আবরার ফাহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা না করাটা হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষ সমর্থন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, 'কিছু অভিযুক্ত ভুক্তভোগীকে পেটানোয় সক্রিয়ভাবে অংশ না নিলেও তারা ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের চেষ্টা করেননি, যা এই হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয়।'
বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেয়া রায় প্রকাশিত হয়েছে।
আসামীপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বাসসকে জানান, ১৩১ পৃষ্ঠার রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি তিনি হাতে পেয়েছেন। এই রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, 'আবরার ফাহাদ শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে শুধু এমন অভিযোগে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে দেখা যায়। কিন্তু কোনো বিবেকবান ব্যক্তিদের এ ধরনের নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন করাটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। যেখানে তারা নিজেদের বুয়েটের মেধাবী ছাত্র বলে দাবি করে।'
এছাড়া হাইকোর্ট রায়ে বলেন, 'কিছু অভিযুক্ত ভুক্তভোগীকে পেটানোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা শাস্তির বাইরে থাকবে এবং দায় এড়াতে পারবেন। তারা সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের কোন চেষ্টা করেননি, যা এই হত্যকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয়।'
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে গত ১৬ মার্চ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। সে রায়ে বিচারিক আদালতের দেয়া ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হাইকোর্ট বহাল রাখেন।
হাইকোর্ট যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন তারা হলেন, মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর, হোসাইন মোহাম্মদ তোহা, মো. শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল জেমি, মো. শামসুল আরেফিন রাফাত, মো. মিজানুর রহমান, এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ।
হাইকোর্ট যে পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন তারা হলেন, মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা ও ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না।
হাইকোর্টে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, খন্দকার বাহার রুমি, নূর মুহাম্মদ আজমী, রাসেল আহম্মেদ এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জব্বার জুয়েল, লাবনী আক্তার, তানভীর প্রধান ও সুমাইয়া বিনতে আজিজ। আসামিপক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান, আজিজুর রহমান দুলু, মাসুদ হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ শিশির মনির।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর বর্বরোচিত ও নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। এ হত্যাকাণ্ডে সারাদেশের ছাত্র সমাজ ফুঁসে ওঠে এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ব্যাপক প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন এ নির্মমতার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানায়।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার আদালত। এরপর ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি আবরার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অন্যদিকে, আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। একপর্যায়ে গত বছর ৭ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এই মামলায় দ্রুত পেপারবুক তৈরি করে হাইকোর্টে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেন। সে ধারাবাহিকতায় হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শেষে রায় দেন হাইকোর্ট।
আবরার ফাহাদ ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বরকত উল্লাহ ব্যাংকার। আর মা রোকেয়া খাতুন একজন গৃহিণী। কুষ্টিয়া মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবরার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন এবং পরে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে এইচএসসি কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।
আবরার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ুক, তবুও আবরার ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে ভর্তি হন। তিনি বুয়েট এনার্জি ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি ক্লাবের সাথে জড়িত ছিলেন।