বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৪ ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের নাজাতই ছিল যাঁর ধ্যানজ্ঞান

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

 প্রকাশিত: ২৩:৪১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের নাজাতই ছিল যাঁর ধ্যানজ্ঞান

আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামসঙ্গে পুত্র ইসমাঈল। কাবা শরীফ নির্মাণ সমাপ্ত করলেনদুজনে মিলে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের হৃদয়-সমুদ্রে তরঙ্গ এল। আরজি পেশ করলেন ঘরের মালিকের নিকট-

رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا  اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ رَبَّنَا وَ اجْعَلْنَا مُسْلِمَیْنِ لَكَ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَ اَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَ تُبْ عَلَیْنَا  اِنَّكَ اَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِیْمُ رَبَّنَا وَ ابْعَثْ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِكَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ یُزَكِّیْهِمْ  اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ۠.

আয় আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে (এই ক্ষুদ্র নিবেদনটুকু) কবুল করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই মহান শ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আপনার একান্ত অনুগত বানিয়ে নিন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যেও এমন উম্মত সৃষ্টি করুনযারা আপনার একান্ত অনুগত হবে এবং আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের পদ্ধতি শিক্ষা দিন এবং আমাদের তওবা কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি এবং কেবল আপনিই ক্ষমাপ্রবণ (এবং) অতিশয় দয়ার মালিক।

হে পরওয়ারদেগার! তাদের (আমার উত্তরসূরিদের) মধ্যে এমন একজন রাসূলও প্রেরণ করুনযে তাদেরই মধ্য থেকে হবে এবং যে তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেতাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয়ই আপনার এবং কেবল আপনারই সত্তা এমনযাঁর ক্ষমতা পরিপূর্ণপ্রজ্ঞাও পরিপূর্ণ। -সূরা বাকারা (২) : ১২৭-১২৯

আল্লাহ শুনলেন বন্ধু ইবরাহীমের রোনাজারী। প্রেরণ করলেন এক মহান শিশু। নবী ইসমাঈলেরই ঔরসে। সেই কাবা প্রান্তরেইমক্কা নগরীতে। তিনি রহমতনূর ও জ্যোতি। তিনি পথপ্রদর্শকসত্যের দিশারী। সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী। তিনি বাশীর ও নাযীর। তিনি গরীবের বন্ধুঅসহায়ের সহায়। অত্যাচারিতের আশ্রয় ও বঞ্চিতের ঠিকানা। তিনি মাহবুবে খোদাসত্য ও ন্যায়ের বাদশাহজুলুম নিপাতকারী এবং উত্তম আচরণ প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি জাতির আদর্শ শিক্ষকউম্মতের প্রকৃত রাহবার। তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানবআদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি উম্মতের মহান মুহসিনশাফাআতের নবী এবং আখেরী রাসূল। তিনি...। তিনি...। তিনি আর কেউ ননআমার তোমার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েতসত্যকিতাব এবং প্রমাণ নিয়ে। তাঁর আবির্ভাব আমাদের জন্য এক মহা নিআমত। মহান রবের মহান ইহসান। আল্লাহ বলেন-

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ . وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.

বাস্তবিকপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন- তিনি তাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরই মধ্য থেকেযিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেনতাদেরকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। আর তারা এর পূর্বে ছিল স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪

শোকর তোমার হে দয়াময়ভ্রষ্টতা থেকে আলোর পথে এনে সেই নবীর উম্মতের কাতারে শামিল করেছ বলে।

নবীজী ছিলেন উম্মতের হেদায়েতনাজাত ও মুক্তির জন্য সদা বিভোর। উম্মতের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর জীবনের সবকিছু। উম্মত কীভাবে অশান্তি থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে চির শান্তি ও সফলতা লাভ করতে পারেকীভবে কুফর শিরক ও গোমরাহী থেকে মুক্তি পেয়ে ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত হতে পারে- এ নিয়ে ছিল তাঁর দিলে ভীষণ তড়প।

কুরআনে কারীমে নবীজীর এ অবস্থার চিত্রায়ণ হয়েছে অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায়। আল্লাহ তাআলা প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেন-

لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ اَلَّا یَكُوْنُوْا مُؤْمِنِیْن.

(হে রাসূল!) তারা ঈমান (কেন) আনছে নাএই দুঃখে মনে হচ্ছে আপনি নিজেকে শেষ করে ফেলবেন! -সূরা শুআরা (২৬) : ৩

হাঁতিনি সেই নবীযিনি উম্মতের হেদায়েত ও নাজাতের জন্য নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন।

এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারি নবীজীর তায়েফ সফরের দৃশ্যগুলো। সীরাতের সাধারণ পাঠকেরও জানা আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাওহীদ ও ঈমানের দাওয়াত নিয়ে তায়েফে গমন করেন তখন তাঁর উপর দিয়ে কতটা নিষ্ঠুরতা বয়ে যায়! আঘাতে আঘাতে তাঁকে কতটা নির্মমভাবে রক্তাক্ত করা হয়! হৈ হুল্লোড় ও অশ্রাব্য বাক্যবাণে তাঁকে কতটা হেনস্তা করা হয়! উম্মতের হেদায়েতের খাতিরে নবীজী সব সয়ে গেছেন। কিন্তু আসমানের মালিকের তা সহ্য হয়নি। পাঠিয়ে দিয়েছেন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে দলবলসহ।

জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে বললেনইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জাতি আপনার সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে আল্লাহ তাআলা সব দেখেছেন। এই দেখুন আমার সাথে রয়েছে পাহাড়ের ফেরেশতা। আপনি তাদেরকে যেভাবে শায়েস্তা করতে বলবেন ফেরেশতারা তাই করবে।

এরপর এলেন পাহাড়ের ফেরেশতা। নবীজীকে সালাম করে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! যা কিছু ঘটে গেল আল্লাহ তাআলা সব দেখেছেন। এখন আমি এসেছি। আপনি আমাকে যেভাবে হুকুম করবেন সেভাবেই করব। আপনি যদি চান তাহলে দুই পাহাড়কে একত্র করে তাদেরকে পিষ্ট করে দিব?

রহমতের নবীর দয়া এখানেও প্রবল থাকল। বললেন-

بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ، لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا.

(না,) বরং আমি তো আশা রাখিআল্লাহ তাআলা এদের প্রজন্মকে তাওহীদের জন্য কবুল করবেন। তারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে। তার সাথে আর কাউকে শরীক করবে না। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩২৩১সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭৯৫) 

উহুদের প্রান্তরে তার সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথাটা স্মরণ করুন তো! নবীজীর দেহ মোবারক থেকে অঝোরে খুন প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁর দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছে! তাঁর মাথা মোবারক ক্ষত বিক্ষত হয়েছে! তাঁর চোখের সামনে ঝরে যাচ্ছে প্রিয় সাহাবীদের তাজা প্রাণগুলো। আপন প্রিয় চাচা হামযা রা.-ও শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক বসিয়েছেন। গাসীলুল মালা-ইকা (ফিরিশতাগণ যার লাশের গোসল দিয়েছেন) হযরত হানযালাও নেই। জান্নাতের সুগন্ধিপ্রাপ্ত আনাস ইবনু নযর রা.-ও নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন। অবশেষে যার লাশ শনাক্ত হয়েছে তার আঙ্গুলের কর দেখে। নবীজীকে ঘিরে রেখেছেন তাঁর জানবায সঙ্গীরা। আনসার ও মুহাজির সাহাবীদের একটি জামাত। প্রিয় নবীকে রক্ষা করতে তারা নিজেদেরকে ঢাল হিসাবে এগিয়ে দিচ্ছেন আর একে একে শাহাদাতের সুধা পান করে যাচ্ছেন। এগুলো সব ঘটে যাচ্ছে নবীজীর চোখের সামনে। নবীজী নিজ সম্প্রদায়ের এহেন আচরণে আক্ষেপ করে বলছেন-

كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ، وَكَسَرُوا رَبَاعِيَتَهُ، وَهُوَ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ؟

হায়সে জাতি সফল হবে কী করে যারা স্বীয় নবীকে ক্ষত-বিক্ষত করে?! নবীর দাঁত ভেঙ্গে দেয়?! অথচ নবী তো তাদেরকে কেবল আল্লাহর দিকেই ডাকছেন!

আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে নবীজীকে সান্ত¡না দিয়ে বলছেন-

لَیْسَ لَكَ مِنَ الْاَمْرِ شَیْءٌ اَوْ یَتُوْبَ عَلَیْهِمْ اَوْ یُعَذِّبَهُمْ فَاِنَّهُمْ ظٰلِمُوْنَ.

আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেননাকি তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এ বিষয়ে আপনার কিছু করার নেই। কারণ তারা জালিম। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১২৮

এই মর্মান্তিক মুহূর্তেও নবীজীর আহাজারী ছিল-

رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِي فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ.

ওগো রবআমার কওমকে ক্ষমা কর। তারা তো বোঝে না। [দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭৯১১৭৯২ (বাবু গাযওয়াতি উহুদ বিস্তারিত দ্রষ্টব্য)সহীহ বুখারীহাদীস ৪০৭০]

জীরহমতের নবী এ কঠিন মুহূর্তেও নিজ কওমের মাগফিরাত ও হেদায়েতের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত! উম্মতের জন্য নবীজীর দিলের দরদ ও ব্যাকুলতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. -এর রেওয়ায়েতটি লক্ষ্য করুন-

আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আ. অত্যন্ত দয়ার্দ্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। কুরআন মাজীদে তাঁর অনেক দুআ উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে-

رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ  فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ  وَ مَنْ عَصَانِیْ فَاِنَّكَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

হে আমার প্রতিপালক! ওইসব প্রতিমা বিপুল সংখ্যক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং যে-ই আমার অনুসরণ করবেসে তো আমার দলভুক্ত হলই। আর কেউ আমাকে অমান্য করলে (তার বিষয়টা আমি আপনার উপর ছেড়ে দিচ্ছি)আপনি অতি ক্ষমাশীলপরম দয়ালু। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৬

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি একবার এই আয়াত তিলাওয়াত করেন। এরপর তিলাওয়াত করেন হযরত ঈসা আ. স্বীয় উম্মতের ক্ষেত্রে যে দুআ করেছেন সে আয়াত-

اِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ  وَ اِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ.

(আয় আল্লাহ!) যদি আপনি তাদেরকে  শাস্তি দেনতবে তো তারা আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেনতবে নিশ্চয়ই আপনিই মহা ক্ষমতাবানপ্রজ্ঞাময়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১১৮

এই দুই আয়াত তিলাওয়াত করে নবীজী আপ্লুত হয়ে পড়েন। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকেন-

اللهُمَّ أُمَّتِي أُمَّتِي.

আয় আল্লাহ! আমার উম্মত!! আয় আল্লাহ! আমার উম্মত!! তাদের কী দশা হবে!

এভাবে উম্মতী উম্মতী বলে নবীজী দুআ করছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। আল্লাহ তাআলা তো সবকিছুই দেখছেন। তবুও হযরত জিবরীল আ.-কে ডেকে পাঠালেন- জিবরীল দেখো তো আমার হাবীবের কী হয়েছে! সে এভাবে কাঁদছে কেন?

জিবরীল আমীন এসে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কাঁদছেন কেন?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিলের হালত পেশ করলেন- আমার উম্মতের কী হবেআমার উম্মতের কী হবে?

আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরীল আ.-কে বললেন-

يَا جِبْرِيلُ، اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ، فَقُلْ: إِنَّا سَنُرْضِيكَ فِي أُمَّتِكَ، وَلَا نَسُوءُكَ.

জিবরীল! তুমি মুহাম্মাদকে গিয়ে বলআমি অবশ্যই আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দেব। আমি আপনাকে লজ্জিত করব না। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিমহাদীস ৩৪৬)

আল্লাহ তাআলা সূরা দুহায় যে বলেছেন-

وَ لَسَوْفَ یُعْطِیْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰی .

অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে এত দেবেন যেতুমি খুশি হয়ে যাবে। -সূরা দুহা (৯৩) : ৫

এর একটি মর্ম এ-ও যেআল্লাহ তাআলা কিয়ামতের ময়দানে নবীজীর শাফাআত কবুল করবেন। তাঁর শাফাআতের মাধ্যমে বহু জাহান্নামীকে মুক্ত করে জান্নাত দান করবেন। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত আনন্দিত হবেন।

আল্লাহু আকবারইনি হলেন আমাদের নবীজীযিনি কিয়ামতের সেই দুর্দিনেও উম্মত কীভাবে নিষ্কৃতি লাভ করবে সেই চিন্তায় অস্থির থাকবেন। কিয়ামতের সেই কঠিন দুর্যোগে যখন সবাই শুধু নিজের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকবে। ভাই তার ভাই থেকে পলায়ন করবে। মা সন্তানকে ভুলে থাকবে। স্বামী স্ত্রী থেকে পালিয়ে বেড়াবে। বিপদের সেই কঠিন মুহূর্তে উম্মতের জন্য একমাত্র যিনি ব্যাকুল থাকবেন তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেই দিনের বিবরণ শুনি খোদ নববী যবানে-

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতনবীজী বলেনকিয়ামতের দিন যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হবেন তিনি হচ্ছি আমি। তা কী জন্যে জানোকিয়ামতের দিন পৃথিবীর শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ হবে আল্লাহ তাআলা সবাইকে এক মাঠে একত্র করবেন। তাদেরকে এক শব্দে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সবাই থাকবে চোখে চোখে। সূর্য নিকটবর্তী করা হবে। মানুষ পেরেশানীতে অস্থির হয়ে পড়বে। সেই মহা বিপদ সইবার মতো নয়। লোকেরা একে অপরকে বলবেদেখ না আমরা কী কঠিন অবস্থায় আছিচলো দেখি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে কে সুপারিশ করতে পারেনএকে অপরকে বলবেচল আমরা হযরত আদম আ.-এর কাছে যাই।

তারা সবাই হযরত আদম আ.-এর কাছে যাবে। গিয়ে বলবেআপনি তো সবার বাবা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। আপনার ভেতর তিনি রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। ফিরিশতাদের তিনি হুকুম করেছেন আপনাকে সিজদা করতে। তারা  আপনাকে সিজদা করেছে। আমাদের আজ কী কঠিন অবস্থা তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য একটু সুপারিশ করুন!

আদম আ. বলবেনআমার রব এত ভীষণ রেগে আছেনএর আগে কোনোদিন তিনি এতটা রেগে থাকেননি এবং ভবিষ্যতেও এরকম আর রাগবেন না। তিনি আমাকে গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আমি আল্লাহর হুকুম রক্ষা করিনি। নফসীনফসী! হায়এখন আমার কী দশা হবে!! আমার কী দশা হবে!!

তোমরা অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা নূহের কাছে যাও।

হযরত আদম আ.-এর কথা মতো তারা হযরত নূহ আ.-এর কাছে যাবে। গিয়ে বলবেআপনি এই জমিনে প্রথম রাসূল। আল্লাহ আপনার প্রশংসা করেছেন কৃতজ্ঞ বান্দা হিসাবে। আপনি একটু আমাদের জন্য সুপারিশ করুন! আমাদের অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

এ আবদার শুনে তিনি বলবেনআমার রব এতটা রেগে আছেনএর আগে কোনোদিন তিনি এতটা রেগে থাকেননি এবং ভবিষ্যতেও এরকম আর রাগবেন না। আমি তো আমার কওমের বিরুদ্ধে বদদুআ করেছিলাম। নফসীনফসী! হায়এখন আমার কী হবে!!

 তোমরা বরং ইবরাহীমের কাছে যাও।

সে মতে সবাই হযরত ইবরাহীম আ.-এর কাছে যাবে। গিয়ে বলবেআপনি জমিনে আল্লাহর প্রিয় নবী এবং প্রিয় বন্ধু (খলীল) ছিলেন! আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য একটু সুপারিশ করে দিন! আমাদের অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

ইবরাহীম আ. বলবেনআমার রব এতটা রেগে আছেনএর আগে কোনোদিন তিনি এতটা রেগে থাকেননি এবং ভবিষ্যতেও এরকম আর রাগবেন না। তিনিও নিজের ওজর পেশ করে বলতে থাকবেননফসীনফসী! হায়আমার এখন কী হবে!! হায়আমার এখন কী হবে!!

তোমরা বরং অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা মূসার কাছে যাও।

সবাই আসবে হযরত মূসা আ.-এর নিকট। বলবেআল্লাহ তো আপনাকে রিসালাত দিয়ে সম্মানিত করেছেন এবং আপনি আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলতেন। আমাদের জন্য আপনি আল্লাহর কাছে একটু সুপারিশ করুন! আমাদের বিপদ তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

এ কথা শুনে হযরত মূসা আ. বলবেনআমার রব এতটা রেগে আছেনএর আগে কোনোদিন তিনি এতটা রেগে থাকেননি এবং ভবিষ্যতেও এরকম আর রাগবেন না। আমার হাতে তো একজন মারা পড়েছিল। নফসীনফসী! হায়আমার এখন কী হবে!! হায়আমার কী দশা হবে!!

তোমরা ঈসার কাছে যাও।

সে মতে তারা হযরত ঈসা আ.-এর কাছে যাবে। গিয়ে বলবেআপনি আল্লাহর রাসূল। আপনি কোলে থাকতেই কথা বলেছেন। আপনার আম্মাজানের মাঝে তো আল্লাহ আপনার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলেন। আমাদের জন্য আপনি আল্লাহর কাছে একটু সুপারিশ করুন! আমাদের মসিবত তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

এ কথা শুনে হযরত ঈসা আ. বলবেনআমার রব এতটা রেগে আছেনএর আগে কোনোদিন তিনি এতটা রেগে থাকেননি এবং ভবিষ্যতেও এরকম আর রাগবেন না। নফসীনফসী! হায়আমার কী হবে!! আমার এখন কী হবে!!

বরং তোমরা মুহাম্মাদের কাছে যাও।

নবীজী বলেনতারপর সবাই আমার কাছে আসবে। বলবেআপনি আল্লাহর রাসূল। সর্বশেষ নবী। আল্লাহ পাক আপনার জীবনের পূর্বা-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আমাদের জন্য আপনি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করুন! আমাদের যে কী কঠিন মসিবত যাচ্ছে তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

নবীজী বলেনতখন আমি আরশের নীচে গিয়ে আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ব। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা শুরু করব। এমন ভাষায় প্রশংসা করবযে ভাষায় অন্য কেউ কোনোদিন আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা সেই প্রশংসার ভাষা আমার অন্তরে ঢেলে দেবেন। আমি আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকব। আমাকে বলা হবেমুহাম্মাদ! মাথা তোলো। তুমি যা চাইবে দেওয়া হবে। তুমি সুপারিশ করবে তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।

আমি বলবইয়া রব! উম্মতী উম্মতী!! আমার উম্মতের কী হবে! আমার উম্মতের কী হবে! আপনি আমার উম্মতের নাজাতের ফয়সালা করুন।

এরপর নবীজী তাঁর উম্মতকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে থাকবেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিমহাদীস ৩২৭)

সুবহানাল্লাহিল আযীম! ইনি হচ্ছেন আমাদের নবীযিনি দুনিয়াতে উম্মতের জন্য হেদায়েতের ফিকির করেছেন। তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিতে গিয়ে যারপরনাই কষ্ট সয়েছেন। আর হাশরের ময়দানের কঠিন সেই দুর্যোগে যখন সবাই নফসী নফসী করতে থাকবে তখন একমাত্র সেই নবীর যবানেই উচ্চারিত হতে থাকবে উম্মতী উম্মতী। নবীজী বলেন-

لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ يَدْعُوهَا، فَأُرِيدُ أَنْ أَخْتَبِئَ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

প্রত্যেক নবীরই একটি দুআ বিশেষভাবে কবুল হয়। সকল নবীই তা করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি আমার সেই দুআ রেখে দিয়েছি- কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্যে। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৮

নবীজী আরো বলেন-

شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي.

আমার শাফাআত হচ্ছে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহ করে ফেলেছে এমন ব্যক্তিদের জন্য। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৭৩৯জামে তিরমিযীহাদীস ২৪৩৫

কুরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীবের পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্নভাবে। আল্লাহ বলেন-

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِیَ اللهُ  لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ  عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِیْمِ.

তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকেই রাসূল আগমন করেছেনতোমাদের কষ্ট যার নিকট অসহনীয়যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য ব্যাকুলযিনি মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশপরম মমতাবান। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়তবে (হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দাওআমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তাঁরই উপর আমি ভরসা করেছি এবং তিনি মহা আরশের মালিক। -সূরা তাওবা (৯) : ১২৮-১২৯

লক্ষ করুনপ্রিয় হাবীবের শানে আল্লাহ তাআলার শব্দচয়ন হচ্ছে-

عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ.

তোমাদের কষ্ট যার কাছে অসহনীয়যিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য ব্যাকুল, ...

বস্তুত নবীজীর গোটা জীবনটাই ছিল এই আয়াতের বহিঃপ্রকাশ। তিনি উম্মতের কল্যাণ কামনায় কতটা ব্যাকুল ছিলেনউম্মতের হেদায়েত ও নাজাতের জন্য কতটা বিভোর থাকতেন তারই কিছু ছটা এখানে বিকরিত হল। নববী যিন্দেগীর পরতে পরতে সীরাত ও সুন্নাহ্র পাঠক যার নজীর অহরহই দেখতে পান।

পরিশেষে আয়াতের শেষাংশটি সবিশেষ খেয়াল করার মতো। আল্লাহ তাআলা বলছেন-

فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِیَ اللهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ  عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِیْمِ۠.

তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়তবে (হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দাওআমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তাঁরই উপর আমি ভরসা করেছি এবং তিনি মহা আরশের মালিক।

অতএব গোটা পৃথিবীবাসীও যদি নবীজীকে ছেড়ে দেয় নবীজীর তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি তো তিনিযাঁর প্রশংসা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন করেছেন। তাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। স্বয়ং আল্লাহ এবং পুত পবিত্র  ফেরেশতাদের জামাত যাঁর উপর দরূদ ও সালাম পেশ করেন। যাঁর প্রতি দরূদ পেশ করতে হুকুম করা হয়েছে বিশ্ববাসীকে।

ধন্য সেযে নবীজীর এ দরদ ও ব্যাকুলতার কদর করল। তাঁর আনীত দ্বীন কবুল করল। তা প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করল। তাঁর রেখে যাওয়া আমানতের হেফাযত করল। তাঁর ইজ্জত রক্ষায় নিবেদিত হল।

সফল সেযে তাঁর সুন্নত আঁকড়ে ধরল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁকে এবং একমাত্র তাঁকেই উসওয়া ও আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করল।

সৌভাগ্যবান সেযে নিজের মা-বাবাসন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের জীবন থেকেও নবীজীকে ভালবাসতে পারল।

ইয়া রাব্বাল আলামীন! কিয়ামতের সেই কঠিন বিপদে তোমার হাবীবের শাফাআতের আশায়-

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيد.

মন্তব্য করুন: