সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, কার্যকর চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
এর মধ্য দিয়ে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারে অধীনেই হবে।তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার এ রায় ঘোষণা করে।
বেঞ্চের অপর ৬ বিচারক হলেন– বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ২০১১ সালের সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন হলে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় সর্বোচ্চ আদালত।
বৃহস্পতিবার সেই আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করল আপিল বিভাগ।
রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়টি ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হল।
আপিল বিভাগ বলেছে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এর নির্দলীয় সরকার–সম্পর্কিত বিধানবলি, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের ৩ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হল।
তবে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত বিধানবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী জয়নাল আবদিন বলেন, “এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবে।"
রিটবারী পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ছিলেন মোহামদ শিশির মনির।
এছাড়া ইন্টারভেনর হিসেবে ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ, ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৃত্তান্ত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হয়েছিল তিন দশকেরও বেশি সময় আগে।
সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তবে তখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ ছিল না।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ওই সময়ে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে সে পদে বসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
দশজন উপদেষ্টাকে নিয়ে তিনি নতুন মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সেই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৯৬ সালে দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে ওই বছরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে তৎকালীন বিএনপি সরকার।
সেই বিধান অনুসারে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন হয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে।
১৯৯৬ সালের ক্রয়োদশ সংশোধনী আইন অনুযায়ী দুইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল। কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে তার ১৫ দিনের মধ্যে। এবং সরকারের মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে।
ওই আইনে বলা ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১ সদস্যের বেশি হবে না৷ এর মধ্যে একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা থাকবেন৷ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দেবেন।
একজন উপদেষ্টার সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে;
তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো সংগঠনের সদস্য হবেন না; পরের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার লিখিত সম্মতি দেবেন এবং তার বয়স ৭২ বছরের বেশি হবে না।
সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি হবেন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। যদি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তার ঠিক আগে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে।
যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অসম্মতি জানান, তাহলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরে গেছেন, তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে না পাওয়া গেলে, বা তারা কেউ প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি না হলে রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেবেন। সেভাবেও যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি তার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার নেবেন৷
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচন অনেকটা গ্রহণযোগ্য হলেও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই বাঁধে বিপত্তি।
সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সে সময়ের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এ নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন।
পরে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে।
এদিকে আওয়ামী লীগের আগের সরকারের সময়ে ১৯৯৮ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী।
পরে বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধই থাকে।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিট আবেদনকারীরা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবী বক্তব্য দেন।
তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন জমা পড়ে।
গত বছরের ২৭ অগাস্ট একটি আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। একই বছরের ১৬ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এরপর ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একটি রিভিউ আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন।
এ চার রিভিউ আবেদনের একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ অগাস্ট আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়। ২১ অক্টোবর আপিলের শুনানি শুরু হয়। টানা ১০ দিন শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ মামলার রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন রাখে।
এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ফলে তখনই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফেরার পথ তৈরি হয়।
এবার ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আপিল ব্ভিাগের রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল হল।