সোমবার ১০ নভেম্বর ২০২৫, কার্তিক ২৬ ১৪৩২, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ইসলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে অনশন

 প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১০ নভেম্বর ২০২৫

ইসলামের দৃষ্টিতে অনশন

প্রশ্ন: দাবি আদায়ের জন্য আমরণ অনশন করার বিধান কী? অনশনরত অবস্থায় কেউ মারা গেলে সে কি শহীদ বলে গণ্য হবে, নাকি আত্মহত্যাকারী হিসেবে বিবেচিত হবে?

উ: মানুষ নিজের প্রাণের মালিক নয়। প্রাণের মালিক কেবল মহান আল্লাহ তাআলা। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন। ইসলাম মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং আত্মহত্যাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

বর্তমানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘আমরণ অনশন’-এর প্রচলন দেখা যায়। বিশেষ করে উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে এ ধরনের আন্দোলনের সূচনা হয়। কিন্তু ইসলাম এ পদ্ধতির আন্দোলন সমর্থন করে কি না— সেটি জানা প্রয়োজন।

আত্মহত্যার শাস্তি

ইসলামে আত্মহত্যা সম্পূর্ণরূপে হারাম। কোনো পরিস্থিতিতেই এটি বৈধ নয়। মহান আল্লাহ বলেন “আর তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না।” (সূরা নিসা, আয়াত ২৯)

আরেক আয়াতে বলেন “তোমরা নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে ফেলো না।”(সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৫)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

“যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে চিরকাল লাফ দিতে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে সেই বিষ পান করতে থাকবে। আর যে ছুরি দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামে সেই ছুরি দিয়ে নিজেকে আঘাত করতে থাকবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৭৭৮)

আত্মহত্যাকারী কি স্থায়ী জাহান্নামি?

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো— যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু বরণ করবে, সে স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না।

যে হাদিসে আত্মহত্যাকারীর জন্য স্থায়ী জাহান্নামের কথা এসেছে, তা তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা আত্মহত্যাকে ‘হালাল’ মনে করে। আর যে আত্মহত্যাকে হারাম জানে কিন্তু দুর্বলতার কারণে তা করেছে, আল্লাহ তাআলা যতদিন ইচ্ছা তাকে শাস্তি দেবেন, এরপর ঈমানের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আল-মিনহাজ, ইমাম নববি: ২/১১৮)

আচরণ অনশন আত্মহত্যার শামিল

ইমাম আবু বকর রাজি (রহ.) বলেন “যে ব্যক্তি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থেকে মারা যায়, সে আত্মহত্যাকারী। যার কাছে খাবার ছিল কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে না খেয়ে মারা গেল, সে গুরুতর গুনাহগার।”(আহকামুল কোরআন: ১/১৭৭)

ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেন—

“নিজেকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনি নিজ হত্যার সহায়তা করাও পাপ।” (শরহুস সিয়ারিল কাবির: ৪/১৪৯৮)

ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-মুহিতুল বুরহানি-তে বলা হয়েছে—

“যে ব্যক্তি খাবার ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করেছে, তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত, কারণ সে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছে।” (আল-মুহিতুল বুরহানি: ৫/৩৫৭)

প্রখ্যাত তাবেয়ি ইমাম মাসরুক (রহ.) বলেন

“যে ব্যক্তি ক্ষুধায় মৃত্যুর মুখে, তার জন্য মৃত জন্তুর গোশত হলেও খেয়ে প্রাণ রক্ষা করা ওয়াজিব। না খেয়ে মারা গেলে সে গুনাহগার হবে।” (আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, ইবনে তাইমিয়া: ১/৩৮৯)

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন—

“চার মাজহাবের অভিমত হলো, ক্ষুধায় মৃতপ্রায় ব্যক্তির জন্য প্রাণ রক্ষায় নিষিদ্ধ খাদ্যও সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা ওয়াজিব।” (আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা: ৫/৫৪৭)

অনশন বা ধর্মঘটের বিধান উপরের দলিলাদির ভিত্তিতে স্পষ্ট যে

যেকোনো উদ্দেশ্যে না খেয়ে মারা যাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। বৈধ বা অবৈধ কোনো দাবির ক্ষেত্রেই আমরণ অনশন, অর্থাৎ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খাবার ত্যাগ করা, ইসলামে নিষিদ্ধ।

তবে যদি বৈধ দাবি আদায়ের জন্য সাময়িক অনশন বা ধর্মঘট করা হয়, এবং এতে প্রাণহানি বা গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে, তাহলে তা শর্তসাপেক্ষে অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু ক্ষতি বা মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিলে অবিলম্বে অনশন ভেঙে খাবার গ্রহণ করা আবশ্যক। অন্যথায়, সে আত্মহত্যার শামিল হবে এবং তার শাস্তি জাহান্নাম। (কিফায়াতুল মুফতি: ৯/৩০৫; ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া: ২/৩৫৮)

পরকালের কঠিন শাস্তিতে বিশ্বাসী কোনো মুসলমান কখনো আমরণ অনশন বেছে নিতে পারে না— সে যত বড় বিপদ বা অন্যায়েরই শিকার হোক না কেন। সামান্য দুনিয়াবি লাভের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করা ইসলামী দৃষ্টিতে ভয়াবহ গুনাহ।