নতজানু হবেন না, নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা নিন:ইসিকে দলের প্রতিনিধিরা
সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন গণফোরাম, গণফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা।
কোনোভাবে অনিয়ম ও অদৃশ্য শক্তির কাছে নতজানু হওয়া যাবে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
রোববার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে দ্বিতীয় দিনের সংলাপের প্রথম পর্বে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনে ইসির ভূমিকা নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন।
আলোচনায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররাও বলেছেন, আইন-বিধি প্রয়োগে কঠোর থাকবেন তারা। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন জানিয়ে ইসিও বলেছেন, কোনো চাপের কাছে কমিশন ‘নতজানু হবে না’।
রোববার সকালে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত গণফোরাম, গণফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির আলোচনা সেরেছে ইসির সঙ্গে।
অর্ধশতাধিক নিবন্ধিত দলের মধ্যে বৃহস্পতিবার ও শনিবার নিয়ে ২৪ টি দলের সংলাপ হয়েছে।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “অনেক আশা ভরসা ছিল, ইসির উপর সারা জাতির আস্থা থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অতীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষ ছিলেন হয়ত, তাদেরকে কাছ থেকে নিরপেক্ষতা পাই নি। তাদের সাথে অদৃশ্য শক্তি ছিল।”
তিনি বলেন, নির্বাচনটাকে ‘কলুষিত’ করার ব্যবস্থা ছিল।
“৫৪ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। তবে দুয়েকটা নির্বাচন হয়ত ভালো হয়েছে। আপনাদের মেয়াদে সংসদ হোক, স্থানীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা যেন ধরে রাখেন। সেটা যেন জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়। এখনও আপনাদের প্রতি আশ্বস্ত আছি।…ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচন হবে, গণভোটও হবে।”
গণভোটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বিদ্যমান প্যাকেজে হ্যাঁ, না ভোট হলে এটা অকার্যকর হয়ে যাবে। দুটোতে হ্যাঁ, দুটোতে না এর সুযোগ নেই। সবটার মধ্যে হ্যাঁ অথবা না তে নিয়ে যাচ্ছে। দল, সরকার ও ইসির ভূমিকা রয়েছে। শেষ পযন্ত গণভোট যেন হাস্যকরে পরিণত না হয় আপনাদের হাত দিয়ে। এ ব্যাপারে আপনাদের শক্ত থাকতে হবে।”
ভালো ভোটের বিষয়ে দলগুলোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন গণফোরাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।
“আমরা যেন আচরণবিধি মেনে চলি। নির্বাচনকেন্দ্রিক আমরা যে অপমানিত বোধ করি, সেখান থেকে বের হতে হবে। বর্তমান ইসিকে ভালো নির্বাচন করতে হবে।”
তিনি বলেন, সর্বাগ্রে ইসির দায়িত্ব। সীমানা নিয়ে ইসি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসি ও আদালত একে অপরের পরিপূরক। সীমানা নিয়ে জটিলতা যেন না হয়, তাহলে কমিশন পারবে না।
গণফ্রন্টের মহাসচিব আহমদ আলী শেখ বলেন, “আজ অবধি ইসি অবিচারের শিকার হয়েছে। অবিচারগ্রস্ত ইসির অধীনে আমরা যারা নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থা নিসন্দেহে শোচনীয়।”
আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সক্ষমতা যা দরকার তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
এ দলের আরেক প্রতিনিধি বলেন, “ইসি শক্তিশালী না হলে, নিয়ন্ত্রণমূলক স্বৈরাচারী শক্তি মাথাচাড়া দেবে। এবার সময় এসেছে, গণতান্ত্রিক আস্থা পুনরুদ্ধার করার।”
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ এন এম সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, আগামী নির্বাচন ভালো করার জন্য ইসির আন্তরিকতা রয়েছে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিভাগওয়ারি ভোট নেওয়া, জামানত কমানো, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখার সুপারিশ করেন তিনি।
জোট করলেও স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান চালু করায় মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “শঙ্কিত যে, জারি করা বিধিমালা রাখতে পারবেন কি না। আশা করি, অতীতের শিক্ষা থেকে কারো কাছে নতজানু হবেন না। শপথ নিয়েছেন। আপনাদের ঘাড়ে জাতির দায়িত্ব, কারো চাপে দায়িত্ব পালন যদি না করতে পারেন তাহলে উত্তম পথ আছে, সে পথ নেবেন। কিন্তু নতজানু হবেন না।”
কেউ ভাবেনি একজন সিইসির এরকম দৃশ্য আমাদের কাঁদিয়েছে তাই; তারপরও দেখতে হবে, বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ৯টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, “গত ১৫ বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়, সবটিই বিতর্কিত। ভোট নিয়ে আস্থা সঙ্কট তৈরি হয়। গোট নির্বাচন ব্যবস্থা সঙ্কটাপন্ন।”
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, সারাদেশে একই দিনে নির্বাচন না করে চার ধাপে আয়োজন করার দাবি রেখেছেন তিনি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নিয়ে কালো টাকা রোধে ইসির দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
আমন্ত্রণ নিয়ে বিভ্রাট, একাংশকে বের করে দেওয়া
শুরুতে ইসির সংলাপে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষ হাজির হয়।
রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংলাপ শুরু হয়। এতে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষের প্রতিনিধি আসায় কিছুটা হট্টগোল হয়। এ সময় সংলাপে অংশ নিতে আসা যাদের কাছে চিঠি নেই, তাদের সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বলেন ইসি সচিব।
সম্মেলন কক্ষ থেকে বের হওয়া অংশ থেকে মইনুদ্দিন রুহি সাংবাদিকদের বলেছেনের, তাদের চিঠি ‘ব্ল্যাকমেইল করে’ আরেক অংশ সংলাপে অংশ নিয়েছেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের এক পক্ষ সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করলে ইসি সচিব বলেন, “আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত অসামঞ্জস্যতা দিয়ে শুরু করার জন্য। ”
পরে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজী সংলাপে তার বক্তব্যে বলেছেন, ৫ আগস্টের আগে এই ফ্যাসিবাদের দোসররা কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করে নিযে স্বার্থ হাসিল করেছে।
“৫ আগস্টের পর থেকে তারা আত্নগোপনে ছিল। এরপর দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে দল নতুন করে পূর্ণগঠন করা হয়েছে। আমরা সংবিধান সংস্কার থেকে ঐকমত্যে কমিশন সব বৈঠকে আমাদের প্রতিনিধি ছিল, ইসিতেও আমরাই নিয়মিত যোগাযোগ করছি । জুলাই সনদে আমি স্বাক্ষর করেছি।”
ইসি বিবদমান বিষয়টি সমাধান করে কমিটির তথ্য হালনাগাদ করবে বলে আশা রাখেন তিনি।
ইসির তিন বার্তা
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “যারা পেশী শক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে-এটাই ইসির বার্তা। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হবে না। অপপ্রচার ছাড়ালে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কর্মকর্তারা পক্ষাপাতদুষ্ট হলে সে বা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ তিনটি বার্তা ইসির।”
ইসির এখতিয়ারের মধ্যে আইনি সংস্কার করার পাশাপাশি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ নির্বাচন কমিশনার জানান, বিগত দিনগুলোই নির্বাচনি সংস্কৃতিতে নানা ধরনের দুর্বলতা ছিল। উৎসবের আমেজেই ছিল।
“কিন্তু ওভার এপিরিয়ড অব টাইম এ সংস্কৃতিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। দুঃখজনজন হলেও হলে মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়েছে, নির্বাচনের নামে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে জোরপূর্ব কেন্দ্র দখল, সিল মারা, না হয় প্রকাশ্যে বলা এই মার্কা দল ছাড়া কারো নির্বাচনে আসার দরকার নেই-এটা আমাদের কালচারাল ড্যামেজ করে দিয়েছে। এটাকে আমাদের আন-ডু করতে হবে।
“ভালো জায়গায় নিতে হবে, এটা আমাদের কালেকটিভ রেসপনসিবিলিটি। এটা করতে না পারি আমাদের ক্ষতি বড় ক্ষতি হবে জাতির। সব দলের কাছে আহ্বান-চলুন, আমরা ভালো সংস্কৃতির পুনপ্রতিষ্ঠা করি। এজন্য সহাবস্থান, সহনশীল মনোভাব দরকার, সহযোগিতা দরকার।”
আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ইসির ভুলের শেষ নেই। আশ্বস্ত করছি- এ ভুলের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে লক্ষে কাজ করছি।”
পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপ ১৮ নভেম্বর উদ্বোধন করার কথা তুলে ধরে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, বৈশ্বিকভাবে এটা সহজ পদ্ধতিও নয়। এ অভিজ্ঞতাটা খুব সহজ নয়। সর্বশেষ ভারতে ৪ কোটি প্রবাসীর মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজার নিবন্ধন করেছিল। মালয়েশিয়ায় ১৮ লাখ প্রবাসীর মধ্যে নিবন্ধন করাতে পেরেছিল ৫৫ হাজার।
“আমাদের ধারণা, আমাদের সমমানের স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবো আশা করছি। দলগুলোও যেন নিজেদের মধ্যে প্রচারণা চালান। এ ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করি, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করি।”
গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সতর্ক করে দেন তিনি।
“কোনোভাবেই যেন গোপনীয়তা ভঙ্গ না করি। কেউ যেন এভাবে ব্যবহার না করি-প্রবাস থেকে অমুক রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভোটের জোয়ার উঠেছে। তাহলে স্থানীয় নির্বাচন প্রভাবিত হবে, ভবিষ্যতে প্রবাস থেকে ভোট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও আইনি ব্যবস্থা নেবো। ঘোষণাপত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করবে।”
ভুয়া তথ্য রোধে সবার সহযোগিতা চান এ নির্বাচন কমিশনার।
এখন থেকেই ‘ভুলতথ্য চালাচালি শুরু হয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এখন থেকেই মিস ইনফরমেশন শুরু হয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। তফসিল ঘোষণার পর হয়ত ইসি এসবের দায় দায়িত্ব নিয়ে নেবে। কিন্তু ৬০-৬৫ দিন ব্যন্ডউথ বা ওয়েবসাইট ডাউন করে এর সমাধান হবে না। ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যহত হবে। ভালো তথ্যের সঠিক প্রবাহ, অপতথ্য রোধে সবার কাজ করা, আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ নিয়ে কাজ করবে।
“দল ও কর্মীবাহিনীকে অপতথ্য ছড়ালে দায়ী হবেন, অন্ধের মতো অপতথ্য যেন শেয়ার না করি। অপতথ্য ছড়ালে মাফ পাওয়া যাবে না, আচরণবিধি রয়েছে। ইসির পক্ষে এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, জাতির ক্রান্তিলগ্নে যা করণীয় আমরা করবো। তবে আপনাদের সহযোগিতা পেলে অনেক অল্পে ভালো নির্বাচন করতে পারবো।”
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আমরা নতজানু হব না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার দরকার করছি, ভালো নির্বাচন করার বিকল্প রাস্তা নেই। আপনাদের সহযোগিতা চাই। পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে দলগুলো যেন আগে থেকেই এক্সারসাইজ করে ভালো হবে। ”
পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে ভোটের আগের দিন চূড়ান্ত না করে আগে আগেই তালিকা করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, “আশা করি, দলগুলোর প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাবো। এটা জাতীয় বিষয় সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া। জাতি হিসেবে আমরা একসাথে কাজ করে কামিয়াব হব।”
তিনি বলেন, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানেই শুধু না ভোট হবে। নির্বাচিত হওয়ার পর হলফনামায় গোজামিল থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।