‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, বিচার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে’— চ্যাথাম হাউজে ইউনূস

লন্ডনের চ্যাথাম হাউজ থিঙ্কট্যাঙ্কে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট করেছেন, তার সরকারের দায়িত্ব শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার ভাষায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট তিনটি— প্রতিষ্ঠান সংস্কার, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং অবাধ নির্বাচন।
চ্যাথাম হাউজের রাজকীয় পরিবেশে আয়োজিত এই আলোচনায় ড. ইউনূস বলেন, “প্রায় ১৭ বছর পর দেশের মানুষ একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বাদ পেতে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে এটা হবে প্রথমবারের মতো স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ।”
যুক্তরাজ্য সফরের দ্বিতীয় দিনে যখন ড. ইউনূস চ্যাথাম হাউজে পা রাখেন, বাইরে তখন উত্তপ্ত পরিবেশ। সেন্ট জেমস স্কোয়ারের বিপরীতে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল, বিলি করছিল লিফলেট। কঠোর পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রবেশ নিশ্চিত করা হয়।
তবে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠানকে প্রভাবিত করতে পারেনি। চ্যাথাম হাউজের নির্বাহী পরিচালক ব্রনওয়েন ম্যাডক্সের সঞ্চালনায় ঘন্টাব্যাপী আলোচনায় ড. ইউনূস প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন এবং কিছু বিতর্কিত প্রশ্ন এড়িয়ে যান বলে উল্লেখ রয়েছে উপস্থিত একাধিক বিশ্লেষকের মতামতে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা শুধু নির্বাচন করতে আসিনি। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন আমাদের প্রথম দায়িত্ব— সংস্থা সংস্কার, যার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে।”
দ্বিতীয় দায়িত্ব হিসেবে তিনি বলেন, “জুলাই গণহত্যা এবং অতীতের গুম, নির্যাতনের বিচার শুরু করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক চার্জশিট দেওয়া হবে এবং ভারতের কাছে ফের প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে।”
তৃতীয় ও শেষ দায়িত্ব হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন।”
তবে তিনি স্পষ্ট করেন, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার গঠিত হলে তিনি কিংবা তার কেবিনেটের কেউই সেখানে থাকবেন না।
প্রশ্ন উঠলে ড. ইউনূস জানান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। “বিদেশ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যারা ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভারতের ভূমিকা নিয়েও মন্তব্য করেন ইউনূস। জানান, গত এপ্রিল মাসে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিষয়টি তুলেছিলেন।
“আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলেছিলাম, উনি (হাসিনা) সেখানে বসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছেন। আপনারা তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলুন। জবাবে মোদি বলেছিলেন, ‘এটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, আমরা কীভাবে তাকে থামাব?’ আমি বলেছি, এটাই যদি যুক্তি হয়, তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা স্পষ্ট।”
জিওপলিটিক্যাল বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকার ড. ইউনূসের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলেন, “তিনি চেষ্টা করেছেন পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে যে তাঁর সরকার একটি আদর্শ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। তবে দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ) প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই গণহত্যার বিচার– এই ম্যান্ডেট কিভাবে একটি অ-নির্বাচিত সরকার পেল, সেটি অস্পষ্ট। নির্বাচনের আগেই বিচারের উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ।”
চ্যাথাম হাউজের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্টজন, সাংবাদিক, অ্যাকাডেমিক এবং ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। অনুষ্ঠান শেষে বাইরে কিছু ইউনূস সমর্থক ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি কোয়ালিশন’-এর ব্যানারে স্লোগান দেন।
এর আগে সকাল থেকে যারা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন, পুলিশ তাদের দুপুর নাগাদ সেন্ট জেমস স্কোয়ার থেকে সরিয়ে দেয়।