ফেসবুকে প্রতিবাদ, বরখাস্ত মনিবুল: কণ্ঠরোধের অভিযোগ শিক্ষকের

শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দারের বক্তব্যের প্রতিবাদে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার প্রায় চার মাস পর কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শনিবার (১৭ মে) জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) স্বপন কুমার রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ বরখাস্তের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
কে এই শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া?
মনিবুল হক বসুনীয়া রাজারহাট উপজেলার আবুল কাশেম বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত সোচ্চার। ২০২০ সালে শিক্ষকদের টিফিন ভাতা দৈনিক ৬ দশমিক ৬৬ টাকা নির্ধারণের প্রতিবাদ করে তিনি লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন, যা সে সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
উপদেষ্টার বিতর্কিত বক্তব্য এবং তার প্রতিবাদ
২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দার মন্তব্য করেন:
“আমি শিক্ষকদের বলবো, যদি সমাজে আপনাদের জন্য যে শ্রদ্ধার আসন আছে, সেটা অটুট রাখতে হয় বা ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশাকে অর্থমূল্যে বিবেচনা করা যাবে না... যারা মনে করবেন যে, না আমার তো পোষাচ্ছে না, খুব ভালো, তাহলে আপনি প্রাথমিকে থাকবেন না, অন্য পেশায় চলে যান।”
এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া ওই দিনই (২৬ ফেব্রুয়ারি) নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেন:
“উপদেষ্টা সাহেব, আপনি কোন কোটায় উপদেষ্টা হয়েছেন তা আমার জানা নেই। আপনার কথাবার্তা একদম ফ্যাসিস্ট আমলের মন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।”
বরখাস্তের আদেশে যা বলা হয়েছে
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বরাত দিয়ে বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উপদেষ্টা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিয়ে ‘বিরূপ মন্তব্য’ করেছেন। এ ধরণের পোস্টের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ) এর ৭ (ঘ) ও ১০ (৩) (ছ) অনুচ্ছেদ এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধির পরিপন্থি বিধায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শিক্ষকের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া
ঘটনার বিষয়ে মনিবুল হক বসুনীয়া বলেন, “উপদেষ্টার বক্তব্যে সাধারণ শিক্ষকরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। আমি শিক্ষকদের সংগঠনে নেতৃত্ব দিই। তার বক্তব্য ছিল শিক্ষকদের অবমাননাকর, তাই তার প্রতিবাদ করেছি।”
নিজের পোস্টের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি যা লিখেছি তার সারমর্ম হলো, আপনি (উপদেষ্টা) এভাবে শিক্ষকদের অবমাননা করে কথা বলতে পারেন না। আপনি ডাক্তার মানুষ, নিজের পেশায় ফিরে যান। আমাদের যদি বলা হয় চাকরি ছেড়ে দিন, তাহলে আপনিও নিজের পেশায় ফিরে যান।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “সেই সময়কার একটি বক্তব্যের জন্য এখন আমাকে বরখাস্ত করা হলো কেন? এটা আমার বোধগম্য নয়।”
‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’র কণ্ঠরোধ?
নিজেকে ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’ উল্লেখ করে শিক্ষক মনিবুল বলেন, “জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আমি সরকারি চাকরি ও জীবনের মায়া না করে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। যারা আমাকে চেনেন, তারা জানেন। এখন যদি আমার কণ্ঠরোধ করা হয়, তাহলে বাকিদের কী হবে? আমি নিজের জন্য যতটা না শঙ্কিত, অন্যদের জন্য বেশি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে লিখি। সচিব থেকে শুরু করে এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতির বিরুদ্ধেও লিখেছি, কিন্তু তখন কিছু হয়নি। এখন সমালোচনার কারণে আমাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে—তাহলে ফ্যাসিবাদের পতন কি আদৌ হয়েছে?”
কারণ দর্শানো ছাড়া বরখাস্ত, যাচাইও হয়নি অভিযোগ
এ ঘটনায় বিস্ময়করভাবে শিক্ষক মনিবুলকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়নি। এমনকি অভিযোগ যাচাইও করা হয়নি বলে জানা গেছে। ডিপিইও স্বপন কুমার রায় চৌধুরী জানান, “ফেসবুকে পোস্ট করা নিয়ে তাকে আগে শোকজ করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে, তখন তার কাছে জবাব চাওয়া হবে।”