গুমে রাজি না হওয়া কর্মকর্তাদের তথ্য যেত সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে: তদন্ত কমিশন

নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা বেআইনি আদেশ মানেননি, তাঁদের তথ্যও সরাসরি যেত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে রাজি না হওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিচয় এবং তাঁদের আপত্তির তথ্য সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো—এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাবের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এক বন্দিকে হত্যার বেআইনি নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, “যদি ওনাকে মারতেই হয়, তাহলে আমাকে সরিয়ে দিন, আমি এ দায়িত্ব নেব না।” পরে ওই বন্দিকে হত্যা করা হয়নি এবং ঐ কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পরও চাকরিতে বহাল ছিলেন, যা নির্দেশ অমান্য করলেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সবসময় নেতিবাচক ছিল না, তার ইঙ্গিত দেয়।
শেখ হাসিনার ফাইলে সংরক্ষিত ছিল ‘না’ বলাদের চিঠি
প্রতিবেদনে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ তুলে ধরা হয়। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর গণভবনে পরিত্যক্ত নথিপত্র পর্যালোচনার সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক কর্মকর্তা র্যাবের দুই কর্মকর্তার লেখা হাতে লেখা চিঠি আবিষ্কার করেন। ওই চিঠিগুলোতে তাঁরা বেআইনি হত্যাকাণ্ডে অংশ না নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং তা র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক বরাবর লেখা হলেও সেগুলো শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ফাইলে সংরক্ষিত ছিল ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
একটি চিঠিতে লেখা ছিল:
“...যদি অভিযানে গুলি চালানো বা বেআইনি হত্যার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আমি তাতে অংশ নিতে পারি না।”
অমান্যকারীদের শাস্তি হয়নি, বরং সুরক্ষা দেওয়া হয়
প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব কর্মকর্তা বেআইনি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তাঁদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি তাঁদের আচরণের তথ্যও সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহলে পৌঁছেছিল, যা প্রমাণ করে গুমের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নজরে ছিল।
ডিজিএফআই–শেখ হাসিনা সরাসরি যুক্ত
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন কমিশনকে জানান, জেআইসিতে আটক হুম্মাম কাদের চৌধুরী সম্পর্কে তিনি সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। আরেক কনিষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, তিনি শুনেছেন এক বন্দিকে নিয়ে আলোচনায় শেখ হাসিনা নিজেই মত দিয়েছিলেন, যা থেকে বোঝা যায়, এসব ঘটনায় তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল।
আওয়ামী লীগ দায় এড়াতে চায় সামরিক বাহিনীকে দোষারোপ করে
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ এক সময় গুমের ঘটনা অস্বীকার করলেও এখন বলছে, এসব কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর একক সিদ্ধান্ত ছিল। গত ১৬ এপ্রিল দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, যদি গুম হয়ে থাকে, তা সেনাবাহিনীর একক সিদ্ধান্তে হয়েছে—শেখ হাসিনা বা তাঁর মন্ত্রিসভা দায়ী নয়।
তবে কমিশনের মতে, এই বয়ান রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় লুকানোর চেষ্টা এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে এককভাবে দোষী দেখানোর কৌশল। কমিশনের ভাষ্য, গুম ছিল রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী সংগঠিত পরিকল্পনা।
নতুন আশঙ্কা: দ্বিতীয় স্তরের অপরাধে জড়াচ্ছেন অনেকে
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক ব্যক্তি যাঁরা শুরুতে গুমে জড়িত ছিলেন না, তাঁরা এখন গুম হওয়া ব্যক্তিদের পলায়নে সহায়তার মাধ্যমে নতুন অপরাধে জড়াচ্ছেন। এ প্রবণতা উদ্বেগজনক বলে মনে করছে কমিশন।
নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে নজরদারি ও প্রতিক্রিয়া
গুমে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নজর রাখত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সাতজন কর্মকর্তার বিষয়ে বিস্তারিত নজরদারি চালানো হয়েছিল। তাঁদের আত্মীয়–পরিজনের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত গোয়েন্দা নথিতে উল্লেখ ছিল, কিন্তু ‘গুম’ শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
ভিন্নমতের মূল্য দিতে হয়েছে অনেককে
গুম বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করায় অনেক কর্মকর্তার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব পড়ে। এক কর্মকর্তা জানান, তাঁকে বিভিন্ন পোস্টিংয়ে অপছন্দের ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করে সতর্কবার্তা দেওয়া হতো। এমনকি তাঁর পরিবারের ওপর নজরদারি করা হতো।
উপসংহার
তদন্ত কমিশনের মতে, এসব তথ্য শুধু গুমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় জড়িত থাকার প্রমাণ দেয় না; বরং এটিও নির্দেশ করে, এমন দমনমূলক পরিবেশেও কিছু কর্মকর্তার বিবেকবোধ ও আইনের প্রতি আনুগত্য ছিল।