খালেদা জিয়ার মৃত্যুর শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চায় বিএনপি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুর শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চায় দলটি; ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে যার নেতৃত্বের ভার পড়েছে সাবেক এই প্রধামন্ত্রীর বড় ছেলে তারেক রহমানের ওপর।
মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, তারা খালেদা জিয়ার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চান।
৪০ দিন ধরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মঙ্গলবার ভোর ৬টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
তার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, বুধবার তার জানাজার দিনে এক দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপিও সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে।
স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসা খালেদা জিয়া চার দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিন দফায় দশ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে করেছেন দেশ শাসন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে আন্দোলনে আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, “দেশনেত্রীর নেত্রীর ইন্তেকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হল এবং এই ক্ষতির পূরণ সহজে সম্ভব নয়।
“আজকে এমন একটা সময়ে তিনি চলে গেলেন যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। যখন গণতন্ত্রের উত্তোরণের জন্য একটা নির্বাচনের দিকে জাতি যাচ্ছে, যখন সমস্ত জাতি তৈরি হয়েছে নির্বাচন করে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সেই সময় তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন।
“এই শোক, এই বেদনা আমাদের পক্ষে ধারণ করা খুব কঠিন। তারপরেও আমরা এই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চাই। আমরা দেশনেত্রীর নির্দেশিত যে পথ সেই পথকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আমরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাই এবং সেই পথকে লক্ষ্য করে একটা সুষ্ঠ, আবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আসুন আমরা আজকে সবাই শোককে শক্তিকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে একটা অপ্রতিরোদ্ধ দল হিসেবে গড়ে তুলি। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠিত করি।”
স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে কার্যালয়ের বাইরে জনাকীর্ণ সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “আপনারা সবাই জানেন, যেই নেত্রী দীর্ঘদিন, তার রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সমস্ত অংশটাই তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলোকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য।
“তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তখন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য তিনি কাজ করেছেন। জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। আর যখন বিরোধী ছিলেন তখনও তিনি একইভাবে সেই গণতন্ত্রকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।”
বুধবার বেলা ২টায় জানাজা
মির্জা ফখরুল বলেন, “আগামীকাল বুধবার তার (খালেদা জিয়া) জানাজা অনুষ্ঠিত হবে, দাফন হবে। জানাজার জন্য আমরা স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, দুপুর ২টায় পার্লামেন্ট ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে মাঠ এবং মানিক মিয়া এভিনিউর এই পুরো অংশ জুড়ে আমাদের নেত্রীর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
“এই জানাজার নামাজ পড়াবেন আমাদের জাতীয় মসজিদের খতিব অর্থাৎ বায়তুল মোকাররমের খতিব। আর এই জানাজায় পুরো বিষয়টাকে নিয়ে যিনি সঞ্চালন করবেন তিনি হচ্ছেন, আমাদের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
“এরপরে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক বাংলাদেশের আরেক কিংবদন্তি নেতা, যাকে রাখাল রাজা বলে এই দেশের মানুষ, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধি, তারই পাশে আমাদের মহান নেত্রীকে সমাধিস্থ করা হবে, দাফন করা হবে।”
জানাজায় শৃঙ্খলা মানার আহ্বান
খালেদা জিয়ার জানাজায় সবাইকে শৃঙ্খলা মানার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, “আমরা সবাই অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে এই জানাজায় অংশগ্রহণ করব এবং যে শৃঙ্খলার কথা বলা হবে, আমি বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে অনুরোধ জানাবো, আপনারা সেই শৃঙ্খলা মেনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জানাজা পড়বেন এবং তারপরে তাকে দাফনে অংশগ্রহণ করবেন, যাদের দায়িত্ব তারাই অংশগ্রহণ করবেন।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “অনুরোধ থাকবে আপনাদের কাছে যে, আপনারা কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করে শুধুমাত্র ছবি তোলার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন না এবং ব্যাহত করবেন না এই পুরো কর্মসূচিকে।
“আমরা বিশ্বাস করি, দেশনেত্রীর প্রতি আপনাদের যে সম্মান, যে শ্রদ্ধা সেটাকে অটুট রাখার জন্য আপনারা সেই শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন এবং সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করবেন এই জানাজা ও দাফনকার্য সুচারূপে সমাধান করতে।”
‘সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আপনারা জানেন যে ইতোমধ্যেই সরকারের তরফ থেকে তিনদিন শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে, আগামীকাল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে প্রধান উপদেষ্টা, তিনি বাণী দিয়ে কথা বলেছেন, জাতির সামনে কথা বলেছেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
“সেই সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে আপনারা জানেন যে, সাত দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এই সাতদিন আমাদের কালো পতাকা আমরা ধারণ করব, কালো ব্যাচ ধারণ করব। কালো পতাকা উঠবে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে এবং প্রত্যেক কার্যালয়ে দোয়া পড়া হবে, কোরআন তেলাওয়াত হবে।”
এর আগে বেলা ১২টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়।
আড়াই ঘন্টার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন।