সরকারি নজরদারি আর জবাবদিহিতার অভাবে হাওরে মৎস্য সংকট, সতর্কবার্তা বিশেষজ্ঞদের

‘মৎস্য, পাথর, ধান—সুনামগঞ্জের প্রাণ।’ বহু পুরনো এই প্রবাদ আজও সুনামগঞ্জবাসীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। হাওরনির্ভর এই জেলায় মাছ শুধু খাদ্য নয়—অর্থনীতির চালিকাশক্তি। প্রতি বছর এখানকার হাওর, নদী ও পুকুর মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদিত হয়। কিন্তু সম্প্রতি দেশি মাছের সংকট সুনামগঞ্জের অর্থনীতিকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, সুনামগঞ্জে ১৩৭টি হাওর, ২৬টি নদী ও ২০,৭৬৯টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ২০,২৪৯টি পুকুরে নিয়মিত মাছ চাষ হয়। মাছ আহরণে যুক্ত নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৭৪৩ জন। চলতি অর্থবছরে মাছের বাজারমূল্য ১৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হলেও, তা গত বছরের তুলনায় কম হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে মৎস্য বিভাগ।
স্থানীয় জেলে ও মাছচাষিরা বলছেন, অবাধে ব্যবহৃত কারেন্ট জাল, মা মাছ ও পোনা মাছ আহরণ এবং কৃষিজমিতে ব্যবহৃত সার মিলে মাছের প্রজনন ও বংশবিস্তারে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ফলে টেংরা, বাইম, শিং, টাকি, গজার, শোল প্রভৃতি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
দোয়ারাবাজারের একজন জেলে বলেন, “আগে যেসব দেশি মাছ পেতাম, এখন আর পাই না। কারেন্ট জালের কারণে মাছ কমে গেছে। এভাবে চললে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে।” দিরাইয়ের জেলে শফিকুল ইসলামও জানান, “মাছ এখন খুবই কম। টেংরা-বাইম তো অনেক দিন দেখিই না।”
সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী বিশ্বাস বলেন, “মা মাছ, দম্পতি মাছ ও পোনা আহরণ আইনত দণ্ডনীয়। ‘মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৮৫’-এর বিধি-৭ অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রজনন মৌসুমে এসব মাছ ধরা নিষিদ্ধ।” তবে বাস্তবে আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়ে গেছে বলেও মত দিয়েছেন তিনি।
উত্তর আরপিননগরের ক্রেতা বলেন, “দেশি মাছ এখন কম পাওয়া যায়, দামও অনেক বেশি—৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি। খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কেনা কঠিন।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম বলেন, “হাওরে প্রতিবছর পলি জমে, গভীর পানি থাকে না, যা প্রজননের জন্য জরুরি। হাওরের প্রতিটি উপজেলায় কিছু নির্দিষ্ট অংশে খনন কার্যক্রম চালানো গেলে উৎপাদন বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “টেকসই উৎপাদনের লক্ষ্যে হাওরে বিল নার্সারি, অভয়াশ্রম, উন্নত জাতের পোনা অবমুক্তকরণ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ জরুরি।”
তাহিরপুরের মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান বলেন, “প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে সরকার প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা স্থানীয় চেয়ারম্যান, মৎস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ হবে।”
তবে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জ’ এর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলনের অভিযোগ, “প্রণোদনার কথা বলা হলেও তা খুব কমই বাস্তবে আসে। ইজারাপ্রাপ্তদের নিয়ম মানা তদারকি করতে হবে। স্থায়ী বাঁধে মাছের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
সীমা রানী বিশ্বাস ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের মত অনুযায়ী, মাছের সংকট ঠেকাতে নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ: মা মাছ ও পোনা আহরণ বন্ধে কঠোর নজরদারি, মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষণ ও বিকল্প কর্মসংস্থান, বড় বিল উন্মুক্ত রাখা ও অভয়াশ্রম ঘোষণা, হাওরে পরিকল্পিত খনন ও বাঁধ নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাজার নজরদারি
এই সংকট সামাল দিতে হলে শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের সচেতনতা, এনজিও-ব্যক্তি পর্যায়ের সক্রিয়তা ও কঠোর আইন প্রয়োগ। সময় এখনই। কারণ দেশি মাছ হারালে ক্ষতিটা হবে শুধু অর্থনীতির না—নষ্ট হবে এক চিরায়ত ঐতিহ্যও।