আব্বাসীয় যুগে যেভাবে ফিকাহ ও ফতোয়া দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়
আব্বাসীয় শাসকরা বাগদাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সাথে শিক্ষাকেন্দ্রও সেখানে নিয়ে যান। তাই মদিনার পরিবর্তে বাগদাদই হয়ে ওঠে ইসলামী জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র। খলিফা আল-মানসুর এজন্য প্রথম দিকে হেজাজি বা মদিনার মুফতিদের নিজের কাছে ডাকেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সহযোগিতা লাভে অসমর্থ হন। অতঃপর ইরাকবাসী ফকিহ-মুফতিদের শরণাপন্ন হন। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁকে নিরাশ করেন। অবশেষে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সাম্রাজ্যের বিচার বিভাগকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। ইমাম আবু ইউসুফ ইমাম আবু হানিফার শিষ্য ছিলেন। তিনি আবু হানিফা (রহ.)-এর ইজতিহাদ (গবেষণা ও ফিকহি চিন্তাধারা)-এর ওপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন করেন এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান আশ-শায়বানি (রহ.) ওপর আইন শিক্ষাদানের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। এভাবে ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.)-এর মাধ্যমে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যভুক্ত সমগ্র মুসলিম জাহান একই ধরনের আইনের আওতায় চলে আসে। (শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬০)
এভাবে আব্বাসীয় যুগ শুরু হওয়ার পর ফকিহদের ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে ইরাকি কূফাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা এবং হেজাজি মদিনা কেন্দ্রিক চিন্তাধারা দুটি ধারা সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত হয়ে যায়।
এ দুটি ধারার বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :
ইরাকি কূফাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা : ইরাকবাসী ‘আহলুর রায়’ নামেও কারো কারো কাছে পরিচিত ছিলেন। এসব ফকিহ ফতোয়া প্রদানে কোরআন-সুন্নাহর পাশাপাশি রায় ও যুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী ছিলেন। তখনকার ইরাক ছিল পারসিক সভ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সেখানে নানাবিধ সমস্যার উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি, যাতে ফতোয়া প্রদানে নিজস্ব যুক্তি ও কিয়াসের ব্যবহার করার প্রয়োজন হতো। ইবরাহিম নাখঈ (রহ.)—যিনি এই ধারার ফকিহদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বলেন, ‘আমি একটি হাদিস শুনি, আর তার ওপর আরো এক শ মাসআলা কিয়াস করি।’ (ইবনু আব্দিল বার্র, জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৯৮হি), ২/৬৬)
এছাড়াও শিয়া ও খারেজিদের উত্পাত এবং রাজনৈতিক দলাদলির তীব্রতায় জর্জরিত ছিল ইরাক। নিজ নিজ স্বার্থে এসব দল-উপদল রাসুল (সা.)-এর হাদিস নিয়েও ছেলেখেলা শুরু করে এবং নিজ নিজ মতের অনুকূলে বহু বানানো কথা হাদিসের নামে প্রচার করা শুরু করে। ফলে ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে ইরাকি মুফতিরা কোরআন-সুন্নাহর পাশাপাশি যুক্তি ও কিয়াসের ব্যাপক চর্চা করেন। এই চিন্তাধারার ফকিহদের মধ্যে ইবনে মাসউদ (রা.), ইবরাহিম নাখঈ (রহ.), ইবনু আবি লায়লা, ইবনু শুবরামাহ, শুরায়েক আল-কাজি, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রমুখ নেতৃত্বে ছিলেন। (ড. উমর সুলায়মান আল-আশকার, তারিখুল ফিকহ আল-ইসলামী (আম্মান : দারুন নাফায়েস, ৩য় প্রকাশ, ১৯৯০ খ্রি), পৃষ্ঠা ৮৭)