মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪, আশ্বিন ২৩ ১৪৩১, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

স্পেশাল

পরিবারের সবার ছোট রিয়াজ চলে গেলেন সবার আগে, সকল শূন্য করে

 প্রকাশিত: ১৬:১৯, ১ অক্টোবর ২০২৪

পরিবারের সবার ছোট রিয়াজ চলে গেলেন সবার আগে, সকল শূন্য করে

পরিবারের সবচেয়ে যে ছোট, সেই চলে গেছে সবার আগে, সকল শূন্য করে। দেশ সেবার স্বপ্ন, পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচাবার স্বপ্ন, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন সব ঘুচে গেছে এক লহমায়। একটি গুলি কেড়ে নিলো সব।  

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ রিয়াজ হোসেন (২১) কেরানীগঞ্জ মডেল থানার তারানগর ইউনিয়নের ছোট ভাওয়াল গ্রামের বাসিন্দা আসাব উদ্দিন ও শেফালী বেগম দম্পতির পুত্র। চার ভাই বোনের মধ্যে রিয়াজ সর্বকনিষ্ঠ।  

জেলার সদর উপজেলার ইস্পাহানি ডিগ্রি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের মেধাবি ছাত্র ছিলেন রিয়াজ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন তিনি। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে জুলাই মাসের শুরুতে আন্দোলনে নামে ছাত্ররা। প্রথমদিকে আন্দোলন অহিংস থাকলেও পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠলে ১৫ই জুলাই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। দেশব্যাপী জনগণ  ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে।

রিয়াজ ১৯ জুলাই মিছিলে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই বিকেলে বাসা থেকে বের হন।  সেদিন অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে বছিলা ব্রিজ পেরিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থান নেন। সেদিনই বিকেলে মোহাম্মদপুর র‌্যাব ক্যাম্প-২ এর সামনে মাথায় গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই নিহত হন রিয়াজ। কিন্তু পরিবার সে খবর পায়নি। রাতে রিয়াজ বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন এলাকায় খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করেন।

পরদিন রিয়াজের বন্ধু শুভ জানান, রিয়াজের গুলি লেগেছে এবং তাকে কোনো এক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

এ খবর পেয়ে দিশেহারা বাবা আসাব উদ্দিন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের খোঁজ শুরু করেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ২০ জুলাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রিয়াজের লাশের সন্ধান পান।

রিয়াজের বন্ধু রাকিব বলেন, র‌্যাব ক্যাম্প-২-এর সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রতিপক্ষের গুলিতে  রিয়াজের মাথার পেছনে গুলি লাগে। সেখান থেকে আন্দোলনকারীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পরিবারের সবচেয়ে  ছোট ছেলেটির মৃত্যুতে স্তব্ধ রিয়াজের পরিবার। রিয়াজের মা শেফালী বেগম বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। দেশের মানুষের ভাগ্য বদলানোর জন্য ছেলে শহিদ হয়েছেন, এটাই যেন একমাত্র সান্তনা মায়ের।

তিনি  বলেন, ‘আমার ছেলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে শহিদ হয়েছে তা যেন বাস্তবায়ন হয়। দেশের মানুষ যেন তার সুফল ভোগ করতে পারে। দেশের মানুষ যেন আমার ছেলেকে ভুলে না যায়। ছেলের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দেশবাসীর সবার কাছে দোয়া চাই।’
শেফালী  বেগম  বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে যারা হত্যা করেছে আল্লাহপাক তাদের উপযুক্ত বিচার করবেন। মানুষ রিয়াজ হত্যার বিচার না করলেও আল্লাহ ঠিকই তার হত্যার বিচার করবেন। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার কেউ আজও খোঁজ নেয় নাই। তাদের কাছে আমার কোনো দাবি নাই।’

জানা যায়, বাবার সঙ্গে কৃষিকাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন রিয়াজ। বাড়তি উপার্জনের আশায় কিছুদিন ধরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারি ম্যানের চাকরি নেন। ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার।

রিয়াজের বাবা আসাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো দল করত না। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল। দুই  ছেলে মিলে কয়েকবার সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। সরকারি চাকুরির  বৈষম্য দূর করতে আমার ছেলে আন্দোলনে গিয়েছিলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার চাকরি করা হলো না।  আমার ছেলেকে কেন এভাবে নির্মমভাবে মরতে হলো? আমি ছেলে হত্যার সঠিক বিচার চাই।’

রিয়াজের বড় বোন আফরোজা  আক্তার লাবনী জানান, বাবা ও দুই ভাই কৃষিকাজ করে কোনো রকম সংসার চলে। সবার ছোট রিয়াজকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। ওর ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। কিন্তু ঘাতকের বুলেটে রিয়াজের সেই স্বপ্ন ফুরিয়ে গেলো। রিয়াজ বলতো, ‘এই আন্দোলন না করলে মেধাবীদের অনেকেই চাকরি পাবে না। এ আন্দোলন শুধু আমার একার জন্য না এটা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য।’
গত ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার সকালে ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানুল্লাহ আমান শহিদ রিয়াজের পরিবারের সাথে দেখা করেন। তিনি রিয়াজের পরিবারের হাতে নগদ টাকা তুলে দেন। পরে তিনি কেরানীগঞ্জের তারানগর ছোট ভাওয়াল জামে মসজিদ কবরস্থানে শহিদ রিয়াজের কবর জিয়ারত এবং আন্দোলনে দেশব্যাপী শহিদ ছাত্র-জনতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।   

সেখানে তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জে ছাত্র আন্দোলনে একমাত্র শহিদ রিয়াজ আমাদের গর্ব। শহিদ রিয়াজের  আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য রিয়াজ । তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য  কেরানীগঞ্জের গাটাচর চত্বরের নাম শহিদ রিয়াজ হোসেন চত্বর হবে বলে ঘোষণা দেন। এই চত্বরের মাধ্যমে শহিদ রিয়াজ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।

জানা যায়, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর স্থানীয় শাখার পক্ষ থেকে রিয়াজের পরিবারের সাথে নেতৃবৃন্দ দেখা করেন এবং তাদের সান্তনা দেন।  নেতৃবৃন্দ রিয়াজের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, আমরা আপনাদের পাশে আছি।  মহান আল্লাহ আপনাদের ছেলে রিয়াজকে শহিদের মর্যাদা দান করুন। জামায়াত নেতারা শহিদ রিয়াজের পিতা মাতার হাতে  নগদ অর্থ সহায়তা তুলে দেন।

কেরানীগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র -জনতার আন্দোলনে শহিদ রিয়াজ হোসেন হত্যা মামলায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহ আলী (৪২)কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তিনি এই মামলার ১৯৬তম আসামি ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর)  র‌্যাবের একটি দল তার নিজ বাড়ি রোহিতপুর ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করে।