শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

সময়ের এক সমুজ্জ্বল তারকা আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

 আপডেট: ১৬:২১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সময়ের এক সমুজ্জ্বল তারকা আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.

গ্রামের ছোট্ট এক তালেবে ইলম। পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসেছে। ঢাকা শহর তখনো অতোটা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে ওঠেনি এখন যতোটা, তবুও কেউ একান্ত বাধ্য না হলে শহরের পথ ধরতেন না। তালিবে ইলমের পিতা তেমনি বাধ্য হয়ে শহরে এসেছেন।

পিতা সময়ের একজন মহান বুযুর্গ আলেমে দ্বীন। যামানার বড় বড় বিদ্ব্যান আর মহামানবদের সংশ্রব পেয়ে অনেক বড় হয়েছেন। অর্জন করেছেন ইলমেদীনের গভীরতা ও অসাধারণ যোগ্যতা। শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেছেন এবং নিজেকে গড়ে তুলেছেন তার স্নেহধন্য তালিবে ইলম ও আস্থাশীল ভক্তরূপে। মাদারে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দের তদানিন্তন সবচে ঈর্ষণীয় যেসব বাংলাদেশী তালিবে ইলম গত হয়েছেন তিনি তার অন্যতম।

তিনি নিজে যেমন বড় হয়েছেন, বুর্য্গুদের সুহবত পেয়ে ধন্য হয়েছেন, সন্তানও যাতে আরও বড় হতে পারে, উলামায়ে কেরামের পবিত্র সুহবতে ধন্য হতে পারে সেজন্য নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও ছেলেকে নিয়ে এসেছেন ঢাকার বুকে।

আসলে আমাদের যারা বড় হয়েছেন তারা সকলেই সেই ছোট সময় থেকে বড়দের সুহবত পেয়েছেন। পিতা-মাতা সুযোগ করে দিতেন আর সন্তানেরাও সেটা লুফে নিতো।

যেই ভাবনা সেই কাজ। তখন সময়ের সবচে বড় এবং প্রভাবশালী আলেমের নাম হযরত শামসুল হক ফরীদপুরী (সদর সাহেব) রহ.।

পিতাজী ছোট্ট তালিবে ইলমকে নিয়ে গেলেন সেই হযরতের দরবারে।

হযরত! আমার ছেলেকে একটু আপনার কাছে রেখে যাবো? বেলা শেষে ফের ওকে নিয়ে যাবো। হযরত বললেন, ঠিক আছে রেখে যান।

একদিকে বাবা চলে গেলেন গ্রাম থেকে নিয়ে আসা ঝামেলাগুলো শেষ করার কাজে আর একদিকে ছেলে তখন হযরতের দরবারে বসে বসে কখনো কলম ধরছে কখনো বা যতেœ রাখা কাগজগুলো এলোমেলো করে ছোট্ট মনের আনন্দ নিচ্ছে। ঠিক ছোটোরা যেমনটি করে থাকে। হযরত ফরীদপুরী রহ. একটুও বিরক্ত হলেন না ‘এটা করে না ওটা করো’, ‘এভাবে নয় ওভাবে করো, বলে বলে সারাদিন পার করে দিলেন।

সন্ধ্যায় পিতা এলেন। হযরতের দু‘আ নিয়ে ছেলেকে বাড়ী নিয়ে গেলেন। ব্যাস, এখানে এতোটুকুই- সারাদিন একজন মহান বুযুর্গের সান্নিধ্য লাভ। এটাই যথেষ্ঠ। পরম পাওয়া। মহান সফলতা।

এতোটুকু সুহবতেই ছেলের মনে রং ধরে গেল। বড় হওয়ার রং। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হল। লেখাপড়া করল। সাধনা করল। জীবনের সফলতায় যুদ্ধ করল এবং যুদ্ধে সে জয়ী হলো, অনেক বড় হলো। বাবা যেমন চেয়েছেন তারচেয়েও বড়।

প্রিয় পাঠক! আমাদের আজকের এই তালেবে ইলম সময়ের ক্ষণজন্মা এক মনিষী আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.। বাংলার একজন প্রবীণ আলেম। অনেক শীর্ষ আলেমের মুরুব্বী। আধ্যাত্মিক জগতের রাহবার। ইলম ও আমলের সমন্বয়ে জীবন গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা।

জন্ম ও শিক্ষাকাল

আজ হতে প্রায় ৭০ বছর আগের কথা। ২৬ শ্রাবণ ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ। ১০ আগস্ট ১৯৪৮ খিস্টাব্দ। রোজ বুধবার। রাতের শেষ প্রহর। তিন ভাই পাঁচ বোনের মাঝে সর্বজেষ্ঠ্য।

কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য সমীহ করার মতো। পিতা মাওলানা আখতারুজ্জামান সর্বজন সমাদৃত একজন বুযুর্গ আলেম। এক সময় হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর তত্ত¡াবধানে জামি‘আ কুরআনিয়া লালবাগের প্রথম মুহতামিম। হযরত থানবী রহ.-এর সংস্পর্শ ধন্য গুমনাম ওলী। দাদা, নানা উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত পরহেযগার ও সম্মানী ব্যক্তিত্ব, খ্যাতনামা আলেমে দীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। মরহুমা আম্মাজান যুবায়দাও ছিলেন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও বিদুষী মহিলা। ছিলেন সবর শুকর ও তাকওয়া পরহেযগারীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

তাই আম্মা ছিলেন হযরতের জীবনের প্রথম পাঠশালা।

হযরত তার লিখিত ‘হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. ও আমার আব্বাজান’ বইয়ে লিখেন, আমার মনে পড়ে, জীবনের সেই দিনগুলো আম্মার কাছে লাভ করলাম জীবনের প্রথম সবক ‘কায়েদা বোগদাদী’। আম্মা বললেন, আলিফ, বা, তা। আমি আমার মায়ের প্রথম সন্তান। আম্মার সুরে সুর মিলালাম আলিফ, বা, তা। আমার জীবন শুরু হল। আমার আম্মা রোপন করলেন আমার জীবনের বীজ। মনে পড়ে সেদিনের দুনিয়ার কথা। আমাদের গ্রাম, আমাদের ছোট্ট...

সত্যিই ভাগ্যবান সে মা, সৌভাগ্যবান সে সন্তান, যার দীন শিক্ষার প্রথম পাঠশালা তার মমতাময়ী মা। তাই তো, সৎ ও নেক সন্তান লাভের জন্য প্রতিটি পুরুষের জন্য নেককার বিবি নির্বাচন শরীয়তের অন্যতম বিধান।

তারপর শুরু হল ইলম অর্জনের এক মহাযাত্রা।

কুমিল্লার ধামতি আলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সীপাল ও দরবারে ফুরফুরার বিশিষ্ট খলীফা নানাজান মাওলানা আযীমুদ্দীন সাহেবের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। তিন বছর পর ফিরে আসেন পিতার প্রতিষ্ঠিত পাহাড়পুর মাদরাসায়। অত্যন্ত একাগ্রতা, মনোযোগ ও চ‚ড়ান্ত সাধনায় এগিয়ে যেতে থাকেন সম্মুখপানে।

এখানেই শেষ করেন জামাআতে জালালাইন।

ইচ্ছে হলো, তদানিন্তন বাংলার সেরা বিদ্যাপীঠ লালবাগ জামি‘আয় হাদীসের পাঠ গ্রহণ করবেন। পিতাজান শুনে শর্ত জুড়ে দিলেন, ‘তুমি যদি হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে মুরুব্বী মেনে চলতে পারো, তাহলে তুমি সেখানে ভর্তি হতে পারবে।’ মুরুব্বী মেনে চলা সে সময় তুলাবাদের মজ্জাগত বিষয় ছিলো। এখন যদিও মুরুব্বীগণের পরামর্শ প্রায় পুরা ছাত্রসমাজের জন্য অগ্নীশূলে পরিণত হয়েছে আর এ কারণে এ সময়ের তুলাবাদের অধঃপতনও কোনভাবেই আর ঠেকানো যাচ্ছে না অথচ যারাই বড় হয়েছেন সকলেই অন্ধের যষ্টির মতো সদাসর্বদা মুরুব্বীগণকে আকড়ে ধরে সফলতা পেয়েছিলেন।

১৯৬৭ বা ১৯৬৮ সনের দিকে লালবাগ এসে ভর্তি হোন মেশকাত জামাআতে। বয়স তখন মাত্র ১৯। ২০ বছর বয়সে সমাপন করেন দাওরায়ে হাদীস।

ফারাগাতের পর উচ্চতর ডিগ্রীর ইচ্ছায় পাকিস্তান যাওয়ার ইরাদা করেন। হযরত হাফেজ্জী রহ বললেন, অনুমতি নেই।

হযরত তার কিতাবে লিখেন, ‘হুযূরের মুখে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই আমার অন্তর থেকে সমস্ত ইচ্ছা, প্ল্যান, প্রোগ্রাম মুহুর্তের মধ্যে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। করাচী যাওয়ার কোন চিন্তা-দুশ্চিন্তা কোন কিছুর কোন রেশ আমার মাঝে অবশিষ্ট থাকলো না। আমি নিষেধ করার হেকমত পরে বুঝেছি। যখন তিনি আমাকে এবং আমীনি সাহেবকে কামরাংগীরচর মাদরাসায় নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা করলেন এবং শিক্ষকরূপে নিয়োগ দিলেন। বছর শুরু হলো। আমি সেখানে নিয়মিত পড়াচ্ছি। শাবান মাসেই আমার নেসাব শেষ হয়ে গেল। হযরত একদিন আমাকে ডেকে বললেন, আপনি না করাচী যেতে চেয়েছিলেন? আমি বললাম, আপনি তো অনুমতি দেননি। হুযূর বললেন, এখন অনুমতি আছে এবং হুযূর নিজেই আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমি সেখানে আল্লামা ইদরীস কান্ধলবী রহ. ও আল্লামা ইউসুফ বানূরী রহ.-এর নিকট বুখারীর দরসে শরীক হলাম। তারপর আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. ও আল্লামা রসূল খান রহ.-এর সুহবত লাভের সৌভাগ্যও অর্জন হলো।

তারপর একবছর মুলতানের খাইরুল মাদারীসে আল্লামা শরীফ কাশ্মীরি রহ.-এর তত্ত¡াবধানে ফুনূনাত পড়ার সৌভাগ্য হলো। হঠাৎ হযরতের এক চিঠি পেয়ে দেশে ফিরে আসি। পূর্বের ন্যায় নূরীয়াতে আবার পড়ানো শুরু করি।

ইলমী জীবন

আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ. আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া এতোটুকুই করেছিলেন কিন্তু তার প্রকৃত ইলমের পরিধি কতো বিশাল ছিলো তার কোন হিসাব নেই।

কুতুবখানায় তার মুতালাআর একাগ্রতা দেখে হযরত হাফেজ্জী রহ. খুশি হয়ে বলতেন, ہاں مولوی عبدالحی! ایساہی ہوناچاہئے بس کتابوں کا کیڑا بن جاؤ (মৌলবী আব্দুল হাই? এমনই হওয়া চাই। একদম কিতাবের পোকা বনে যাও।)

আসলেই তিনি কিতাবের পোকা হতে পেরেছিলেন। যার কারণে হযরত হাফেজ্জী রহ. নিজের সাথে হজ্ব সফরের সুযোগ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার সাথে হজ্বে যাবে তবে শর্ত হলো সফরের পুরো সময় আমার কাছে বুখারী পড়তে হবে’। ছাত্র কতোটা প্রিয়, কতোটা যোগ্য হলে উস্তাদ এভাবে গড়ে তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে পারেন। অবশ্য সে মোতাবেক তিনি হজ্ব সফরে পড়েও ছিলেন।

নূরীয়া মাদরাসায় তখনো দাওরা খোলা হয়নি। যখন শুরু হয়েছে বুখারী ১ম খÐ শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রহ.-এর তাকসীমে দেয়া হয়েছে আর বুখারী ২য় খন্ড হযরত হাফেজ্জী রহ. এর ভাগে ছিল। হযরত পাহাড়পুরীকে দাওরায় কোন কিতাব দেয়া হয়নি। মনে মনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন, যাক ভালোই হয়েছে, আমার ঘন্টার ফাকে ফাকে হযরতদ্বয়ের কাছে পুনরায় বুখারী পড়ার সৌভাগ্য হয়ে যাবে এবং তিনি হযরত হাফেজ্জী রহ.-এর ঘন্টায় প্রথম দিন খুব ভালো করে মুতালাআ করেও বসেছিলেন কিন্তু বড় অবাক কান্ড! হযরত হাফেজ্জী রহ. দরসে এসে ছাত্রদেরকে বললেন, আমার মুতালাআর সুযোগ হয়নি তোমাদেরকে মাওলানা আব্দুল হাই পড়াবেন। এবং শেষ পর্যন্ত হযরত উপস্থিত থেকে পাহাড়পুরী হুযূরের তাকরীরও শুনেছেন এবং খুব খুশিও হয়েছেন। আর খুশি হবেন না কেন, উস্তাদ যেভাবে চেয়েছেন তিনি ঠিক সেভাবেই নিজেকে সাজিয়েছেন।

মাদরাসায়ে নূরীয়া যখন জামাআতে শরহেবেকায়া পর্যন্ত তখন হাদীসের কিতাবগুলো এবং শরাহ- শরুহাতগুলো মুতালাআ করার তাকিদ দিতেন। এমনকী কুতুবখানায় হযরত পাহাড়পুরীর সিটও দিয়েছিলেন। যার ফলাফল আজকে প্রকাশ পেল, উস্তাদ বলছেন, আমার মুতালাআর সুযোগ হয়নি আমার ছাত্র আজকে তোমাদের পড়াবেন। কতো চমৎকার সে দৃশ্য, সে মানযার!!

হযরত হাফেজ্জী রহ. সে কথা শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক সাহেব রহ.কেও বলেছেন, আমার ভাগের বুখারী সানী মাওলানা আবদুল হাই পড়াবেন। তারপর তিনিও খুব খুশি হয়েছেন। তাছাড়া শাইখুল হাদীস রহ. ও পাহাড়পুরী হুযূরকে খুব মুহাব্বত করতেন।

একবার পাহাড়পুরী হুযূর চেয়েছিলেন গওহরডাঙ্গায় হযরত ফরীদপুরী রহ.-এর কাছে রমাযান মাস থেকে কারীমা কিতাবটি পড়বেন।

ফরীদপুরী রহ. ফারেগ ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে কারীমা পড়াতেন। পাহাড়পুরী হুযূরকে শাইখুল হাদীস রহ. বললেন, সদর সাহেব হুযূরের কাছে যাওয়ার সুযোগ তো তোমার ইনশাআল্লাহ সামনেও ঘটবে। আগামী বছর আমি অনেক দিন পর বুখারী পড়াব। রমাযানে তুমি লালবাগ থেকে আমার তত্ত¡াবধানে বিশেষ কিছু কিতাব মুতালাআ করলে তোমার বিশেষ ফায়দা হবে। কুরবানীর পর পর যদিও হযরত শামসুল হক ফরীদপুরী রহ.-এর ইন্তিকাল হয়ে যাওয়ায় সে সৌভাগ্য আর হয়নি কিন্তু বিশেষ ফায়দা ঠিকই হয়েছে।

শাইখুল হাদীস রহ.- এর সহবতে অনেক কিতাব মুতালাআ হয়েছে, বাংলাদেশে সবর্ প্রথম শাইখের অনবদ্য তরজমা বাংলা বুখারীর প্রæফ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যা কিনা বাংলাদেশে রচিত বুখারির প্রথম বাংলা অনুবাদ।

এবং এ থেকে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. এর সাথেও খুব মুহাব্বত ও কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। পরে তিনি শুধু বুখারী শরীফই হযরত শায়েখের কাছে পাঁচবার পড়ার সুযোগ লাভ করেছিলেন। হাদীসের দরসে পাহাড়পুরী হযরতের ইবারত পড়া শাইখ এতোবেশি পছন্দ করতেন যদি অন্য কোন ছাত্র হাদীসের ইবারত শুরু করতেন কিছুক্ষণ পর পাহাড়পুরী হযরতকেই পড়তে বলতেন।

আল্লাহ তাআলা হযরত পাহাড়পুরী রহ.কে ইলমের গভীরতা এতোটা দান করেছেন এবং তাকে এতোটা কবুল করেছেন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ আঠার বছর শুধু জামি‘আ নূরীয়াতে ইলমে হাদীসের খেদমত করেন। তারপর মিরপুর মুসলিম বাজার মাদরাসায়, মুহাম্মাদপুর জামি‘আ মুহাম্মাদীয়ায়, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া ও জামি‘আ ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসায়ও সুদীর্ঘ সময় হাদীসের দরস প্রদান করেন। পাশাপাশি বড় কাটারা মাদরাসায়ও উলূমে নববীর মহান খেদমত আঞ্জাম দেন। হুযূরের জীবনের সর্বশেষ সময়ে এসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মারকাযুল ইলমী নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা ছিল হুযূরের রূহ।

শেষ কথা

হযরত পাহাড়পুরী রহ. ছোট্ট একটি জীবন পেয়ে ছিলেন কিন্তু মুরুব্বীগণের নেক সুহবত আর মেহনত-মুজাহাদায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে ছিলেন অনন্য উচ্চতায়। সকলের কাছে ছিলেন সমান সমাদৃত এবং নির্ভরযোগ্য। যেমন পরিবারে, তেমন বাইরে, সবখানে প্রিয়তম। এক স্ত্রী, তিন পুত্র, সাত কন্যার এক ঝলমলে পরিবার ছিলো। বিবাহ করছেন ১৯৭৩ সনে হযরত হাফেজ্জীর সর্বকনিষ্ঠ কন্যাকে, যা ছিল সত্যিই গৌরবের। এবং এবছরই হযরত হাফেজ্জী রহ.তাকে ডেকে নিয়ে বাইয়াতের মর্যাদা প্রদান করেন এবং পরে খেলাফতও প্রদান করেন। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন মানুষ গড়ার একজন সফল কারিগররুপে। এদেশের উলামা তুলাবা অগনিত মানুষ তার পরশে হিরকখÐে পরিণত হয়। তার রচিত ‘নূরীয়া নূরানী কায়দা’ বছর প্রতি লক্ষাধিক কপি লাখো মানুষের হিদায়াতের জরিয়া। সরফ শাস্ত্রে ‘আল হাদী ইলাস সরফ’ কিতাবটি তুলাবাদের আশার প্রেরণা। ‘হযরত হাফেজ্জী রহ. ও আমার আব্বাজান’ ও ‘আমার আম্মা’ নামক বইগুলো সমগ্র উম্মাহর জন্য রাহনূমা এবং আশাজাগানিয়া।

হযরত পাহাড়পুরী রহ.এর জীবনটা বেশ সজীব। সাবলীল। পবিত্রালোকের বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটা। ঈর্ষণীয় এবং অনুসরণীয়। সমসাময়িকদের মূল্যায়নও তেমনি।

আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক দা.বা. বলেন, আল্লামা পাহাড়পুরী রহ. ইলম, আমল, ও বুযুর্গীতে অনন্য। তিনি হযরত হাফেজ্জীর পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। হযরত হাফেজ্জীর সর্বোচ্চ আস্থাভাজন। নিরেট হাফেজ্জী প্রেমী ও প্রাণোৎসর্গী ছিলেন।

হযরতের দীর্ঘ দিনের ছাত্র জামি‘আ রাহমানিয়ার মুহতামিম আল্লামা হিফজুর রহমান (মুমিনপুরী হুযূর) বলেন, হুযূরের পাঠদান এতোটা সাবলীল এতোটাই সাজানো ছিলো, কঠিন থেকে কঠিন সবক ও সব স্তরের ছাত্ররা বুঝতে পারতো। সবসময় তিনি মাদরাসায় পরে থাকতেন। অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে জিকির করতেন। সর্বদা মুতালাআয় লিপ্ত থাকতেন অথচ এতোটা সহজ ছিলেন, ছাত্ররা নির্দিধায় কাছে যেতে পারতো। সব ধরনের ছাত্রদেরকে মুহাব্বত করতেন। কোন ধরনের পদ-পদবী গ্রহণ পছন্দ করতেন না। সচ্ছ মুআমালা করতেন। কখনো কারো সমালোচনা করতেন না। কখনো কেউ তার উপর আপত্তি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ পেত না।

হযরত পাহাড়পুরী রহ.-এর চেতনার ধারক সুযোগ্য ছাত্র মাওলানা আবূ তাহের মেসবাহ দা.বা. বলেন, আকাশে অনেক তারা আছে। তবে শুকতারা মাত্র একটি। অন্যের কথা জানি না; আমার জীবনের আকাশে তো তিনি ছিলেন সেই শুকতারা, সন্ধ্যাতারা এবং প্রভাততারা।

প্রিয়পাঠক! হযরত পাহাড়পুরী রহ.-এর জীবনীকা আমাদের সকলের জীবনপাঠ্য হতে পারে। হতে পারে আমাদের জীবন চলার অনিবার্য অংশ। তার বর্ণিল এবং বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্যের পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমাদের এই কাগজের পাতায় তুলে ধরা কখনোই সম্ভব নয়।

তার জীবনাধ্যায়ের কতোটুকুই আমরা জানতে পেরেছি এবং জানা সম্ভব? তিনি তো ছিলেন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ। ছিলেন লুকিয়ে থাকা দুর্লভ রতœ।

তবে যতটুকুই আমরা পেয়েছি, অভিভূত। জীবনাচারের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ। তাকওয়া-পরহেযগারী ইলম ও আমলের সৌরভে বিমোহিত। অনাগত সকলের জন্য নক্ষত্রের মতো তা জাজ্বল্যমান। তার পবিত্র বিচ্ছুরণ থেকে যে গ্রহণ করবে বা যারা গ্রহণ করবে আলোকিত হবে তাদের জীবন। দীপ্ত ও প্রদীপ্ত হবে তাদের ভবিষ্যৎ।

আমাদের মাঝে এ মহান মানুষটি আর নেই। গত ২৯ আগস্ট ২০১৬ ঈসায়ী থেকে আমরা তাকে ‘রহমাতুল্লাহি আলাইহি’ বলতে শুরু করেছি। তিনি চলে গেছেন দূরে, বহুদূরে, অনন্তলোকের স্বর্গীয় পথে। তিনি শুয়ে আছেন সফেদ কাফনে আবৃত হয়ে, সুরভিত জান্নাতের অনাবিল পরিবেশে। তিনি চলে গেছেন মানব ও মানবতাকে কাঁদিয়ে- বেদনার শোক সাগরে ভাসিয়ে। তার পদচিহ্ন আর পড়বে না এই ধরনী পরে। তবে তার বর্ণিল জীবনের কীর্তিগুলো প্রবাহিত হবে নদী তরঙ্গের মতো। শত-সতীর্থ স্বজনের হৃদয় থেকে হৃদয়ে-আত্মা থেকে আত্মায়। তিনি মরেও অমর। চির স্মরণীয় এবং বরণীয়।

লেখক : সিনিয়র উস্তাদ

জামি‘আ বাইতুল আমান মিনার মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র

তাজমহল রোড, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা-১২০৭

খতীব, মুহাম্মাদিয়া জামে মসজিদ, রামপুরা, ঢাকা

মুসলিম বাংলা

মন্তব্য করুন: