ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: আরও বিপজ্জনক এক পর্বে প্রবেশ

ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে ২০১৯ সালের যৌথ মহড়া; বর্তমানে এমন দৃশ্য কল্পনাও করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০১৯ সালে সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষীদের যৌথ মহড়া ছিল ঐতিহাসিক এক দৃশ্য, যা এখন অতীত। সম্প্রতি সংঘাতের যে ধারা শুরু হয়েছে, তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন ও আরও বিপজ্জনক এক পর্বে ঠেলে দিয়েছে।
বিশ্বপ্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব অনেক সময় কাশ্মীরকেন্দ্রিক ও ধর্মীয় ভিন্নতাজনিত বিবাদ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন বলেছিলেন, ‘কাশ্মীরে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলছে’। যদিও এই বিবৃতি অতিরঞ্জিত, তবে দুই দেশের ইতিহাসে সংঘর্ষ, যুদ্ধ, এবং পরে কূটনৈতিক সমাধানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র বহুবার মধ্যস্থতা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
তবে সেই চক্রভঙ্গ এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। গত মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর নতুন করে সামরিক উত্তেজনা শুরু হয়। এবার সেই উত্তেজনা দ্রুত সংঘাতে রূপ নেয়। এতে স্পষ্ট হয়েছে, দুই দেশের দ্বন্দ্ব এখন আর পূর্বের মতো নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
ভিন্নমুখী পথ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের আত্মপরিচয়কে প্রাচীন সভ্যতার গৌরব হিসেবে তুলে ধরতে চান। এর ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান ও সন্ত্রাসবাদের প্রতি সন্দেহকে কেন্দ্র করে ভারতের কূটনীতিতে আপসহীন মনোভাব তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানকে শুধু প্রতিবেশী নয়, এক বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত, সেনাবাহিনীই মূল ক্ষমতার অধিকারী। তারা এখন চীনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকছে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সেখানে দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে আপসে আগ্রহী নয়—বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে।
মোদির কৌশলগত পরিবর্তন
মোদির নেতৃত্বে ভারত আগের কৌশল পাল্টে গোপন অভিযান ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে হামলার নীতি গ্রহণ করেছে। পাকিস্তান যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা সংযত অবস্থান নিয়েছে, ভারত কিন্তু একতরফা চাপ প্রয়োগের কৌশলে এগোচ্ছে। এই দীর্ঘমেয়াদি চাপ পাকিস্তানের জন্য কৌশলগতভাবে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে এখন পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে মনে করা হচ্ছে, এবং অনেকে প্রকাশ্যে বলছেন, পাকিস্তানকে কার্যকরভাবে ধ্বংসের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
মধ্যস্থতার অভাব
একসময় যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী ছিল। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ, ২০০১ সালে সংসদ হামলা কিংবা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমানে সেই ভূমিকা ফিকে হয়ে এসেছে।
বাইডেন প্রশাসন ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে, ফলে ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোযোগ ছিল বাণিজ্য, ইউক্রেন, গাজা ও ইরান ইস্যুতে। তদুপরি, ভারত এখন তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখে, আর পাকিস্তান পশ্চিমাদের ভারতপ্রীতি নিয়ে সন্দিহান।
ভবিষ্যতের শঙ্কা
এই সংঘাতের ফলে যে রক্ষাকবচগুলো এতদিন সংঘর্ষ প্রতিরোধে কাজ করত, সেগুলো এখন অকার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তান একে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমান’ বলে উল্লেখ করেছে এবং ১৯৭২ সালের সীমান্ত চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি এই অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতে চায়, তবে ভারসাম্য বজায় রেখে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে হবে। ভারতের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব কৌশলগতভাবে ক্ষতিকর হবে, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বময় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
উপসংহার
ভারত-পাকিস্তান বর্তমানে এমন এক বাস্তবতায় পৌঁছেছে, যেখানে দুই দেশের সম্পর্ক এখন সংঘাতময় এবং কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্যও এটি উদ্বেগজনক—কারণ, যেকোনো উত্তেজনা বৃহৎ বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।
আসফান্দয়ার মির
জ্যেষ্ঠ ফেলো, দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচি, স্টিমসন সেন্টার, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।