জুলাই বিপ্লব: ত্যাগের প্রতিদান দিতে পারবে তো বাংলাদেশ?

জুলাই বিপ্লবের সূচনা
জুলাই বিপ্লব বলতে, ২০২৪ এর কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বোঝানো হয়। তবে এই আন্দোলনের সূচনা মূলত ২০১৮ সালে, তখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় যার প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে চলমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করা, যা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আন্দোলনের পক্ষে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এবং বিপক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সম-মতাবলম্বী সংগঠনসমূহ। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের চাপে সরকার কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়।
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে, ২০২১ সালে চ্যালেঞ্জ করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, অহিদুল ইসলামসহ, হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। অবশেষে, ২০২৪ সালের ৫ জুন, হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ কোটাব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় প্রকাশের পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেন। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ শিক্ষার্থীরা তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে। মিছিলে শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” সহ বিভিন্ন স্লোগান দেয়। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ মিছিলের স্লোগানকে কেন্দ্র করে, ১৫ জুলাই সরকারে বিভিন্ন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও কর্মকর্তা, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ তোলেন এবং ক্ষমাতাসীন সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম হামলা করা হয়। হামলায় তারা লাঠি, রড়, হক স্টিক, আগ্নেয়াস্ত্র, রামদাসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করেন। একইদিনে পুলিশও আন্দোলন কারীদের উপর লাঠিচার্জ করে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নামে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দমাতে রাবার বুলেট, লাঠি, জলকামান, টিয়ার গ্যাস দিয়ে হামলা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের আনাচে কানাচের সকল শ্রেণির মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। আন্দোলন থামাতে সরকার কারফিউ জারি, ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন করা, সেনাবাহিনী মোতায়েন, ১৪৪ ধারা জারি, গণ গ্রেফতার সহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে কার্যত ব্যর্থ হয় বরং এর ফলে ব্যাপক জনরোষ তেরি হয়। সরকারের এইসব পদক্ষেপের কারণে প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী আহত সহ ৬৭৩ জন নিহত হন এবং প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়।
২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে ও সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। অনেক শিক্ষার্থী মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের হার বৃদ্ধিকে স্বাগত জানালেও, পূর্ববর্তী আন্দোলনে সহপাঠীদের মৃত্যুর জন্য বিচার ও দায়ীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে আন্দোলন চলমান রাখেন এবং ধারাবাহিক কর্মসূচী ঘোষণা অব্যহত রাখে। শিক্ষার্থীরা ২৯ জুলাই হত্যার বিচারের দাবিতে ৯ দফা দাবি জানান। ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ৪ আগস্ট থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতা ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সমবেত হন। আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্যে একদফা দাবি ঘোষণা করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি আরো বলেন, "আমরা এখনও আগস্টে যাইনি, এই জুলাই হত্যার বিচার করেই আমরা আগস্টে যাব। ফলে আন্দোলনটি "জুলাই বিপ্লব" বলে খ্যাতি পায়। ছাত্র-জনতার ধারাবাহিক কর্মসূচি ও আন্দোলনের মুখে এবং লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি চলমান সময়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়।
সর্বজন গ্রহণযোগ্যতার কারণ ও মূল চালিকাশক্তি
বিগত তিন মেয়াদে শাসক দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থপাচার, এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল। দেশের অর্থনীতির ক্রমাবনতি, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ব্যাংকিংখাতে ঋণ কেলেঙ্কারি, এবং বৈষম্যমূলক নীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছিল। জনসাধারণের ক্ষোভ ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, কিন্তু সরকার দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে রেখেছিল। বিরুদ্ধ মতাবলম্বী দল, সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম, গুম এবং হত্যা চালানো হচ্ছিল। জুলাই বিপ্লব-২৪ এর মাধ্যবে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ পায় জনগণ।
এই আন্দোলন কোটা সংস্কার দাবিতে শুরু হলেও সরকারের স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে আন্দোলন দমনের চেষ্টার কারণে তা আর নির্দিষ্ট দাবির পরিসীমায় সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংস্কারের দাবিতে এক সর্বাত্মক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এই বিপ্লব কেন সর্বজনগ্রহণযোগ্য হলো এবং এর মূল চালিকাশক্তি কী ছিল, তার কিছূ কারণ:
১। ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি: বিপ্লব মূলত শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবির মাধ্যমে শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাব্যবস্থা নিয়ে নানা অসন্তোষ ছিল। শিক্ষার্থীরা মূলত যোগ্যতার ভিত্তিতে সমতার দাবিতে আন্দোলনে নামে। এই দাবি সমাজের বিশাল অংশের মানুষের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে, কারণ এটি একটি ন্যায্য ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলছিল।
২। নেতৃত্বের নতুন দৃষ্টান্ত: ইতিহাসের অন্যান্য বিপ্লবের তুলনায় জুলাই বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর নেতৃত্বের ধরন। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়নি; বরং একদল তরুণ শিক্ষার্থীই এ বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি ছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই তরুণদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তারা সকল রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে থেকে কেবল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই আন্দোলন পরিচালনা করেছে।
৩। সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ: শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধীরে ধীরে শ্রমিক, চাকরিজীবী, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষের সংহতি অর্জন করে। এটি কেবল একটি ছাত্র আন্দোলন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে গণজাগরণে রূপ নেয়। বিশেষ করে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
৪। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়া: সরকার শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলন দমন করতে বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়, যা জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। পুলিশের গুলিতে একাধিক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ায় এবং দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকায় সাধারণ জনগণ আন্দোলনের প্রতি আরও সংহতি প্রকাশ করে। ইতিহাস সাক্ষী যে, যখন কোনো রাষ্ট্র আন্দোলন দমন করতে বলপ্রয়োগ করে, তখন তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লবেও ঠিক তাই ঘটেছে।
৫। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা: প্রথাগত গণমাধ্যম অনেক সময় সরকারি চাপে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে পারেনি, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আন্দোলনের অন্যতম বড় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনের বাস্তব চিত্র প্রচারিত হওয়ায় এটি দ্রুত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ প্রতিটি ঘটনার আপডেট পেয়ে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে থাকে।
৬। নতুন রাজনৈতিক চেতনার জন্ম: জুলাই বিপ্লব শুধু একটি নির্দিষ্ট দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলে। আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শিক্ষার্থীরা কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের কথা বলেননি, বরং তারা সমাজের প্রতিটি স্তরে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাদের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন ছিল।
৭। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জনবিপ্লবের ধারা: বাংলাদেশের বিগত বিভিন্ন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জুলাই বিপ্লবের একটি মিল পাওয়া যায়। যেমন, ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন, ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলন—এসব আন্দোলনেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তবে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম ব্যতিক্রমী দিক হলো এটি মূলত ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে এবং এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল গৌণ।
জুলাই বিপ্লবের ফলে লাভবান কারা
২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। দেশের শাসন ক্ষমতা যখন আওয়ামী লীগ থেকে চলে যায়, তখন দুটি রাজনৈতিক দল—বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী—বিনামূল্যে লাভবান হয়েছে এবং তারা দেশজুড়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি অন্যান্য দল ও সাধারণ মানুষ মত প্রকাশের অধিকার ফিরে পেয়েছে।
১। বিএনপি: শেখ হাসিনার শাসনকালে, বিএনপির অনেক নেতাই পালিয়ে ছিলেন কিংবা বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত ছিলেন এমনকি হত্যা, গুমের স্বীকর হন। বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ইলিয়াস আলী সহ অনেকেই গুম ও হত্যার স্বীকর হন। তবে ৫ই অগাস্টের পর, যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখন বিএনপির নেতারা দ্রুত নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে খালেদা জিয়া মুক্তি পান এবং অনেক সিনিয়র নেতা জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন সাজা থেকে খালাস পেয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও। বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা অনেকাংশে খারিজ হয়ে যায়, এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞাও শিথিল হয়। এমনকি, লন্ডনে বসবাসরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্যও এখন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, যা আগে নিষিদ্ধ ছিল।
এমন এক পরিস্থিতিতে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না, এবং তাদের রাজনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনকালে বিএনপির কাছে ‘ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ এখন সেই তকমা বহন করছে, যা তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে আরো তীব্র করেছে।
২। জামায়াতে ইসলামী: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামীও নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকার বিরোধী অবস্থানে থাকা জামায়াতের নেতারা, বিশেষত তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, রাজনৈতিক মঞ্চে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের কর্মসূচি এবং মিছিল এখন প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কমিটিও ঘোষণা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার শাসনকালে, বিচারের নামে জামায়াতের ১১ শীর্ষ নেতা হত্যার স্বীকার হয়েছে এবং জামায়াত ছিল কার্যত নিষিদ্ধ, তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। জামায়াত নেতাদের বক্তব্য এবং কার্যক্রমেও পরিবর্তন এসেছে, যা রাজনৈতিক পরিসরে তাদের নতুন কৌশলের দিকে ইঙ্গিত করে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য, যেমন ‘ক্ষমতায় এলে নারীদের পোশাক নিয়ে বাধ্য করা হবে না’ এবং ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী কখনো আপস করেনি’, তাদের নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
৩। সাধারণ জনগণ: জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সক্ষম হচ্ছে। জনগণকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের জন্য বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগও পাচ্ছে।
৪। ছাত্রসমাজ: ছাত্রসমাজ ছিল আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। তারা স্বাধীনতার জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিবেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা, এবং শিক্ষা খাতে আধুনিক সংস্কারের দাবী করা সহ স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে যা একটা সময়ে ছিলনা। যে সকল শিক্ষার্থী মতপ্রকাশের চেষ্টা করেছে তারা ক্ষমতাসীন সংগঠন ছাত্রলীগের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত এবং শহীদ হওয়া অন্যতম একজন শিক্ষার্থী ছিল বুয়েটের আবরার ফাহাদ, যাকে তার মতপ্রকাশের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এই বিপ্লবের ফলে ছাত্রদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতিতে শক্ত ভূমিকা রাখার পরিকল্পনা করছে।
৫। স্বাধীন গণমাধ্যম ও নাগরিক সাংবাদিকরা: স্বাধীন গণমাধ্যম এবং নাগরিক সাংবাদিকরা এই বিপ্লবের অন্যতম লাভবান শ্রেণী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের নির্ভীক তথ্য প্রচারের পথ সুগম করেছে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায়, যেটি বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে জনগণকে সঠিক তথ্য সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে। গণমাধ্যমে আরো খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশে সাহায্য করেছে। আওয়ামী আমলে নিষিদ্ধ পত্রিকা ”আমার দেশ” নতুন করে পথ চলার সুযোগ পেয়েছে।
৬। সরকারি চাকুরীজীবি ও আমলা: অনেক সরকারি চাকুরীজীবি ও আমলা বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকের চাকুরী চলে গেছে, অনেকের পদায়ন বন্ধ ছিল। জুলাই বিপ্লবের ফলে এই শ্রেণীর মানুষজন অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন। তারা এখন তাদের পদ ও মর্যাদা ফিরে পেয়েছেন। অনেকে তাদের আগের পাওনাসহ সবকিছু ফেরত পেয়েছেন।
৭। নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান: জুলাই বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা নতুন ধরনের রাজনীতি এবং ক্ষমতা হস্তান্তর পদ্ধতির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তরুণ সমাজ আগের রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্বের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দেশের রাজনীতিতে নতুন দিশা প্রদান করেছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নতুন পরিবর্তন আনবে।
জুলাই বিপ্লবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত যারা
জুলাই বিপ্লব ২৪-এর ফলে ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক, এবং সামাজিক বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
১। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠণের নেতা কর্মীরা: দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা আগাম বার্তা ছাড়া বিদেশে পালিয়ে যাওয়াতে লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। উত্তেজিত জনতার হামলার স্বীকার হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নেতা কর্মীদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামলার স্বীকার হয়েছে। যারা পালানোর সুযোগ পায়নি তারা বর্তমানে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে।
২। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: আন্দোলন চলাকালীন সময়ে হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ তৈরি হয় পুলিশের বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন ৫১৫ জন পুলিশ সদস্য-কর্মকর্তা। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, অনেকে রয়েছেন আত্মগোপনে। পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায়ও শীর্ষে হারুন অর রশীদ। এছাড়াও দেশ ছেড়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম।বিভিন্ন মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, ডিবির ডিসি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচিত সদস্যরা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। জোরপূর্বক গুম ও খুন সহ বিভিন্ন জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত থাকার জন্য, সাবেক জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকেও গ্রেফতার করা হয়। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকও (অভ্যন্তরীণ বিষয়ক) ছিলেন।
৩। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী (ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক): অনেক ব্যবসায়ী যারা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন এবং সরকারি সুবিধা লাভ করছিলেন, তারা বিপ্লবের পর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নীতিমালা ও ব্যবসায়িক পরিবেশে পরিবর্তন আসার ফলে তাদের লাভজনক প্রকল্প বা বিনিয়োগে বাধা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালিকানা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরও অনেকের ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। লুটতরাজে অংশ নেয়া এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এসব তথ্য বিস্তারিত প্রকাশ পাচ্ছে।
৪। সরকারি চাকুরীজীবি ও আমলা: অনেক সরকারি চাকুরীজীবি ও আমলা বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে সরকারের অনুগত হয়ে সব ধরণের অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সেসময় এই সমস্ত ব্যক্তিবর্গ সরকারের অনুগ্রহে অনেক বেশি ক্ষমতা, আর্থিক সুবিধা অন্যায়ভাবে গ্রহণ করেছেন। তারা এখন অনেকে পলাতক, অনেকে বিচারের সম্মুখীন আর অনেকে ভীত অবস্থায় আছেন পূর্বের অপরাধের কারণে।