শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, বৈশাখ ২৬ ১৪৩২, ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ব্রেকিং

আইভীর বাড়িতে পুলিশ, অনুসারীদের জটলা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী ধাপের আলোচনার কর্মপরিকল্পনা দ্রুত চূড়ান্ত করার নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা আমরা অন্তবর্তীকালীন সরকারের সাফল্য চাই: মির্জা ফখরুল তথ্যযুদ্ধ: কতটা সত্যি বলছে ভারত ও পাকিস্তান? ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতে এরপর কী? পাকিস্তান ভারত সীমান্তে উত্তেজনার নতুন অধ্যায়: ক্ষেপণাস্ত্র, হামলা ও তথ্যযুদ্ধ আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী সংগঠন নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে: আসিফ মাহমুদ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে নেতৃত্ব পরিবর্তন: স্নিগ্ধর পদত্যাগ আবদুল হামিদের দেশত্যাগে জড়িতদের ধরা হবে, না হলে আমিই চলে যাব: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সরকার সংবাদপত্রের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে চায় : তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা প্রথম আমেরিকান পোপ হলেন রবার্ট প্রিভোস্ট ২০২৫: টেকনোলজির ঝড় উঠছে! ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধের দামামা: বাংলাদেশে কী প্রভাব, করণীয় কী রক্তের প্রতিটি ফোঁটার বদলা নেব: শেহবাজ শরিফ

ইসলাম

রজব ও শা’বান : প্রেক্ষিত মধ্যপন্থা বনাম প্রান্তিকতা

মুফতী হাফিজুর রহমান

 প্রকাশিত: ০১:২৮, ১২ মার্চ ২০২৩

রজব ও শা’বান : প্রেক্ষিত মধ্যপন্থা বনাম প্রান্তিকতা

মহিমান্বিত রমাযান মাসের পূর্বে আমাদের সামনে রয়েছে দুটি মাস; রজব ও শা’বান। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা রজব এবং শা’বান মাসের পালনীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে কিছু আলোচনা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।

রজব মাস

রজবের শাব্দিক অর্থ সম্মান। জাহেলী যুগে মানুষ এ মাসকে সম্মান করতো বলে এর নামকরণ হয়েছে রজব। এ মাসকে ‘রাজাবু মুযার’ও বলা হয়। কারণ মুযার গোত্রীয় লোকেরা এ মাসকে সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত করতো। (আস-সিহাহ ফিল-লুগাহ ১/২৪৩)

রজব মাসের ঐতিহাসিক একটি বিশিষ্টতা ও পটভূমি রয়েছে। আছে এর শব্দগত ও নামগত আরো তাত্তি¡ক আলোচনা। আমরা সেদিকে অগ্রসর হবো না। তবে রজব ‘আশহুরে হুরুম’ অন্তর্গত একটি অন্যতম সম্মানিত মাস। আরবের পৌত্তলিকরা এ মাসকে কেন্দ্র করে পশু বলিসহ নানা রকম কুসংস্কৃতি চর্চায় বুঁদ হয়ে থাকত। তারা এ মাসের মর্যাদা চর্চায় প্রান্তিকতা ও গোঁড়ামির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতো। এমন কি রজব মাস উদযাপনে তারা যুদ্ধ বিগ্রহ আর রক্তপাতের মতো অতি আবশ্যক(?) ব্রতটিকেও ‘সাজঘরে’ পাঠিয়ে দিতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাস কেন্দ্রিক এ জাতীয় নষ্ট কালচারের আমূল সংস্কার সাধন করেন। কিন্তু আক্ষেপের কথা হল, আজকের মুসলিম সমাজে রজব মাস কেন্দ্রিক সে নষ্ট আচার-আনুষ্ঠাকিতা দীনী শিরোনামে নব অবয়বে চর্চিত হচ্ছে। নি¤েœ রজব মাস কেন্দ্রিক এসব রসম-রেওয়াজের কিছু ফিরিস্তি ‘বর্জনীয় বিষয়’ শিরোনামে তুলে ধরা হচ্ছে।

বর্জনীয় বিষয়

(১) সালাতুর রাগায়েব : এটি ‘লাইলাতুর রাগায়েব’ তথা রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতের বিশেষ নিয়মের নামায; যা মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বিশেষ নিয়মে আদায় করা হয়। এর বিনিময়ে পূণ্য-নেকীর ফল্গুধারা প্রাপ্তির সরল বর্ণনা এসেছে। এটি একটি জাল বর্ণনা। আল্লাম আবু বকর মুহাম্মদ তুরতূশী রহ. বলেন, ৪৮০ হিজরীর পরবর্তী যুগে বাইতুল মাকদিসে এ জাতীয় সালাতের উদ্ভব হয়েছে। এর আগে এসবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইমাম ইবনুস সালাহ রহ. বলেন, এটি একটি ঘৃণিত বিদআত। হিজরী বর্ষের চার শত বছর পরে সিরিয়া ভূখÐে এর উদ্ভব হয়েছে। এরপর এখান থেকে অন্যান্য অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। (আব্দুল হাই লক্ষেèৗবী, আল-আসারুল মারফুআহ ফিল আখবারিল মাওযুআহ ১/৬২,৭২, ১৩৭, ইমাম শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমু‘আহ ১/৪৮, ইমাম যাহাবী, তালখীসু কিতাবিল মাউযুআত ১/১০৭)

(২) ‘শবে এস্তেফতাহ’ এর নামায : ১৪ রজব দিবাগত রাতে বিশেষ নিয়মে চার বা পঞ্চাশ রাকাত নামায আদায়োত্তর নির্দিষ্ট পরিমাণ দুরূদ, তাসবীহ-তাহমীদ ও তাহলীল আদায় করে এস্তেফতাহের এ নামায আদায় করা হয়। এ নামাযের বিনিময়েও পূণ্য-মার্জনা প্রাপ্তির ফুলঝুরি দেখানো হয়েছে। এটিও একটি জাল বর্ণনা। (আব্দুল হাই লক্ষেèৗবী, আল-আসারুল মারফুআহ ফিল আখবারিল মাওযুআহ ১/১১২)

(৩) সালাতে ওয়াইস কারনী : ৩, ৪ অথবা ৫ রজবের প্রথম প্রহরে সীমাহীন সাধনাযোগে বিশেষ নিয়মে ছয় রাকাত নামায আদায়ের মাধ্যমে এ নামায আদায় করা হয়। এটিও একটি জাল বর্ণনা। (আল-আসারুল মারফুআহ ফিল আখবারিল মাওযুআহ ১/১১১)

এছাড়া রজবের প্রথম রাত্রিতে মাগরিবের নামাযের পর বিশেষ নিয়মের বিশ বা চল্লিশ রাকাত নামায, ১৪ রজবের দিবাগত রাত্রিতে চৌদ্দ রাকাত নামায, ২৬ রজব দিবাগত রাতের ১২ রাকাত নামায, এ মাসে আয়াতুল কুরসী এবং একশত বার সূরা ইখলাস পাঠ সম্বলিত বিশেষ নিয়মের চার রাকাত নামায, এ মাসের শেষ জুমু‘আয় পঠিত বিশেষ নিয়মের বার রাকাত নামায এবং এ মাসের শেষ তারিখের দিবাগত রাতের বিশেষ নিয়মের বার রাকাত নামাযÑ এসবই জাল বর্ণনা আশ্রিত নামাযের বিবরণ। আল-আসারুল মারফুআহ ফিল আখবারিল মাওযুআহ, ইবনুল জাউযী রহ. রচিত কিতাবুল মাউযুআতসহ বিভিন্ন মাউযু হাদীস গ্রন্থে রজব মাসের এ জাতীয় নামাযের অপাঙক্তেয়তা প্রমাণে ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় রচিত হয়েছে।

ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর নামে প্রচলিত গুনইয়াতুত তালিবীন, আবু তালেব মাক্কী কৃত ক্বুতুল ক্বুলূব এবং বাংলা মোকসেদুল মোমেনীন, নেয়ামুল কুরআন, আমালুল কুরআন, বার চান্দের আমল প্রভৃতি পুস্তিকায় চটকদার জাল হাদীসের ভাষায় সালাতুর রাগায়েবসহ এজাতীয় নামাযের বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। বর্ণনাগুলো সর্বৈব মিথ্যা এবং বানোয়াট। মানব রচিত এ জাতীয় ‘হাদীসের’ ওপর আমল করার কোনোই সুযোগ নেই। কষ্টসাধ্য এসব নামায আদায় করতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যা আরোপের শাস্তি প্রাপ্তির প্রতিশ্রæতি অর্জন ব্যতিরেকে আর কিছুই লাভ হবে না।

(৪) রজব মাসের নির্দিষ্ট দিন-তারিখের রোযা : রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবারের রোযা, মি’রাজের রোযা তথা ২৭ রজবের রোযা, এ মাসে এক থেকে পনেরটি রোযা পালন এবং প্রত্যেক সংখ্যক রোযার জন্য আলাদা আলাদা পূণ্য-মার্জনার সমাহার প্রদর্শন, তেমনিভাবে তিন, সাত, আট, পনের এবং পূর্ণ রজবের রোযার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মাহাত্ম্যের বর্ণায়নসহ রজব মাসের বিভিন্ন দিন তারিখের রোযা সম্বলিত যেসব হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নামে সমাজে বা বই-পুস্তকে প্রচলিত আছে তা সবই হাদীস শাস্ত্রবিদদের মতে ভিত্তিহীন এবং অপাঙ্ক্তেয়। এ জাতীয় রোযা রেখে উপোস থাকার কোনোই সুযোগ নেই। বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ রহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রাযি. পূর্ণ রজব মাস রোযা রাখতে নিষেধ করতেন; যাতে এ মাসকে উৎসব হিসেবে উদযাপন না করা হয়। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক (হা.নং ৭৮৫৪)

(৫) পশু জবাই : আনুমানিক ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশের অন্তর্গত ‘চিশত’ এলাকা থেকে ভারতের আজমীর শহরে আগমন করেন মহান সাধক মনীষী মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. (৬২০/৬২৭/ ৬৩৩/৬৩৪হি.)। এ মহান সাধকের মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে ভারতের আজমীরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উরস-উৎসবের আয়োজন করা হয়। মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. কিংবা আজমীর ‘শরীফ’-এর নামে মানুষ পশু মানত করে। মানতের সেসব পশু এসব উরসে জবাই করা হয়। এটা আরব্য জাহেলী যুগের নতুন বলিপ্রথা বৈ কিছুই নয়। জাহেলী যুগের লোকেরা তাদের প্রতিমাদের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে পশু বলি দিয়ে রজব মাস উদযাপন করতো। আবু হুরায়রা রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইসলামে আতীরা তথা রজব মাসের প্রথম দিনে প্রতিমার সন্তুষ্টির উদ্দেশে পশু বলি দেয়ার প্রথা নেই। (সহীহ বুখারী হা.নং ৫৪৭৪, ফাতহুল বারী ২০/৩৯১)

রজব মাসের এ পশু বলিদানকে কেন্দ্র করেই ترجيبُ العَتيرَةِ শব্দটির প্রচলন হয়। অর্থাৎ রজব মাসে প্রতিমার উদ্দেশে প্রাণ বিসর্জন দেয়া। সুতরাং প্রতিমার সন্তুষ্টির উদ্দেশে পশু বলিদান এবং মাজার কিংবা কোনো ব্যক্তির উদ্দেশে পশু জবাই বিধানগত দিক থেকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বাস্তবে এ দুটোর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়টিই স্পষ্ট শিরক। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব ১/ ২৫, শাহরু রাজাব বাইনাল মুবতাদা’ ওয়াল মাশরু’ ৩, মাহামূদ আব্দুর রউফ, আল-কাশফু আন হাকীকাতিস সুফিয়াহ ১/৩৪০)

(৬) আজমীরী ডেগ চর্চা : মহিমান্বিত এ রজব মাসে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিগলিতে লাল কাপড়ে মোড়ানো কিম্ভূতকিমাকার বহু রঙিন ডেগ চোখে পড়ে। ‘আজমীর’ভক্ত ভাইয়েরা মুঈনদ্দীন চিশতী রহ. এর মৃত্যু দিবস পালনের উদ্দেশ্যে অর্থের যোগান দিতে এ ডেগ পন্থার আবিষ্কার করেছেন। আর আত্মভোলা কিছু মানুষ এদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে এসব ডেগ-ডেগচিতে নিয়ায মানতের অর্থ দিয়ে নিজেদের ঈমান-আমলকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। এসব ঈমান হরণকারী ডেগে টাকা দেওয়াও নিষেধ এবং এ টাকায় সংগৃহীত খাদ্যদ্রব্য আহার করাও নিষেধ।

একটি প্রশ্ন, মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. কি রজব মাসে ইন্তেকাল করেছিলেন? বিশুদ্ধভাবে কি তাঁর ইন্তেকাল-মাস প্রমাণিত? বস্তুত তিনি ঠিক কত হিজরী সনে ইন্তেকাল করেছেন তা নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। ৬২০, ৬২৭, ৬৩৩, ৬৩৪ হিজরীÑ তাঁর মৃত্যু সনের এ চারটি মত পাওয়া যায়। মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ.এর সুনির্দিষ্ট মৃত্যু-তারিখটি বোধ হয় ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আমাদের সমাজে ধোঁয়াশাচ্ছান্ন মৃত্যু কিংবা জন্ম দিবস উদযাপনের অনেক নযীর রয়েছে। অথচ মৃত্যু বা জন্ম দিবস কেন্দ্রিক উৎসব পালন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব; ২৫)

(৭) শবে মি’রাজ উদযাপন : ১৭ মে (০৩ জ্যৈষ্ঠ), ২৭ রজব ‘শব-ই-মিরাজ’ উপলক্ষে সরকারী ঐচ্ছিক ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারী ছুটিই প্রমাণ করে এ দিবসটির গুরুত্ব কত বেশি! মিরাজের ব্যাপারটি একটি তাৎপর্যমÐিত ঘটনা। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ধর্মাচারের রূপ দান করার কোনো সুযোগ ইসলামে আছে কি না তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। মিরাজের রাত্রিকে কেন্দ্র করে কোনো আচার আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন ইসলাম-অনুমোদিত নয়। উপরন্তু বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামের মতে ‘মি’রাজের ঘটনাটি রজব মাসে হয়েছে’ এটা লোকমুখে প্রসিদ্ধ হলেও ঐতিহাসিকভাবে সুনিশ্চিত স্বীকৃত নয়। সীরাত-ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে মিরাজের তারিখ নিয়ে বহু উক্তি রয়েছে। এ কারণে সুনির্দিষ্ট করে মিরাজের রজনী ঘোষণা করার অবকাশ নেই। আর ২৭ রজবের ব্যাপারে ইমাম ইবরাহীম হারবী, ইবনে রজব হাম্বলীসহ অনেকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, এ রাতে মিরাজ সংঘটিত হয় নি। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে মিরাজের ঘটনা হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মাস, দিন তারিখের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। এছাড়াও এ মাসের আমল হিসেবে অন্নদান করা, বস্ত্রদান করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, রোগীর সেবা-শুশ্রƒষা করা, জানাযা পড়া, পানীয় পান করানো, ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া, কুরআন খতম করা ইত্যাদির বিনিময়ে অফুরন্ত ফযীলত লাভসহ দু‘আ কবুল হওয়া এবং বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া সংক্রান্ত যেসব হাদীস সমাজে প্রচলিত আছে তার সবই ভিত্তিহীন, জাল ও বানোয়াট। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব ১/২০-২৫, লাতায়িফুল মা‘আরিফ ১/১২৬)

সারকথা, ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, ‘স্বতন্ত্রভাবে রজব মাসের মাহাত্ম্য, এ মাসের বিশেষ দিনের রোযা এবং বিশেষ নিয়মের নামায সম্বন্ধে প্রমাণযোগ্য কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব ২)

পালনীয় বিষয়

কুরআন-হাদীসের ভাষ্য মতে রজব একটি সম্মানিত মাস। তবে এ মাসে সুনির্দিষ্টভাবে পালন করার মতো কোনো বিষয় নেই। হাদীস ও আসারের বর্ণনায় এ মাসের সম্মান ও মর্যাদা বিবেচনায় যাবতীয় পাপাচার পরিহার করা এবং স্বাভাবিক ইবাদতে অধিক মনোযোগী হওয়ার কথা এসেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ

অর্থ, তোমরা সম্মানিত এ মাসগুলোতে নিজেদের উপর অবিচার করো না। (সূরা তওবা- ৩৬)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বারটি মাসের মধ্য হতে চারটি মাসকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলোকে সম্মানিত করেছেন এবং এ মাসের পাপাচারকে অধিক গুরুতর করেছেন।’ (তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ৩৫/১৩০)

আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ রাযি. উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ তোমরা এ মাসগুলোতে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে এবং তাঁর আনুগত্য পরিত্যাগ করে নিজেদের উপর অবিচার করো না। (প্রাগুক্ত ৩৫/১৪২)

সালেম রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে উমর রাযি. আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত মাসগুলোতে রোযা রাখতেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক; হা.নং ৭৮৫৬)

উসমান ইবনে হাকীম রহ. বলেন, আমি সাঈদ ইবনে জুবাইর রহ. কে রজব মাসের রোযা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তরে বললেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. কে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোযা রাখতেন তখন এত পরিমাণ রোযা রাখতেন, আমরা ভাবতাম, তিনি আর রোযা পরিত্যাগ করবেন না। আবার যখন তিনি রোযা না রাখা শুরু করতেন তখন আমাদের মনে হতো, তিনি আর রোযা রাখবেন না। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৭৮২)

হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহ. বলেন, সাঈদ ইবনে জুবাইর রহ. এ হাদীস উপস্থাপন করে এ কথা প্রমাণ করতে চান, রজব মাসের রোযা সম্বন্ধে বিশেষ কোনো নিষেধাজ্ঞা বা বিধি-আজ্ঞা নেই। বরং এ মাসের রোযার বিধান স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য মাসের নফল রোযার মতো। তবে সুনানে আবু দাউদের একটি বর্ণনামতে সম্মানিত মাসগুলোতে রোযা রাখা বাঞ্ছনীয় বলে প্রমাণিত। সেখানে বলা হয়েছে, জনৈক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অধিক রোযা রাখার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তিনবার বলেন, সম্মানিত মাসগুলোতে রোযা রাখো এবং মাঝে মধ্যে পরিত্যাগ করো। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ২৪২৮, শরহু সহীহ মুসলিম, ইমাম নববী ১৭/৩৮)

আসমা বিনতে আবু বকর রাযি. তাঁর গোলাম আব্দুল্লাহকে ইবনে উমর রাযি.-এর কাছে এ কথা জিজ্ঞেস করে পাঠালেন, আমি শুনতে পেলাম, আপনি তিনটি বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছেন। ... (তন্মধ্য হতে একটি হল,) রজব মাসের রোযা। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রোযা রাখে সে রজবের রোযাকে কী করে নিষিদ্ধ মনে করতে পারে?... (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫৫৩০)

তবে এ মাসের মর্যাদাকে পুঁজি করে ইবাদতের স্বাভাবিক গতিধারাকে ব্যাহত করার কোনো সুযোগ নেই। উমর রাযি. কিছু লোককে রজব মাসের রোযার ব্যাপারে অতিরঞ্জন করতে দেখে তাদেরকে আহার গ্রহণে বাধ্য করেন এবং বলেন, এ মাসকে তো জাহেলী যুগের লোকেরা সীমাতিরিক্ত সম্মান করত। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৬/২৯৪)

শা’বান মাস

শা’বানের শাব্দিক অর্থ ছড়িয়ে পড়া, বিস্তৃতি লাভ করা। জাহেলী যুগের লোকেরা রজব মাসের সম্মানার্থে যুদ্ধ বিরতি প্রক্রিয়া গ্রহণ করতো। রজব মাসের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ শেষে শা’বান মাসের সূচনা হলে তারা নতুন উদ্যমে ব্যাপকহারে লুটপাট ও যুদ্ধ-বিগ্রহের উদ্দেশে ছড়িয়ে পড়ত। এ জন্য রজব মাসের পরবর্তী এ মাসকে শা’বান নামে অভিহিত করা হয়েছে। (মুনাভী, আত-তাউকীফ আলা মুহিম্মাতিত তা‘আরীফ ১/৪৩১)

এ মাসটি যদিও কুরআনে বর্ণিত ‘আশহুরে হুরুম’ এর পদমর্যাদায় ভূষিত হয় নি তবুও হাদীস এবং আসারের বিবরণে নানা আঙ্গিকে এ মাসের মর্যাদা ও বিশিষ্টতার কথা আলোচিত হয়েছে। জাহেলী যুগে মহিমান্বিত এ মাসটি যদিও ব্যাপকহারে অনাচারের শিকার হয় নি কিন্তু হালে মাহাত্ম্যপূর্ণ এ মাসটি দু শ্রেণীর মানুষের চরম প্রান্তিকতা ও নানাবিধ নিগ্রহের শিকার। এতে এ মাসের স্বাভাবিক মূল্যবোধ ও সম্মানটুকুও ¤øান হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ মাসের বর্জনীয় ও পালনীয় বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।

বর্জনীয় বিষয়

(১) হালুয়া রুটির পঙ্কিল সংস্কৃতি : সমাজে শবে বারা‘আত তথা মুক্তির রজনীকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটির আয়োজন বেশ ঘটা করেই চলছে। এটাকে তারা ‘পরম পূজনীয়’ বিষয় বলেই জ্ঞান করে থাকে। অথচ এ ধরনের মনগড়া রসনাবিলাসী আয়োজনের কোনোই ভিত্তি নেই।

হাদীসের নামে জাল কিছু বর্ণনাকে কেন্দ্র করে সমাজে নানা রকম আচার আনুষ্ঠানিকতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। ধর্মের নামে সেসব ধর্মাচার অপাঙ্ক্তেয় হলেও তার একটি ঠুনকো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু হালুয়া-রুটির প্রাদুর্ভাব কোন সূত্রটিকে ঘিরে আবর্তিত তার প্রেক্ষাপট আমরা খুঁজে পাই নি। আশুরার দিনে ভাল খাবারের আয়োজনের ব্যাপারে একটি হাদীসের সন্ধান পাওয়া যায়। হাদীসটির কার্যকারিতা নিয়ে বিদগ্ধ উলামা মহলে বিতর্ক থাকলেও তার একটি বর্ণনানুগ সূত্র আছে। বস্তুত খাবার আয়োজন নিয়ে শরীয়তের বিশেষ কোনো বিধি নিষেধ নেই। কিন্তু বৈধ কোনো বিষয়ের স্বাভাবিক গতিধারা যদি সময়কেন্দ্রিকতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে তখন তা বৈধতার আবেদন হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে হালুয়া-রুটির আয়োজন বিধিসম্মত হলেও তা সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে প্রথাগত রূপ নেয়ায় তা আর শরীয়তসম্মত নেই; বরং অবশ্যপরিত্যাজ্য হয়ে গেছে। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ])

(২) আলোক-সজ্জার ঝিলিমিলি আয়োজন : লাইলাতুল বারা‘আতকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ দোকান-পাট, বাসা-বাড়ী এমনকি আল্লাহর ঘর মসজিদের দেয়ালেও ঝুলিয়ে দেয় বাহারী ঝিলিমিলি বাতি। মূলত এটি অগ্নিপুজার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। অমিতব্যয়ের এ আলো ঝলকানিতেও তারা নেকী-পূণ্যের সমাহার খুঁজেন। স্বাভাবিক সাজসজ্জা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তা যদি স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন তা আর বৈধ থাকে না; নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ আলোকসজ্জায় যেমন আছে মাত্রাহীন অর্থ অপচয় তেমনি আছে ধর্মাচারের নামে সীমাহীন বাড়াবাড়ি। তাই এ জাতীয় সূত্রবিহীন আচার-আনুষ্ঠানিকতা ইসলাম সমর্থন করে না। এসব অনাচারের প্রাদুর্ভাব রোধে কর্মতৎপর হওয়া আবশ্যক। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ], আল-আসারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাউযু‘আহ ১/৭১)

(৩) আতশবাজির ধর্মহীন উন্মাদনা : যেসব ভাইয়েরা শবে বরাতের নব আবিষ্কৃত আচার-আনুষ্ঠানিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট তারা কি এ রাতের আতশবাজিকেও পূণ্যের বিষয় বলে মনে করেন? জানি না, এ ব্যাপারে তাদের লালিত ধারণাটা কি। যদিও এ বিষয়টির সাথে আবেগী যুবসমাজই বেশি যুক্ত থাকে। ধর্মীয় বিষয়ে মতভিন্নতার ফিরিস্তি নাতিদীর্ঘ হলেও দীন বিষয়ে জানাশোনা এমন কোনো মানুষ পাওয়া দুষ্কর হবে যারা অনর্থক এবং মানবতা বিরোধী এ পটকাবাজিকে বিধানিক বলে মত পেশ করবেন। অথচ মহিমান্বিত একটি রাতকে কেন্দ্র করে এ পটকাবাজির চর্চা হচ্ছে। এতে ইবাদতে নিমগ্ন মানুষের মনোযোগ ব্যাহত হচ্ছে, ঘুমন্ত মানুষের ঘুমকে হারাম করে দেয়া হচ্ছে। একটি পাপাচারের সাথে হাজারো পাপাচার এসে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন করেও এ জাতীয় পাপাচারের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এই সবই মুক্তির রজনী নিয়ে সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির অশুভ পরিণতি।

(৪) মাজার-কবরে নারী পুরুষের অবাধ জমায়েত : ১৪ শা’বান দিবাগত রাতে কবর-মাজারগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনতার ঢল নামে। সেখানে গিয়ে তারা এমন এমন আচার আনুষ্ঠানিকতায় লিপ্ত হয় যা ইসলামী শরীয়ত আদৌ সমর্থন করে না। নারীদের কবরস্তানে গমনের ব্যাপারে এমনিতেই বিধি-নিষেধ রয়েছে। সেখানে পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে মাজার-কবরে অবাধ যাতায়াতের ব্যাপারটি কিভাবে বিধিসম্মত হতে পারে। কবর যিয়ারত একটি কাক্সিক্ষত এবং পূণ্যময় বিষয়। সহীহ হাদীসের বর্ণনায় এ সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে সেটাকে সম্মিলিত পোষাকী রূপ দেয়া আদৌ শরীয়তসম্মত নয়। (ইবনুল হাজ্জ, আল-মাদখাল ১/২৯৯-৩১৩,)

(৫) শবে বরাতের ‘গোসল-¯œান’ : অনেকে শবে বরাত উদযাপনের উদ্দেশে এ রাতে গোসলনীতি পালন করে থাকেন। ফুটপাথীয় কোনো পুস্তকে হয়েতো দেখেছেন, এ রাতে গোসল করলে পানির ফোঁটায় ফোঁটায় নেকির ফল্গুধারা বয়ে যাবে। কিন্তু ভাইয়েরা এসব ‘রূপকথা’র শুদ্ধাশুদ্ধি বিচার করে দেখেন না। এ রাতের গোসলের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে একটি জাল বর্ণনা রয়েছে। বর্ণনাটিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বরাতের রাতে ইবাদত পালনের উদ্দেশে গোসল করবে তার গোসলের প্রতি ফোঁটা পানির বিনিময়ে আমলনামায় ৭০০ রাকাআত নফল নামাযের পূণ্য লেখা হবে। বানোয়াট এ বর্ণনাটিকে ঘিরেই ‘হিন্দুয়ানী ¯œানব্রত’ সদৃশ এ পরগাছার জন্ম হয়েছে। (যাইলুল মাকাসিদিল হাসানাহ, যাইলু তানযীহিশ শরী‘আহ, শা’বান মাস অধ্যায়। হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দা.বা., প্রচলিত জাল হাদীস ১০৫)

(৬) বিশেষ পদ্ধতির সালাত আদায় : বারা‘আতের এ রজনীতে নামায পড়ার বহু রকমের নিয়ম পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত আছে। মানুষ না জেনে না বুঝে কষ্টসাধ্য এসব নামাযের পেছনে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে। এতে পÐশ্রমের সাথে সাথে জাহান্নামে যাওয়ার পথ আরো অবারিত ও মসৃণ হয়। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, আমি কিছু মানুষকে দেখেছি, তারা সারা রাত জেগে হাজার হাজার বার বিভিন্ন সূরা যোগে এ জাতীয় নামায আদায় করে। এরপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফজর নামায কাযা করে ঘুমিয়ে থাকে। সুতরাং এ রাতের এক হাজার বার সূরা ইখলাস সম্বলিত একশত রাকাত নামায, একত্রিশ বার সূরা ইখলাস সম্বলিত বার রাকাত নামায, বিশেষ পদ্ধতির চার রাকাত খাসমা’র নামায, সেজদার বিশেষ দু‘আ সম্বলিত নামায, বিশেষ কিরাত সম্বলিত চৌদ্দ রাকাত নামাযসহ আরো যত প্রকার বিশেষ প্রকৃতির নামায রয়েছে সবই বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। এসবের পেছনে শ্রম দিয়ে পাপ কামাই করার কোনো অর্থ হয় না। (আল-আসারুল মারফু‘আ ফিল আখবারিল মাউযুআহ ৭৮-১১৪, ইমাম ইবনুল জাউযী, কিতাবুল মাউযুআত ২/১৩০)

(৭) লাইলাতুল বারা‘আতকে লাইলাতুল কদরের সমমর্যাদায় বা ততোধিক মর্যাদায় ভূষিত করা : শবে বরাতের মহিমা শুধু হাদীসের ভাষ্যে প্রমাণিত। কিন্তু লাইলাতুল কদরের মর্যাদা স্বয়ং কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। অথচ মানুষ সেই শবে কদরের চেয়েও শবে বরাতকে শ্রেষ্ঠতর মনে করছে। কেউ কেউ ভাষ্যে কিংবা বিশ্বাসে এ কথার জানান দিচ্ছে। কেউ বা আচার আনুষ্ঠানিকতায় তার প্রমাণ দিচ্ছে। কারণ শবে কদরের সময় ইবাদত-বন্দেগী নিয়ে এত মাতামাতি আর এত পরিমাণে বর্ণাঢ্য আয়োজন লক্ষ্য করা যায় না। এতেই প্রমাণ হয়, তাদের নিকট শবে বরাত যতটা গুরুত্বপূর্ণ শবে কদর ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা নিতান্তই আপত্তিকর এবং অতীব গর্হিত ব্যাপার। এ জাতীয় ধ্যান ধারণার আশু অপনোদন জরুরী।

ইবাদাতকে সম্মিলিত এবং আনুষ্ঠানিক রূপ দান

শবে বরাতের মাহাত্ম্য সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত। এ রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে এবং সম্মিলিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ না দিয়ে সাধারণ ইবাদত বন্দেগীতে রত থাকাও নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু আজকাল বিশেষ নিয়মে সম্মিলিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপনের প্রক্রিয়া চলছে তাতে শবে বরাতের স্বাভাবিক ধর্মাচারের গতিধারা ব্যাহত হয়। নির্দিষ্ট সময় করে ওয়াজ নসীহত এরপর দুআ-মুনাজাত এবং তাবারক বিতরণীÑ এসবই অতিরঞ্জন এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কর্মপদ্ধতি। এগুলো পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। মসজিদ মূলত ফরজ নামাযের জন্য। নফল নামায নিজ নিজ গৃহে আদায় করা উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল নামায নিজ গৃহে আদায় করতেন। এ সম্বন্ধে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা শবে বরাতের রাতে যে অতিরিক্ত নামায আদায় করি তা সবই নফল নামাযের পর্যায়ভুক্ত। ইবনে উমর রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা তোমাদের ঘরেও কিছু নামায আদায় করো। তোমাদের ঘরগুলোকে কবর-সমাধি বানিয়ে রেখো না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৩২)

পালনীয় বিষয়

শা’বান মাস পবিত্র রমাযান মাসে প্রবেশের সেতুবন্ধ। এ মাসের পথ ধরেই রমাযানের অফুরন্ত পূণ্যাশীষ ও কল্যাণ লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে শা’বান মাসের আলাদা একটি শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তাছাড়া স্বতন্ত্রভাবে শা’বান মাসের ইবাদত ও মাহাত্ম্য বিষয়ে প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ বর্ণনা রয়েছে। হাদীসের গ্রন্থগুলোতে শা’বান মাস বিষয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় রচিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ইবাদতে মনোযোগী হতেন। উসামা ইবনে যায়েদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল! আপনি শা’বান মাসে যে পরিমাণ রোযা রাখেন অন্য কোনো মাসে আপনাকে সে পরিমাণ রোযা রাখতে দেখি না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটি রজব এবং শা’বানের মধ্যকার এমন একটি মাস যার মাহাত্ম্য সম্পর্কে মানুষ উদাসীন। এটি এমন একটি মাস যে মাসে মানুষের আমলের হিসাব নিকাশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে উত্থাপন করা হয়। সুতরাং আমি চাই আমি রোযারত অবস্থায় আমার কার্যতালিকা আল্লাহ তা‘আলার নিকট উত্থাপিত হোক। (সুনানে নাসায়ী; হা.নং ২৩৫৭)

আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একমাত্র রমাযানেই পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখেছি। আর তাঁকে শা’বান মাসের তুলনায় অন্য কোনো মাসে এত অধিক পরিমাণে রোযা রাখতে দেখেনি। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৯৬৯)

অন্য একটি বর্ণনায় আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসের চেয়ে বেশি অন্য কোনো মাসে রোযা রাখতেন না। কারণ তিনি নিয়মিত শা’বান মাসের রোযা রাখতেন। (প্রাগুক্ত; হা.নং ১৯৭০)

এ ছিল শা’বান মাসের স্বাভাবিক শ্রেষ্ঠত্ব। এসব বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়, পূর্ণ শা’বান মাস জুড়েই ইবাদতের ব্যাপারে তুলনামূলক বেশি যত্মবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য দিকে শা’বান মাসের বিশেষ একটি অংশের ব্যাপারে স্বতন্ত্র তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্যের কথা হাদীসের কিতাবগুলোতে আলোচিত হয়েছে। আর সে অংশটি হলো ১৪ শা’বান দিবাগত রজনী। হাদীসের ভাষায় মহিমান্বিত এ রজনী ‘লাইলতুন নিসফি মিন শা’বান’ আর সাধারণ মানুষের পরিভাষায় লাইলাতুল বারা‘আত এবং শবে বরাত বা মুক্তির রজনী হিসেবে পরিচিত। এ রজনীটিকে ঘিরে আমাদের কিছু ভাইয়েরা বিদআত প্রতিরোধের নামে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের শিথিলতার আশ্রয় নেন। অথচ যতটুকু বিদআত এবং ধর্মীয় অনাচারের পর্যায়ে পড়ে ততটুকুই রোধ করা প্রয়োজন ছিল। দেহের কোনো অঙ্গে অপারেশন পর্যায়ের ইনফেকশন হলে নির্দিষ্ট অঙ্গটিকেই অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়। ইনফেকশনের ধুয়া তুলে যদি পূর্ণ দেহটিকেই দু টুকরো করে দেয়া হয় তবে তো তাতে আর প্রাণের স্পন্দন থাকবে না। ফরজ নামায কিংব ফরজ রোযাকে ঘিরে অনেক জায়গায় নানা রকমের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। তাই বলে তো সংস্কারের নামে ফরজ নামায রোযাকে ছেটে ফেলে দেয়া যাবে না। দীনের কাজ করতে হলে অনেক সূ² বিষয় মাথায় রাখতে হয়। সামনে রাখতে হয় নববী কর্মপন্থা। অতি আবেগ যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মাহাত্ম্যপূর্ণ এ রজনী সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা এবং সালাফের কিছ উক্তি রয়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনাসহ কয়েকটি বর্ণনা ও আসলাফের কিছু উক্তি এখানে তুলে ধরছি।

(১) মু‘আজ ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শা’বানের রজনীতে সৃষ্টিজগতের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং শেরেকে আচ্ছন্ন ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

(সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ১৩৯০, সহীহ ইবনে হিব্বান; হা.নং ৫৬৬৫, [শাইখ শু‘আইব আরনাউত এর মন্তব্য, হাদীসটির ইসনাদ সহীহ])

উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতির আলোকে হাদীসটির শাস্ত্রীয় আলোচনায় না গিয়েও এ কথা বলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, হাদীসটি আমলযোগ্য। আমাদের কিছু ভাইয়েরা শাইখ ইবনে বায রহ. এর একটি আলোচনার আলোকে অর্ধ শা’বানের রজনীর মাহাত্ম্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। কিন্তু ইবনে বায রহ. তাঁর ফাতাওয়াসমগ্রে (মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ১/১৮৬, ১/২৩৫ আততাহযীর মিনাল বিদা’ অধ্যায়) যে আলোচনাটি করেছেন তাতে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এর উদ্ধৃতি টেনেছেন। কিন্তু তাঁদের নিজস্ব অভিমতকে তিনি গ্রহণ করেন নি। তাছাড়া ইবনে বায রহ. বহু জাল হাদীসের মুÐুপাত করেছেন। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসটি তাঁর সে আলোচনায় উল্লেখ করেননি। আর কিছু না হোক উপরোক্ত হাদীসটি সামনে থাকলে মহিমান্বিত এ রজনীকে এভাবে তার অপাঙক্তেয় ঘোষণা করার কথা নয়। জানি না, সংশ্লিষ্ট আলোচনাটি করার সময় ইবনে বায রহ. এর ‘যেহেনে’ উক্ত হাদীসটি ছিল কি না। হয়তো বা তিনি মাত্রাজ্ঞানহীন লোকদের সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির প্রতিকারকল্পে এমন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তবে এটা তো ইলমে শরীয়তের একটি স্বীকৃত নীতি যে, প্রান্তিকতা বা বাড়াবাড়ির প্রতিকারে বিধিত বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে করা যাবে না; বরং বিধানিক বিষয়ের যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই বাড়াবাড়ির প্রতিকার করতে হবে। এবার আমরা বিশেষ ঘরানার সম্মানিত ভাইদের জ্ঞাতার্থে এ বিষয়ে তাদের কয়েকজন আদর্শ পুরুষসহ কয়েকজন মহামনীষীর মন্তব্য তুলে ধরছি।

১। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, অর্ধ শা’বান রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে একাধিক মারফু হাদীস ও আসার বর্ণিত হয়েছে। এসব বর্ণনার আলোকে প্রতীয়মান হয়, পনের শা’বানের রজনীটি একটি মহিমান্বিত রজনী। সালাফের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাযের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শা’বানের রোযার ব্যাপারে তো অসংখ্য হাদীসই বর্ণিত হয়েছে। সালাফ এবং খালাফের মধ্য হতে কেউ কেউ এ রাতের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেন। তবে হাম্বলী এবং অহাম্বলী মাসলাকের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ রাতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেন। ইমাম আহমদ রহ. এর ভাষ্যও এ মতের প্রমাণ বহন করে। কারণ এ সম্বন্ধে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলোর সমর্থনে সালাফের আসারও বিদ্যমান রয়েছে। এ রাতের ফযীলত সম্পর্কিত কতক বর্ণনা মুসনাদ ও সুনান শিরোনামে সংকলিত হাদীস গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। তবে শা’বানের পনের তারিখের দিনে স্বতন্ত্রভাবে রোযা রাখার ব্যাপারে যতœবান হওয়া মাকরূহ। (ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত এটিই। তাঁর মতে পনের তারিখের সাথে দু এক দিন মিলিয়ে রোযা রাখা উত্তম)। আর এ রাতে বিশেষ খাবারের ব্যাবস্থা করা, সাজ-সজ্জার ব্যাপারে যতœবান হওয়া বিদআত; এর কোনো ভিত্তি নেই। তেমনিভাবে এ রাতে ‘সালাতে আলফিয়া’ নামক বানোয়াট নামাযের জন্য মসজিদে সমবেত হওয়াও বিদআত। কারণ নির্দিষ্ট সময়, সংখ্যা এবং কিরাতযোগে এ জাতীয় নফল নামাযের জন্য সমবেত হওয়া শরীয়তসম্মত নয়। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ])

২। বর্তমান সময়ের আলোচিত ব্যক্তিত্ব শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. উপরোল্লিখিত হাদীসটির সমর্থনে আটটি হাদীস উপস্থাপন করে বলেন, এসব সূত্রের সামগ্রিক বিবেচনায় হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ।...সুতরাং শাইখ কাসেমী রহ. তাঁর ইসলাহুল মাসাজিদ গ্রন্থে (১৭০) জারহ তা’দীলের ইমামদের উদ্ধৃতির আলোকে ‘অর্ধ শা’বানের রাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে কোনো সহীহ হাদীস নেই’ বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যদি কেউ এ জাতীয় ঢালাও উক্তি করে থাকেন তবে সেটা তার দ্রæত সিদ্ধান্ত প্রদান এবং সূত্র অনুসন্ধানে কষ্ট স্বীকার করতে না পারার পরিণতি। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ১/১২৪)

৩। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন, একজন মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয় হলো, এ রাতে যিকির ও দুআ-প্রার্থনার জন্য সম্পূর্ণরূপে অবসর হয়ে যাওয়া। সে নিজের পাপ মার্জনা এবং বিপদ-আপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দু‘আ-প্রার্থনায় রত হবে। খাঁটি মনে তাওবা করবে। কারণ যে ব্যক্তি এ রাতে তাওবা করে তার তাওবা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন। তবে এক্ষেত্রে মুমিনের জন্য আবশ্যক হলো, দু‘আ কবুল হওয়া ও মাগফিরাত লাভের ক্ষেত্রে যেসব পাপাচার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেসব থেকে বিরত থাকা। (লাতায়িফুল মা‘আরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল আমি মিনাল ওয়াযায়িফ ১৯২)

৪। সুনানে তিরমীযীর গাইরে মুকাল্লিদ ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রহ. এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, এসমস্ত হাদীস ঐসমস্ত ব্যক্তিদের বিপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে পরিগণিত যারা ধারণা করে, অর্ধ শা’বানের রাতের ফযীলতের ব্যাপারে কোনো কিছুই প্রমাণিত নয়। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৬৭)

৫। মিশকাতুল মাসাবীহ এর সমকালীন ব্যাখ্যাতা আবুল হাসান উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, ...এসমস্ত হাদীস অর্ধ শা’বান রজনীর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং মহিমার ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। এ রাতটি আর পাঁচটা রাতের মত নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া উচিৎ নয়। বরং শ্রেয় হল, ইবাদত, দু‘আ এবং যিকির-ফিকিরে রত থেকে এ রাতের অফুরন্ত কল্যাণ অর্জন করা। (মির‘আতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ ৭/৫৮)

৬। শাইখ ইবনুল হাজ্জ রহ. বলেন, ‘এ রাত যদিও শবে কদরের মত নয়; কিন্তু এর অনেক ফযীলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরী পূণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন এবং এর যথাযথ হক আদায় করতেন। কিন্তু আজ সাধারণ লোকেরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ফেলেছে। তারা রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের পেছনে পড়ে (মনের অজান্তেই) এর খায়ের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একে তো ওরা এ রাতে আলোকসজ্জার নিকৃষ্টতম রসম যা অগ্নিপূজকদের প্রতীক, তা করছে; অপরদিকে মসজিদসমূহে সমবেত হয়ে শোরগোল করে পবিত্র পরিবেশকে নষ্ট করছে। তাছাড়া মহিলাদের কবরস্তানে যাওয়া, তা-ও আবার বেপর্দা অবস্থায়, পাশাপাশি পুরুষদেরও কবর যিয়ারতের উদ্দেশে ওখানে ভিড় সৃষ্টি করাÑ এসব কিছুই নব আবিষ্কৃত বিদআত এবং নববী সুন্নত ও সালাফে সালেহীনের পথ ও পদ্ধতির পরিপন্থী।’ (আলমাদখাল ১/২৯৯-৩১৩, আলকাউসার, সেপ্টেম্বর ’০৬)

৭। প্রসিদ্ধ হাদীস শাস্ত্রবিদ ইমাম ইবনুস সালাহ রহ. বলেন, অর্ধ শা’বান রজনীর অসীম ফযীলত ও মহত্ত¡ রয়েছে। এ রাতে ইবাদতে রত হওয়া মুস্তাহাব। তবে সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে; সমবেত রূপ দিয়ে নয়। (আল-আসারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাউযু‘আহ ১/৭১)

৮। ইন্টারনেটভিত্তিক ৫৬ হাজার ফতওয়া সম্বলিত আরবী ফতওয়াসমগ্র ‘ফাতাওয়া আশশাবাকাতিল ইসলামিয়া’তেও (২/২৫৬৩) এ রাতের মহত্ত¡ সম্বন্ধে ইতিবাচক আলোচনা করা হয়েছে।

অর্ধ শা’বান রজনীর সপক্ষে এত সূত্র ও ভিত্তি থাকার পরও কোন বিবেকে শুধু ইবনে বায রহ. এর একটি বিচ্ছিন্ন মতের আলোকে এ রাতের মহত্ত¡কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার স্পর্ধা দেখানোর সুযোগ থাকতে পারে?

(২) আলা ইবনুল হারিস রহ. সূত্রে বর্ণিত, আয়েশা রাযি. বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন। কিন্তু সেজদাকে এতটা দীর্ঘায়িত করলেন, আমার ধারণা হলো তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে আমি উঠে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম। তখন আঙ্গুল নড়ে উঠল। ফলে আমি যথাস্থানে ফিরে এলাম। যখন তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং যথা নিয়মে নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, আয়েশা! তুমি কি ধারণা করেছো, আল্লাহর নবী তোমার অধিকার ক্ষুণœ করবেন? তখন আমি বললাম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে আপনার দীর্ঘ সেজদার কারণে আমি মনে করেছিলাম, আপনার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা হলো, অর্ধ শা’বানের রজনী। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শা’বানের রজনীতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। আবু বকর বাইহাকী রহ. বলেন, এটি উত্তম পর্যায়ের মুরসাল হাদীস। সম্ভবত আলা ইবনুল হারিস মাকহুল থেকে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। (আলজামি’ লিশুআবিল ঈমান হাদীস ৩/৩৮২/৩৮৩৫)

এ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ সেজদা সম্বলিত দীর্ঘ নামায আদায় করা শরীয়তের কাক্সিক্ষত বিষয়। তবে সাধারণ নিয়মে দু রাকাত, চার রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব আদায় করবে। সাথে কুরআন তিলাওয়াত, দুআ-দুরূদ এবং যিকির ইস্তেগফারে মনোযোগী হবে। তবে সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন রাত জাগা ক্লান্তির কারণে ফজরের নামাযের অত্যাবশ্যক ইবাদত ছুটে না যায়। আর এসব আমল একান্ত ঘরোয়া পরিবেশেই করা শ্রেয়। তবে যদি কোনোরূপ আহŸান-ঘোষণা ব্যতিরেকে কিছু লোক মসজিদে এসে যায় এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ আমলে মগ্ন থাকে তবে এতেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, আমার ইবাদতের কারণে যেন অন্যের আমলে কোনোরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।

এ মাসের পনের তারিখে রোযা রাখার আমলও করা যেতে পারে। এ দিনের রোযার ব্যাপারে সুনানে ইবনে মাজাহতে (হাদীস নং ১৩৮৮) একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

হাদীসটিকে উলামায়ে মুহাদ্দিসীন সূত্রগত দিক থেকে যয়ীফ বলে অভিহিত করেছেন। তবে এ মাসে অধিক পরিমাণ রোযা রাখার বিষয়টি অসংখ্য সহীহ হাদীসে আলোচিত হয়েছে। উপরন্তু শা’বান মাসের ১৫ তারিখ হলো ‘আইয়ামে বীয’ তথা চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের অন্তর্ভুক্ত। আর আইয়ামে বীযে রোযা রাখার ব্যাপারটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসের আইয়ামে বীযে রোযা রাখতেন। মিলহান কাইসী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তের চৌদ্দ এবং পনের তারিখে বীযের রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৪৯) আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমার খলীল (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রতি মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৮১)

ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন, শা’বান মাসের পনের তারিখে রোযা রাখা নিষিদ্ধ নয়। কারণ পনের তারিখ তো আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতিমাসে আইয়ামে বীযে রোযা রাখা মুস্তাহাব। (লাতায়িফুল মা‘আরিফ ১৮৯)

তবে শুধু ১৫ শা’বানের কারণে এ রোযাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সুন্নত মনে করা অনেক উলামায়ে কেরাম সঠিক মনে করেন না। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় শা’বানের ১৫ তারিখের রোযাকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেন নি। সুতরাং এসকল বিষয়কে সামনে রেখে যদি কেউ এ দিন রোযা রাখে তবে ইনশাআল্লাহ সে সওয়াব লাভ করবে।

সারকথা, রজব এবং শা’বান দুটি মহিমান্বিত মাস। এ দু’মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী হওয়া শরীয়তের কাক্সিক্ষত বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ দুটি মাসের স্বাভাবিক মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে সব ধরনের প্রথাগত রীতি-নীতি পরিহার করে প্রভূত কল্যাণ অর্জনের তাওফীক দান করুন এবং সর্বপ্রকার অকল্যাণ-অনাচার থেকে নিরাপদ থেকে বিশুদ্ধ ধর্মীয় জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন; আমীন!

লেখক : আমীনুত তালীম,মা‘হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, বছিলা, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।

মুসলিম বাংলা