতন মানুষের দৃঢ় প্রতিবাদ, দায়বদ্ধতা ও প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবি।