‘মা, আমি না থাকলে তোমরা কি চলতে পারবে না?’- এ প্রশ্ন শহিদ সাজ্জাদের
‘মা, আমি না থাকলে তোমরা কি চলতে পারবে না?’- জীবনের শেষ খাবার খেতে বসে মাকে এই প্রশ্নই করেছিল শহিদ সাজ্জাদ।
মায়ের সামনে বসে ভাত খেতে খেতে সাজ্জাদের কি মনে হয়েছিলো সে আর ফিরবে না? ওর মনে কি তখন শহিদের অমরত্ব লাভের আকাক্সক্ষা জেগে উঠেছিলো? নাকি এমনি এমনি মাকে কথাগুলো বলেছিলেন সাজ্জাদ হোসাইন (২৯)। এই প্রশ্নই এখন তাড়া করে ফিরছে শহিদ সাজ্জাদের পরিবারের সবাইকে।
গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্ততি নেন সাজ্জাদ হোসাইন। আগের দিন রাতে আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে বাবা-মায়ের অনুমতিও নেন। ভাই যাতে বাসা থেকে বের হতে না পারেন সেজন্য ছোট বোন নিশাত তাসনীম তার পরিচয় পত্র লুকিয়ে রাখলেও সেটি ভাইয়ের জিদের কাছে বের করে দিতে বাধ্য হয়। সকালে ভাত খেতে খেতেই মায়ের সাথে শেষ কথা হয় তার।
সাভারের কলমার দক্ষিণ আউকপাড়ার স্বপ্নপুরী হাউজিংয়ের ভাড়া বাড়ির বাসিন্দা আলমগীর হোসেন ও শাহীদা বেগম দম্পতির পুত্র সাজ্জাদ হোসাইন। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সাজ্জাদ বড়। ছোট দুই বোন আয়শা সিদ্দিকা (২০) ও নিশাত তাসনিম (১৪)। আয়শার বিয়ে হয়েছে।নিশাত আগে মাদ্রাসায় পড়লেও বর্তমানে পড়াশোনা বন্ধ।
সাজ্জাদের পিতা আলমগীর হোসাইন পেশায় মোয়াজ্জিন। গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুরে। তবে পেশাগত কারণেই তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে আবাস গাড়েন সাভারে।
সাজ্জাদ হোসাইন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজি (এএমটি) ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ছিলেন। সাভার থেকেই মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে যেতেন। বাবার সাথে পরিবারের হাল ধরতে গাজীপুরের মাওনায় একটি কোম্পানীতে সাজ্জাদ খন্ডকালীন চাকুরী নিয়েছিলেন। পরিবারে সহায়তার পাশাপাশি ছোট বোন নিশাত তাসনিমের দায়িত্বও তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে সব ল-ভ- হয়ে গেছে। মূহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়েছে সবকিছু।
সাজ্জাদ হোসাইনের পিতা আলমগীর হোসেন মুঠোফোনে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজপথে সক্রিয় ছিল সাজ্জাদ হোসাইন। আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে বাসা থেকে নিষেধ করা হলেও বন্ধুদের নিয়ে চলে যেত সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় পত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখলেও আন্দোলনে যাওয়া থেকে ফেরানো যেত না তাকে। আন্দোলন থেকে বাসায় ফিরে পরিবারের সাথে আলাাপ করতো আন্দোলন প্রসঙ্গে। আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যেত সে। গত ৪ আগস্ট রাতের খাবারের সময় বাসায় ওর মা’র কাছে বলে, কাল আমার বন্ধুরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে আসবে আন্দোলনে। এখান থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যাবে সবাই। আমিও আন্দোলনে যাবো আমার বন্ধুদের সাথে। তখন সবাই নিষেধ করা সত্ত্বেও বায়না ধরে আন্দোলনে যাওয়ার। রাতে ওর ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় পত্র লুকিয়ে রাখলেও সাজ্জাদের জেদের কারণে তা দিতে বাধ্য হয় । পরদিন ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠেই আন্দোলনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় সাজ্জাদ। ওর মা সকালের খাবার তৈরি করে দেয়। মা’র সামনে বসেই জীবনের শেষ খাবার খায় সাজ্জাদ। ওই সময়েই মাকে প্রশ্ন করেন, তাকে ছাড়া তাদের চলবে কি না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলনে শরীক হতে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সাজ্জাদ।
তিনি জানান, দুপুরে সাজ্জাদের ফোন থেকে ছোট বোন নিশাতের কাছে ফোন করে অপরিচিত এক ব্যক্তি খবর দেয় সাজ্জাদের গুলি লেগেছে এবং তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সাজ্জাদের বাবা ছোট মেয়েকে নিয়ে দ্রুত এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে দেখতে পান ছেলেকে।
তিনি বলেন, সেখানে আমার ছেলেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, গুলিতে ওর কিডনী, ফুসফুস ও নাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। দ্রুত রক্ত লাগবে। চিকিৎসকরা তখন আমাকে দ্রুত ৮ ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করতে বলেন । আমি তখন আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে রক্তের কথা বলি। সাজ্জাদের বন্ধুরাও রক্ত দিতে এগিয়ে আসে। অনেক কষ্টে ৮ ব্যাগ রক্ত যোগাড় হয়। পরদিন সকাল পর্যন্ত ৫ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় ওর শরীরে। এরপর আর রক্তের প্রয়োজন হয়নি। নিভে যায় জীবন প্রদীপ। ইহজীবনের মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য পরকালের বাসিন্দা হয়ে যায় সাজ্জাদ। পরে সাভারের কলমায় জানাজা শেষে লাশ নিয়ে আমরা চলে আসি গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুরে। সেখানেই দ্বিতীয় জানাজা শেষে কবরস্থ করা হয় তাকে।
সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে দিশেহারা শহিদ সাজ্জাদের মা শাহীদা বেগম । সাজ্জাদের শেষ কথাগুলো যেন তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শাহীদা বেগম বাসসকে বলেন, ৫ আগস্ট সকালে আমিই সামনে বসিয়ে ওকে খাওয়াই। প্লেটে ভাত বেড়ে দেই। পেট ভরে ভাতও খায় ও। বলে, ‘মা আমি না থাকলে তোমরা কি চলতে পারবে না?’ তখন আমি বলি, এটা কোন ধরনের কথা। ও তখন অন্য কথা বলে এড়িয়ে যায়। সকালের খাওয়া-দাওয়া শেষে আন্দোলনে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সাজ্জাদ। এর পরদিন ওর মৃতদেহ আনা হয় বাড়িতে।
তিনি ছেলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে আলমগীর হোসেন বলেন, বয়স হয়েছে আমার। আমি আর কতো দিন। সপরিবারে আমরা এখন গ্রামের বাড়ি সৈয়দপুরেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিন সন্তানের মধ্যে এই একটি মাত্রই ছেলে ছিল আমার। অনেক কষ্টে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছি। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলে সংসারের হাল ধরেছিল। বোনের লেখাপাড়ার দায়িত্বও নিয়েছিল। ও অনেক বড় হবে- আমাদের পরিবারের সকলের স্বপ্ন ছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটি এতিমখানা ও মাদ্রাসা করার স্বপ্ন ছিল আমাদের পিতা-পুত্রের। বাকি জীবন সেখানেই ইমামতি করার ইচ্ছে ছিল আমার। ইচ্ছে ছিল বাপ ছেলে মিলে টাকা জমিয়ে জমি কিনে মাদ্রাসা করার। কিন্তু একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সব স্বপ্ন আমার বিষাদে পরিণত হয়ে গেছে।
সাজ্জাদের বন্ধু মামুন জানান, আমি আর সাজ্জাদ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। আমরা একসাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে চলামান আন্দোলনে অংশ নেই। সেখান থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ যাওয়ার জন্য রওনা দেই। সাভার বাজার বাসষ্ট্যান্ড এলাকা পর্যন্ত আমরা আন্দোলনকারীরা একসাথে আসি। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আমাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে পুলিশসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আমরা দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকি।
টিয়ারসেলে আমার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেলে আমি চাপাইনের সড়কের দিকে ঢুকে পড়ি। এসময় সাজ্জাদ আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই অন্ধ কল্যাণ সংস্থা মার্কেটের সামনে পৌঁছালে কোন এক ভবনের ছাদের ওপর থেকে সাজ্জাদকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সাজ্জাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের বাধার কারণে আমি আর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি। পরে আমি আমার মামার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। একপর্যায়ে আমি সাজ্জাদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনতে পাই। পরদিন সকালে হাসপাতালে গিয়ে সাজ্জাদকে মৃত অবস্থায় দেখি।
মামুন বলেন, সাজ্জাদ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কোন অন্যায় দেখলে এর প্রতিবাদ করতো। আমি আর সাজ্জাদ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই একসাথে অংশ নিয়েছি। সাজ্জাদকে হারিয়ে আমাদের বন্ধু মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সাজ্জাদ হোসাইনের ছোট বোন নিশাত তাসনিম বলেন, বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখি আমার ভাইয়াই আমার পড়াশোনার বই-খাতাসহ যাবতীয় সামগ্রী কিনে দিতেন। কখন কি লাগবে জিজ্ঞেস করতেন। এক কথায় বাবার দায়িত্ব পালন করতেন আমার ভাইয়া। গত ৫ আগস্ট আন্দোলনের দিন আমি ভাইয়ার পরিচয় পত্র লুকিয়ে রেখেও ফেরাতে পারি নাই। ও জোর করেই সকালে আন্দোলনে গিয়েছে। পরে দুপুরের দিকে ভাইয়ার ফোন দিয়ে অপরিচিত এক ব্যক্তি আমাদের জানায় এই মোবাইলের লোক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন আমি আর আমার বাবাসহ অন্যরা হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই পরদিন ৬ আগস্ট সকালে মারা যায়।
আমার ভাই দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন, শহিদ হয়েছেন। এটা আমাদের গর্ব। কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই।