বুধবার ১৩ আগস্ট ২০২৫, শ্রাবণ ২৯ ১৪৩২, ১৮ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে প্রাণ গেল দুই নিরপরাধের

 প্রকাশিত: ২১:৫৬, ১১ আগস্ট ২০২৫

মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে প্রাণ গেল দুই নিরপরাধের

তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে) ও রুপলাল দাস

‘আমরা চোর না, জুতা সেলাই করে জীবন চালাই। আমাদের মারবেন না।’—এভাবেই দুই হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাস। কিন্তু শতাধিক লোকের সেই ক্ষোভমাখা ভিড়ের মধ্যে কেউ তাদের কথা শোনেনি। বাঁচার আকুতি ব্যর্থ হয়ে যায়। গণপিটুনিতে নিহত হন এই দুই নিরপরাধ ব্যক্তি।

ঘটনাটি ঘটে ৯ আগস্ট রাত ৯টার দিকে, তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায়। ভ্যানচোর সন্দেহে রুপলাল ও প্রদীপকে আটক করে স্থানীয়রা। একপর্যায়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

নিহত রুপলাল দাস (৪০) রংপুরের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশায় জুতা মেরামতের কাজ করতেন। অপরজন, মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫), পেশায় ভ্যানচালক এবং রুপলালের ভাগ্নিজামাই।

ঘটনার সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, একটি ভ্যানে বসে রয়েছেন রুপলাল ও প্রদীপ। স্থানীয়রা চুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, বস্তা খুলতে বলছেন, যেখানে চার বোতল বাংলা মদ পাওয়া যায়। মদের গন্ধে স্থানীয় দু’জন অসুস্থ হয়ে পড়লে সন্দেহ আরও বাড়ে। মুহূর্তেই শুরু হয় মারধর।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, কেউ ঘুষি দিচ্ছেন, কেউ লাথি মারছেন, কেউবা চিৎকার করে গালি দিচ্ছেন। রুপলাল বলছিলেন, ‘আমি চোর না, ডাকাতও না। আমি মুচি। তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি। আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেই উপলক্ষে সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী বাংলা মদ কিনে বাড়ি যাচ্ছি।’ তবু করুণ আর্তনাদ কেউ শোনেনি। রুপলাল যখন প্রস্রাব করতে চাইলেন, তখন সন্দেহে কেউ তাকে নামতেও দেয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের প্রথমে ভ্যানে বসে থাকা অবস্থায় পেটানো হয়। পরে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই অচেতন হয়ে পড়েন দুজন। রাত ১১টার দিকে পুলিশ এসে উদ্ধার করে। রুপলাল দাসকে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে রংপুর মেডিক্যালে নেওয়া হলে প্রদীপ দাসও মারা যান।

পরিবার জানায়, রুপলালের মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুর উপজেলার এক তরুণের সঙ্গে। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতেই ঘটনার দিন একসঙ্গে রওনা হয়েছিলেন রুপলাল ও প্রদীপ। পথে ভুল করে কাজীরহাট এলাকায় গেলে লোকজন ভ্যানে থাকা মদের বোতল দেখে সন্দেহ করে। এর কিছুদিন আগে ওই এলাকায় এক কিশোরকে হত্যা করে ভ্যান চুরি হয়েছিল, যা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। সেই ক্ষোভের বলি হন রুপলাল ও প্রদীপ।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘দুইজন মানুষ বারবার বলছিল, তারা চোর না, মুচি। হাতজোড় করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কেউ শুনেনি।’ স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ওই ভ্যান চোর ধরা পড়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে নিরপরাধ দুজনকে হত্যা করা হয়। কাজটি ভালো হয়নি। চোর হলেও পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল।’

রুপলালের পরিবারে এখন শুধু শোক আর বেদনা। স্ত্রী ভারতী দাস বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। মেয়ে রুপা (১০) আর ছেলে জয় (১৩) অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার দিকে। বড় মেয়ে নুপুর কান্নায় ভেঙে পড়েছে—‘এ্যালা কয় হামাক দ্যাখপে?’ বৃদ্ধা মা লালিচা দাস ছেলে হারিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

রবিবার সন্ধ্যায় দুই মরদেহ নিয়ে এলাকায় এলে স্থানীয়রা রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক জানান, নিহত রুপলালের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ভিডিও ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এবাদত হোসেন (২৭), আখতারুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৩৩), ও মিজানুর রহমান (২২)। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটি বলেছে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া আইনের শাসন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।’ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের আলোকে তারা এই হত্যাকাণ্ডকে উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে।