শাইখুল হাদিস মাওলানা মাহবুবুল হক কাসেমীর বর্ণাঢ্য জীবন
প্রায় চার দশক ধরে বুখারি শরিফের দরসে নিয়োজিত জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা মাহবুবুল হক কাসেমী পরকালের যাত্রা শুরু করেছেন। তাঁর ইন্তেকালে ছাত্র-ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এখানে সংক্ষেপে তাঁর জীবনকাহিনি তুলে ধরা হলো-
জন্ম ও বংশ পরিচয়: পিতা: মাওলানা শামসুল হক; দাদা: মৌলভি নাজেম আলী হাওলাদার। মাতুল ও পিতুল উভয়দিক থেকে উভয়দিক থেকে দ্বীনি সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: নলবুনিয়া, পোস্ট: পাড়েরহাট, থানা: জিয়ানগর, জেলা: পিরোজপুর।
শিক্ষা: নিজ এলাকায় প্রাইমারি শিক্ষা সমাপন করে পার্শ্ববর্তী এলাকা দারুল উলুম বাদুরা মাদরাসায় ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত উর্দু, ফার্সী ও মিযান জামাত সমাপ্ত করেন। অতঃপর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানাধীন কাজুলিয়া মাদরাসায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নাহবেমীর ও হেদায়াতুন্নাহু জামাত সমাপ্ত করেন। ১৯৭৮ সালে গরহরডাঙ্গা দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসায় কাফিয়া জামাত সমাপ্ত করেন ও বোর্ড পরীক্ষায় প্রশংসনীয় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ইং সাল পর্যন্ত আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় শরহেজামী, শরহে বেকায় ও হেদায়া জামাত সমাপ্ত করেন।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ইং সাল পর্যন্ত দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতে জালালাঈন, মেশকাত, তাকমিলে দাওরা ও তাকমিলে আদব লেখা-পড়া করেন। মেশকাত জামাতে মেধাতালিকায় সিরিয়াল নম্বরসহ প্রসংশনীয় নম্বরে উত্তীর্ণ হয়ে দারুল উলুম উলুম দেওবন্দে পড়া-লেখা সমাপ্ত করেন।
১৯৮৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ভারত এর অধীনে মাস্টার্স সমমানের উর্দু সাহিত্যের ওপর "কামেল” পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রশংসনীয় ফলাফল অর্জন করায় অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হন।
উল্লেখ্য, তাকমিলে দাওরায় দারুল উলুম দেওবন্দে পূর্ণ নম্বর ৫০ এর মধ্যে গড় নম্বর ৪৮ থেকেও বেশি হওয়ায় নিয়ম অনুসারে ইফতাতে ভর্তির তালিকায় নাম এসে যায়, তখনকার সময়ের দারুল উলুমের সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা মেরাজুল ইসলাম সাহেবের পরামর্শ ও হুকুমে ইফতা থেকে নাম কাটিয়ে তাকমিলে আদবে ভর্তি হন। পরের বছর হযরত মাওলানা মেরাজ সাহেব দারুল উলুম করাচিতে ইফতা পড়তে পাঠাবেন-মুফতি তাকী উসমানীর কাছে। সে মতে পরের বছর সব প্রস্তুতি চলছিল ঠিক রওয়ানার ১দিন পূর্বে দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা নাসির খান সাহেবের কঠিন নির্দেশে জামিয়া লতিফিয়া রাজেস্থান মাদরাসায় বুখারী শরীফ ও তিরমিজী শরীফের শিক্ষক হিসেবে রওয়ানা হন। এখান থেকেই শিক্ষকতা জীবনের সূচনা।
১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত থেকে দু'বছরের মেহনতে কাতেবে খোশখতের
সনদ অর্জন করেন।
কর্ম: ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জামিয়া লতিফিয়া রাজস্থান ভারতে শিক্ষকতা। প্রথম বছর থেকেই বুখারী ২য় খণ্ড, তিরমিজী ১ম খণ্ড, মুসলিম ১ম খণ্ড ও মিশকাত ১ম খণ্ড পড়াতে থাকেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ইং জামিয়া রহমাতুল্লাহ আমলাপাড়া মাদরাসায় শিক্ষকতা এসময় বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড, মিশকাত শরীফ ১ম খণ্ড, হেদায়া ৩য় খণ্ড, মুছাল্লামুছ ছবুত, সুল্লামুল উলুম ও কাফিয়া কিতাবাদী পড়াতে থাকেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ইং পর্যন্ত জামিয়া আশরাফুল বায়যাবী শরীফ, হেদায়া ২য় খণ্ড ইত্যাদি কিতাবাদী অধ্যাপনার দায়িত্বে থাকেন। ২০০০ইং সালে জামিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটারা মাদরাসায় বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড, ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) জামাত খোলা হয়, এ বছর থেকেই এখানে বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড ও তিরমিজী শরীফ ১ম খণ্ড পড়ানোর খেদমতে নিযুক্ত হন। ২০০১ ইং সালে উল্লেখিত কিতাবদ্বয়ের সাথে মিশকাত শরীফ ১ম খণ্ড ইজাফা হয় সাথে নাজেমে তা'লিমাতের দায়িত্ব ২০০৪ইং পর্যন্ত পালন করতে থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ অদ্যাবধি জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ার খেদমতে নিয়োজিত আছেন এবং ১৯৯১ইং থেকে ২০১৯ইং পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ কেল্লা শাহী মসজিদে খেতাবতের দায়িত্ব পালন করে চলছেন।
ইসলাহী তায়াল্লুক: দারুল উলুম দেওবন্দে মেশকাত জামাত পড়াকালীন (১৯৮৩ইং) মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা মছিহুল্লাহ খান সাহেব জালালাবাদী রহ. এর হাতে বায়আতে সুলুক গ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা মছিহুল্লাহ খান সাহেবের ইন্তেকালের পর হযরত থানবী রহ. এর খলিফা হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেবের হাতে রুজু ও বাইআত গ্রহণ করেন। হযরত রহ. এর ইন্তেকালের পর হযরত আল্লামা মাওলানা কমরুদ্দীন সাহেব (শাইখে সানী দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত) এর হাতে রুজু ও বাইআত গ্রহণ করেন এবং ইজাযত ও খেলাফতপ্রাপ্ত হন।
বিদেশ ভ্রমণ: সৌদী আরব, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান।
মৃত্যু: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ মোতাবেক ২৩ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৭ হিজরী রোজ সোমবার সকাল ৮.২০ মিনিটে দীর্ঘ সাত বছর কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা হযরতের মানবীয় ভুলভ্রান্তি মাফ করে জান্নাতুল ফেরদাউসের ফায়সালা করুন। আমিন।