বাজেট কেন কাজে আসে না?

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে উচ্চাশা থাকলেও কাঠামোগত সংস্কার ও বাস্তবায়নের দুর্বলতায় তৈরি হয়েছে প্রশ্ন |
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এমন এক প্রেক্ষাপটে এসেছে, যেখানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। এসব প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা ছিল বাজেট হবে বাস্তবমুখী, কাঠামোগত সংস্কারনির্ভর এবং ভবিষ্যৎমুখী। কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এবারের বাজেটেও তেমন পরিবর্তনের ছাপ নেই।
সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার এই বাজেট উচ্চাভিলাষী হলেও তা কতটা বাস্তবসম্মত—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা, যা এনবিআরের ওপরই নির্ভরশীল। অথচ বিগত তিন অর্থবছর ধরেই এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক দুর্বলতা, করনীতির অস্বচ্ছতা, কর অব্যাহতি ও করদাতাদের আস্থাহীনতা।
কর ব্যবস্থায় সংস্কারের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এই বাজেটে দেখা যায়নি। করের আওতা বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও কর আদায়ে প্রযুক্তি ব্যবহার, কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা কিংবা অনুপ্রেরণামূলক নীতির পরিবর্তে জোরজবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে, যা করদাতাদের আরও বিমুখ করতে পারে।
এছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বেশি করভার দেওয়ার বিষয়টি তাদের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
উন্নয়ন বাজেট হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতা বরাবরের মতোই রয়ে গেছে। বিগত বছরগুলোয় এডিপি বাস্তবায়নের হার গড়ে ৬৫-৭০ শতাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো বড় নীতিগত হস্তক্ষেপ নেই, নেই রেশনিং ব্যবস্থা বা গণপরিবহন ও আবাসন খাতে প্রণোদনামূলক সহায়তার প্রস্তাব।
বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবায়নের দিক থেকে কার্যকর কোনো দিকনির্দেশনা নেই। জমি বরাদ্দ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যাংক ঋণে অনিয়ম কিংবা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বাজেট এসব সমস্যার সমাধানে তেমন কিছু বলেনি।
ব্যাংক খাত নিয়ে বাজেটের নীরবতা অনেকটাই রহস্যজনক। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও ব্যাংক সংস্কার বা স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স সংকটেও বাজেট নির্লিপ্ত। রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি প্রতিরোধ, ডিজিটাল পেমেন্ট সহজীকরণ বা কার্যকর প্রণোদনার বিষয়ে কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়নি।
বাজেট যেন শুধু অঙ্কের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে—যেখানে কাঠামোগত সংস্কার, প্রশাসনিক দক্ষতা, কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা বা জনআস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো রূপরেখা নেই।
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রয়োজন ছিল একটি রূপান্তরকামী বাজেট, যা হবে তথ্যনির্ভর, বাস্তবভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, রপ্তানিমুখী নীতি সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষা—এই সবকিছু একসঙ্গে কাজ করলেই কেবল বাজেট জাতীয় উন্নয়নের কার্যকর সেতুবন্ধন হতে পারে।