সোমবার ১৭ নভেম্বর ২০২৫, অগ্রাহায়ণ ৩ ১৪৩২, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

শঙ্কা ও আতঙ্কের ঢাকায় কড়া নিরাপত্তা

 প্রকাশিত: ১০:৫৪, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

শঙ্কা ও আতঙ্কের ঢাকায় কড়া নিরাপত্তা

জুলাই অভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনার বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের ডাকা কর্মসূচির মধ্যে বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ, নগরজুড়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর টহল, তল্লাশি আর গ্রেপ্তারের ঘটনায় তৈরি হয়েছে শঙ্কার পরিবেশ।

এ অবস্থায় হামলাকারীদের ঠেকাতে ঢাকার পুলিশের নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর, এবার গুলির নির্দেশনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন বাহিনীর সদস্যরা।

মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি, বাড়ানো হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটির নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তায় আগে থেকেই মাঠে আছে সেনাবাহিনী।

এর মধ্যেই অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার নোটিশ দিয়েছে। ঢাকার অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানি কর্মীদের নিরাপত্তায় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করতে বলেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারের রায় সোমবার ঘোষণার দিন ধার্য করেছে।

এ দিনটি ঘিরে আওয়ামী লীগ অনলাইনে রোববার থেকে দুই দিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

তার আগে রায়ের দিন ঘোষণা ঘিরে ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর বিক্ষোভ ও ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি দেয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা থাকা আওয়ামী লীগ। তাদের কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে।

কর্মদিবসের প্রথম দিনে রোববার সকালে রাজধানীর সড়কগুলো যানজটময় হয়ে উঠতে না উঠতেই ইস্কাটন এলাকায় পাওয়া যায় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ। আহত হন একজন পথচারী।

এরপর রাত পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আরও ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারার উত্তর দিকে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রাতে জুরাইন ও বাংলামোটরে হাতবোমার বিস্ফোরণ হয়।

সার্ক ফোয়ারার ঘটনায় পুলিশের রমনা বিভাগের উপ কমিশনার মাসুদ আলম বলছেন, ঘটনাটি ঘটেছে কলাবাগান থানা এলাকায়। এতে কেউ হতাহত হয়নি।

এছাড়া ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বাসার সামনে ‘জোড়া হাতবোমা বিস্ফোরণ’ হওয়ার কথা বলেছে পুলিশ।

শনিবার রাতে রাজধানী ও উপকণ্ঠের চারটি এলাকায় পুড়েছে চার বাস। হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সরকারি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয় শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর বাস স্ট্যান্ডে রাত সোয়া ৩টার দিকে বলাকা পরিবহনে, সাভারের রাজ ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে রাত ৪টার দিকে ইতিহাস পরিবহনের বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। রোববার রাত ১০টার দেখে মধ্য বাড্ডায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।

বাসে অগ্নিসংযোগ ও হাতবোমা বিস্ফোরণের এসব ঘটনায় হাতেনাতে কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।

নগরজুড়ে টহল বাড়ানো, তল্লাশি চৌকি স্থাপন, হোটেল-মেসসহ সন্দেহজনক আবাসনে তল্লাশি মতো অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে শতাধিক গ্রেপ্তারের খবরও দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাতে বন্ধ হয়নি যানবাহনে আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণ।

এসব ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত রোববার বিকালে গুলির নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।

পুলিশ তৎপর থাকার কথা জানালেও শঙ্কা কাটছে না মানুষের। শেখ হাসিনার মামলার রায়কে সামনে রেখে হামলার ঘটনা আরও বাড়তে পারে, এই শঙ্কাও রয়েছে মানুষের মনে।

গুলির নির্দেশ পুলিশ কমিশনারের

পাঁচ দিনের ব্যবধানে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম পুলিশ তাদের ইউনিট প্রধানদের কাছ থেকে হামলাকারীদের গুলির নির্দেশ পেয়েছে।

রোববার বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির ওয়্যারলেস চ্যানেলগুলোতে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল নিক্ষেপ করতে এলে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।

পাঁচ দিন আগে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ-সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ সন্ত্রাসীদের ‘বার্স্ট ফায়ারের’ নির্দেশনা দেন। সেটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ওয়্যারলেসে বলেছি যে কেউ বাসে আগুন দিলে, ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করলে তাকে গুলি করতে। এটা আমাদের আইনেই বলা আছে।”

এই নির্দেশের আইনি ভিত্তি হিসেবে পুলিশ দেখাচ্ছে দণ্ডবিধিতে থাকা ‘ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার’কে।

ঢাকাসহ ৪ জেলায় বিজিবি মোতায়েন

বিভিন্নস্থানে আগুন ও হাতবোমা বিস্ফোরণের মতো সহিংস ঘটনার জেরে ঢাকাসহ চার জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। রোববার বিজিবি সদর দপ্তর এক বার্তায় ঢাকার ছাড়াও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলায় বিজিবি মোতায়েনের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

এসব এলাকায় ‘সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে’ বিজিবি দায়িত্ব পালন করছে বলেও তুলে ধরা হয়েছে বার্তায়।

ট্রাইবুনালে নিরাপত্তা জোরদার

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

রোববার সকাল থেকে হাই কোর্ট মাজার গেইট সংলগ্ন ট্রাইব্যুনালের ফটকে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। আইনজীবী, সাংবাদিক ও ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশ করতে হয়েছে পরিচয়পত্র দেখিয়ে।

বিজিবির নায়েক সুবেদার মো. হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ২০ সদস্যের একটি দল দায়িত্ব পালন করছে। রাতেও থাকবেন, সোমবারও থাকবেন।

সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তারা স্বাভাবিক সময়ে ১১৯ জন দায়িত্ব পালন করেন। এখন রয়েছেন ২২০ জন পুলিশ, ১২৩ জন এপিবিএন সদস্য।

“কালকের (সোমবার) জন্য আরও দুই প্লাটুন (৪০ জন) পুলিশ চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটকেও বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।”

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার রায় ঘোষণা করবে।

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক হলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

দোষী সাব্যস্ত হলে এ মামলায় শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে গেল ১০ জুলাই তিন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। আসাদুজ্জামান খান কামালও ভারতে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে।

প্রসিকিউশন তাদের দুইজনের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে তুলে ধরে প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছি। আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করবেন এবং আমাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা হচ্ছে যে এই অপরাধের দায়ে আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়।”