বৃহস্পতিবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, পৌষ ১১ ১৪৩২, ০৫ রজব ১৪৪৭

রাজনীতি

দেড় যুগের নির্বাসিত জীবন

 প্রকাশিত: ১২:০৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫

দেড় যুগের নির্বাসিত জীবন

দেশে তখন জরুরি অবস্থা, ক্ষমতায় সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার; ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী।

তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১৩ মামলা। যৌথ বাহিনীর হেফাজতে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তারেক রহমানকে ভর্তি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।

এক বছর পর, ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের জামিনে মুক্তি পান তারেক। সেই রাতেই স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য’ লন্ডনে চলে যান তিনি। শুরু হয় নির্বাসিত জীবন।

এদিকে দেশে শুরু হয় বিএনপির দুঃসময়। ২০১০ সালে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে উৎখাত হন তারেকের মা খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি সংসদের বাইরে চলে যায়, রাজপথই হয় দলটির ঠিকানা।

তবে বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারেনি বিএনপি। ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু হয়, যা ছিল তার জন্য বড় ধাক্কা। সেই বৈরী সময়েও তারেক দেশে ফিরতে পারেননি।

এর মধ্যে তার পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। কয়েক ডজন মামলার আসামি তারেক তখন আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক। তার পাসপোর্ট আর নবায়ন করা হয়নি। এক সময় শোনা যায়, তারেক যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সময়ে তারেকের বিরুদ্ধে আরো ৭২টি মামলা হয়। সব মিলিয়ে ৫টি মামলায় তার সাজার রায় আসে। এর মধ্যে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় জজ আদালত। হাই কোর্ট বাংলাদেশে তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে যেদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলে, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এরপর গত সাত বছর ধরে লন্ডন থেকে ভিডিও কলেই তিনি দল চালন। আর দেশে ঝড়-ঝাপটা সামলে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।

২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখা যায়নি।

৫ অগাস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেন। পরে উচ্চ আদালতও তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।

আওয়ামী লীগের আমলে দেওয়া বিভিন্ন রায়ে তারেকেরও সাজা হয়েছিল। সেসব মামলায় তারেকও খালাস পান। তাতে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তারপরও অজ্ঞাত কারণে তারেকের দেশে ফেরা হচ্ছিল না। এ বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। সেখানে দীর্ঘদিন পর ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়। চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া দেশে ফিরলেও তারেক ফেরেননি।

ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গেলে সেখানে তার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই তারা একমত হন, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ‘শিগগিরই’ ফিরবেন। তবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ তারা বলতে পারছিলেন না।

এর মধ্যে বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আংশিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। সেখানে জানানো হয়, বগুড়া-৬ আসনে প্রথমবারের মত ভোট করবেন তিনি। ওই ঘোষণার পর তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা জোরালো হয়।

২৩ নভেম্বর ফের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। এ অবস্থায় তারেক কেন ফিরছেন না, সেই প্রশ্ন আবার সামনে আসে।

২৯ নভেম্বর তারেক রহমানের এক বক্তব্যের পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “এমন সঙ্কটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মত আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সকলের মত এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”

তারেক রহমানের দেশে ফিরতে বাধা কোথায়, সেই প্রশ্ন তখন জোরেশোরে উঠতে থাকে। তিনি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন কি না, সেখানে তার ‘স্ট্যাটাস’ কী, সেসব প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারেক রহমানের পাসপোর্ট নেই, তবে তিনি চাইলেই ট্র্যাভেল পাসের ব্যবস্থা করা হবে।

অসুস্থ খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলেও তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে গত ১২ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দেন, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর দেশে আসবেন।

দেশে ফেরার প্রস্তুতিতে এক দিনেই লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে ট্রাভেল পাস পেয়ে যান তারেক রহমান। তার জন্য ঢাকায় বাসা ও অফিস গোছানোর খবর আসে।