বাবার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে ফেরা হচ্ছে না তারেক রহমানের
দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে তার বাবার স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মইনুল রোডের বাড়িতে ফেরা হচ্ছে না তার। ক্যান্টনমেন্টের সেই বাড়ি ঘিরে রয়েছে তারেক রহমানের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, প্রয়াত ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর স্মৃতি।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধভাবে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে।
সেখানে নির্মাণ করে বহুতল ভবন। তাই দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে বাবা-মায়ের সেই স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে নয়, তাকে উঠতে হচ্ছে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাড়িতে।
মইনুল রোডের সেই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবেই পরিচিত। বাড়িটি নিয়ে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত অনুভূতিও গভীর আবেগের।
১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে ওই বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন জিয়াউর রহমান।
সেনাপ্রধান হওয়ার পর তিনি সেনাপ্রধানের নির্ধারিত বাসভবনে না উঠে সেই বাড়িতেই থেকে যান। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ এ বাড়িতেই জিয়াউর রহমানকে সপরিবারে অন্তরীণ করেন। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিপাহি-জনতা তাকে মুক্ত করে।
এরপর রাষ্ট্রপতি হওয়া থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহীদ জিয়া সেই বাড়িতেই থেকেছেন।
এই বাড়িতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া দম্পতির দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের সন্তানদের শৈশবও এখানেই শুরু।
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে শাহাদাতবরণের পর ওই বছর জিয়াউর রহমানের পরিবারকে বরাদ্দ দেওয়া হয় বাড়িটি। তৎকালীন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বাড়িটি খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেয়।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর যা ঘটে
বিএনপি চেয়ারপারসন এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অনেকটা জোর করে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেদিন বেলা ১১টার দিকে পুলিশ ও র্যাব খালেদা জিয়ার বাড়ির প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।
এ সময় তারা বাড়ির ভেতর ও বাইরে থেকে মাইকে বেগম জিয়াকে বের হয়ে আসতে বলেন। বের না হওয়ায় তার রুমে প্রবেশ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে গুলশান কার্যালয়ে পৌঁছে দেন।
ওই সময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বাড়ি থেকে আমাকে এক কাপড়ে বের হয়ে আসতে হয়েছে। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে সেখান থেকে বের করা হয়েছে। আমি প্রায় ৪০ বছর এই বাড়িতে কাটিয়েছি। আমার স্বামী জীবন দেওয়ার পর তার অনেক স্মৃতি নিয়ে এই বাড়িতে ছিলাম।
তিনি আরও বলেছিলেন, বর্তমান সরকার (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় আসার পর আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সরকার অযৌক্তিকভাবে যখন আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিল, আমি সর্বচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হই। কিন্তু তার আগেই সরকার আমাকে বাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনলো। এতে মহামান্য আদালতের সম্মান ও ভাবমূর্তি দলিত হলো।
বেদনাহত খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকারের এ আচরণে আমি শুধু অপমানিত ও লাঞ্ছিত নই, লজ্জিতও।
সেদিন তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সারাদিন আমাকে কিছু খেতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ তারা মিথ্যা কথা বলছে। আমি নাকি আমার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। সব মিথ্যা, বানোয়াট। ‘নিজে যেতে না চাইলে তুলে নিয়ে যাও’ বলেও একজন হুমকি দিয়েছে! তারা জবরদস্তি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। গ্রিল কেটে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। আমার লোকজনকে মারধর করেছে। লাথি মেরে মেরে বেডরুমের দরজা ভেঙেছে। আমাকে টানতে টানতে বাইরে এনেছে।
তিনি বলেন, আমি বিরোধী দলের নেত্রী। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী হিসেবেও সামান্য মর্যাদাটুকুও আমাকে দেখানো হয়নি!
সেই বাড়ির বর্তমান অবস্থা
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের তিন মাসের মধ্যেই শহীদ মইনুল রোডের সেই তিনতলা বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বাড়ির বদলে সেখানে দেখা যায় ফাঁকা মাঠ। পরের বছর ২৮ জুন সেখানে দেখা যায় বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গেছে। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর দেখা যায় একটি ১৪ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পথে।
বর্তমানে মইনুল রোডের ওই এলাকায় স্থান করে নিয়েছে আরশি, পড়শি, গাগরি, বিহঙ্গ ও আগামী নামের পাঁচটি বহুতল ভবন। প্রতিটি ভবনে ৫২টি সেনা কর্মকর্তা পরিবারের বাস। আরশি ও পরশি লে. কর্নেলদের জন্য। আর গাগরি, বিহঙ্গ ও আগামী মেজর পদবির সেনা কর্মকর্তাদের জন্য। এই পাঁচটি ভবন ছাড়াও সেখানে মসজিদ, প্লে গ্রাউন্ড—এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
তারেক রহমানের বাসভবন-কার্যালয় প্রস্তুত
গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাড়ি তারেক রহমানের বাসভবনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বাসভবনের দেয়াল নতুন করে সাদা রং করা হয়েছে, চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। পুরনো ছোট গেটের পরিবর্তে বড় গেট বসানো হয়েছে। ভেতরেও সম্পন্ন হয়েছে সংস্কারকাজ।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন জানিয়েছেন, গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাড়ি প্রায় প্রস্তুত। দেশে ফিরে তারেক রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয় থেকেই দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডে অবস্থিত ওই কার্যালয়ে নিরাপত্তা জোরদারসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ওই বছরের ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকার সামরিক অঞ্চলে বরাদ্দে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডে খালেদা জিয়ার বাড়িটির বরাদ্দ বাতিল করে। পরে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সেই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।