শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, বৈশাখ ২৬ ১৪৩১, ০২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ইসলাম

একজন মুমিনের ঘরের ১৩টি বৈশিষ্ট্য

শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

 প্রকাশিত: ০৯:১৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

একজন মুমিনের ঘরের ১৩টি বৈশিষ্ট্য

বাসা-বাড়িতে বসবাস আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللّهُ جَعَلَ لَكُم مِّن بُيُوتِكُمْ سَكَنًا
‘আল্লাহ করে দিয়েছেন তোমাদের গৃহকে অবস্থানের জায়গা।’ (সূরা আন নাহল ৮০)
একজন মুমিন হিসেবে আমাদের বাসাবাড়ি কেমন হওয়া উচিত, কেমন হলে আমাদের বাসা কিংবা বাড়িটা দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান শত্রু তথা জিন ও শয়তান থেকে নিরাপদ থাকবে এবং বিপরীতে আল্লাহ তাআলার রহমত আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে, এ নিয়ে আলোচনা পেশ করা হল–

০১. একজন মুমিনের বাসা-বাড়িতে ইবাদত, জিকির-আজকার, তেলাওয়াত এক কথায় আল্লাহর বিধান পালনের আদর্শ-পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। কেননা, হাদিস শরিফে জিকির থেকে বিমুখ বাসা-বাড়িকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَثَلُ البيتِ الذي يُذكَرُ اللهُ فيه والبيتِ الذي لا يُذكَرُ اللهُ فيه مَثَلُ الحيِّ والميِّتِ
‘যে ঘরে আল্লাহর জিকির হয় এবং যে ঘরে আল্লাহর আল্লাহর জিকির হয় না; তাদের দৃষ্টান্ত- জীবিত ও মৃতের ন্যায়।’ (বুখারী ৬৪০৭)

০২. বিশেষ করে নামাজের পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। (সুরা ত্বা-হা ১৪ )
মু‘আয বিন আব্দুল্লাহ বিন হাবীব আল-জুহানী সূত্রে হিশাম বিন সা‘দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَخَلْنَا عَلَيْهِ ، فَقَالَ لاِمْرَأَتِهِ: مَتَى يُصَلِّي الصَّبِيُّ؟ فَقَالَتْ: كَانَ رَجُلٌ مِنَّا يَذْكُرُ عَنْ رَسُولِ اللهِ ﷺ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ: إِذَا عَرَفَ يَمِينَهُ مِنْ شِمَالِهِ، فَمُرُوهُ بِالصَّلاَةِ

‘আমরা হিশামের কাছে গেলাম। তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, শিশু কখন সালাত আদায় করবে? তিনি বললেন, আমাদের এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে বলতেন তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘যখন সে তার ডানকে বাম থেকে আলাদা করতে পারবে, তখন তাকে সালাতের নির্দেশ দাও।’ (আবূ দাউদ  ৪৯৭ বাইহাকী, সুনান আল-কুবরা  ৫২৯৬)

০৩. একজন মুমিনের ঘরে পর্দা ও লজ্জাশীলতার পরিবেশ থাকবে। উমর রাযি. নবীজী ﷺ-এর কাছে নিবেদন করলেন,

يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ اِنَّ نِسَآءَكَ يَدْخُلُ عَلَيْهِنَّ الْبِرُّ وَ الْفَاجِرُ فَلَوْ حَجَبْتَهُنَّ فَاَنْزَلَ اللهُ ايَةَ الْحِجَابِ

‘ওগো আল্লাহর রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীদের কাছে ভালো-মন্দ সব ধরনের লোক আসে। যদি তাদেরকে পর্দার বিধান দিতেন! এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতাআলা পর্দার আয়াত নাযিল করেন।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুফতি শফী রহ. মাআরিফুলকুরআনে লিখেছেন, পর্দা সম্পর্কে কুরআনে সাতটি আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সত্তরটি হাদীস রয়েছে। পর্দা পালনের দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নারীরা যথাসম্ভব ঘরে থাকবে। বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে শরীর ও সৌন্দর্য বোরকা ও ওড়না দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখবে যাতে কোনোভাবেই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়।

০৪. একজন মুমিনের বাড়িতে দীনি তা’লিমের তথা কুরআন, সুন্নাহ, সীরাত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দানের আদর্শ পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। আলী রাযি. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

أَدِّبُوا أَوْلاَدَكُمْ عَلَى خِصَالٍ ثَلاَثٍ : عَلَى حُبِّ نَبِيِّكُمْ ، وَحُبِّ أَهْلِ بَيْتِهِ ، وَعَلَى قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ ، فَإِنَّ حَمَلَةَ الْقُرْآنِ فِي ظِلِّ اللهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ مَعَ أَنْبِيَائِهِ وَأَصْفِيَائِهِ

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে তিনটি বিষয়ে শিক্ষা দাও। (ক) তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা (খ) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা এবং (গ) কুরআন তিলাওয়াত। কুরআনের ধারকরা নবী-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে থাকবে, যখন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না।’ (বুখারী, কিতাবুল আদব ৫৯৯৭)

সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের রাসূলের যুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিতাম, যেমনিভাবে তাদেরকে আমরা কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতাম। (তারবিয়াতুল আওলাদ ফিল ইসলাম ৩১৮)

০৫. একজন প্রকৃত মুমিনের বাড়িতে মেহমানদারির ব্যবস্থা থাকে এবং তার দ্বারা তার প্রতিবেশিরা কষ্ট পায় না। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানের সম্মান করে।’ (বুখারী ৬০১৮)

০৬. একজন মুমিন পর্দার পরিবেশ, ইবাদতের পরিবেশ ও মেহমানদারির ব্যবস্থা সুন্দর রাখার লক্ষে সামর্থানুপাতে বসবাসের ঘর প্রশস্ত ও বড়সড় রাখার চেষ্টা করবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
طُوبَى لِمَنْ مَلَكَ لِسَانَهُ، وَوَسِعَهُ بَيْتُهُ، وَبَكَى عَلَى خَطِيئَتِهِ
‘সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে তার জিবকে সংযত করতে সক্ষম হয়েছে, বাড়িকে প্রশস্ত করেছে এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করেছে।’ (সহিহ আত-তারগিব ২৮৫৫)

০৭. একজন মুমিনের বৈশিষ্ট হল, বাড়িতে প্রবেশের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ لاَ مَبِيتَ لَكُمْ وَلاَ عَشَاءَ. وَإِذَا دَخَلَ فَلَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ. وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ
‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে ও খাবার গ্রহণকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করলে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের রাত্রি যাপন ও রাতের আহারের কোনো ব্যবস্থা (এ ঘরে) হলো না; কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমরা রাত্রি যাপনের জায়গা পেয়ে গেলে। আহারের সময় আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমাদের রাতের আহার ও শয্যা গ্রহণের ব্যবস্থা হয়ে গেল।’ (মুসলিম ২০১৮, আবু দাউদ ৩৭৬৫)

০৮. অনুরূপভাবে ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ও ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
إِذَا خَرَجَ الرَّجُلُ مِنْ بَيْتِهِ فَقَالَ بِسْمِ اللَّهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ يُقَالُ حِينَئِذٍ هُدِيتَ وَكُفِيتَ وَوُقِيتَ فَتَتَنَحَّى لَهُ الشَّيَاطِينُ
যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে, ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, তবে তাকে বলা হয়– তুমি হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছ, (আল্লাহ তাআলাই) তোমার জন্য যথেষ্ট, তুমি হেফাজত অবলম্বন করেছ (অনিষ্ট থেকে)। তাতে শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। (তিরমিজি ৩৪২৬)

০৯. একজন মুমিন ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিবে। কেননা, সালাম দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। আল্লাহ  তাআলা বলেন,
فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً
‘যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন সশব্দে সালাম করবে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বরকতময় ও পবিত্র অভিবাদন।’ (সুরা নূর ৬১)

১০. একজন মুমিন শয্যা গ্রহণের সময় দরজা বন্ধ করবে, আগুন (চুলা) নিভিয়ে নিবে ও খাবার পাত্র ঢেকে রাখবে : ঘুমানোর আগে রাসুল ﷺ এজাতীয় কিছু কাজ করতে বলেছেন, প্রত্যেক পরিবারের জন্য তা মেনে চলা জরুরি। কেননা এতে বহু উপকারিতা রয়েছে। রাসুল ﷺ বলেন, ‘যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমাদের সন্তানদের ঘরে আটকে রাখো। কেননা এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু অংশ অতিক্রম করলে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পারো। আর ঘরের দরজা বন্ধ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। আর তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের মশকের মুখ বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের পাত্রগুলোকে ঢেকে রাখবে, কমপক্ষে পাত্রগুলোর ওপর কোনো বস্ত্র আড়াআড়ি করে রেখে দিয়ো। আর (শয্যা গ্রহণের সময়) তোমরা তোমাদের প্রদীপগুলো নিভিয়ে দেবে।’ (বুখারি ৫৬২৩ মুসলিম ২০১২)

১১. একজন মুমিনের ঘর বা বাড়িতে ছবি বা মূর্তি থাকতে পারে না। কেননা, সে জানে যে, ছবি-মূর্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই এসব থেকে বাড়ি-ঘর মুক্ত রাখা মুমিনের অন্যতম কর্তব্য। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلاَ صُورَةٌ
‘যে ঘরে কুকুর ও ছবি থাকে, সে ঘরে (রহমত ও বরকতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না।’ (বুখারি ৩২২৫, ৩৩২২ মুসলিম ২১০৬)

১২. অনুরূপভাবে একজন মুমিনের ঘরে বাদ্যযন্ত্র থাকতে পারে না। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً وَهَدًى لِلْعَالَمِينَ وَبَعَثَنِي لِمَحْقِ الْمَعَازِفِ وَالْمَزَامِيرِ، وَأَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ
আল্লাহ তাআলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা বিলোপসাধনের নির্দেশ দিয়েছেন। (শুয়া’বুল ঈমান, বাইহাকি ৬০২৭)

১৩. একজন মুমিনের বাড়িতে অপচয়-অপব্যয় থাকতে পারে না : কেননা, আল্লাহ বলেন,
كُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
‘তোমরা খাও এবং পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আ’রাফ ৩১)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।

মুসলিম বাংলা

মন্তব্য করুন: