শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রত্যয়: ‘মুক্তিযুদ্ধের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই’
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ফুল আর ব্যানার হাতে এবার মানুষের চিরায়ত ঢল নেই রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে।
তবে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলছেন, জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি এবারের পালনে রায়েবাজারে ‘কিছুটা পার্থক্য’ দেখছেন। শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের উপস্থিতি যেমন কম, তেমনই সাউন্ড সিস্টেমসহ অন্যান্য আয়োজনও নেই।
শহীদদের আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস সদস্যরা শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার এলাকায়, পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রোববার সকাল থেকেই সেই বধ্যভূমিতে স্থাপিত মিনারে সকাল থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হাজির হয়েছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শোক আর শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
দুই শিশু সন্তান নিয়ে রায়েরবাজারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন বেসরকারি চাকুরে আনিসুর রহমান। সন্তানদের মধ্যে একাত্তরের চেতনা ছড়িয়ে দিতেই তিনি প্রতিবারের মতো এবারও এখানে এসেছেন।
আনিসুর বলেন, “আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই জিনিসগুলো ধারণ করে যে, আমাদের এই দেশটা অল্প দামে কেনা নয়। এমনি এমনি ওরা এই দেশটা পেয়েছে তা না। অনেক লাখো শহীদের প্রাণ আছে, লাখো মানুষের অবদান আছে। এই বিষয়গুলো ওদেরকে জানানো, যাতে তাদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত হয়।
“দেশটাকে ধারণ করা এবং পালনের মধ্য দিয়ে বাকি জীবনটা যেন অতিবাহিত করে; এজন্য তাদেরকে নিয়ে এসেছি।”
তবে অন্যবারের চেয়ে এবারের আয়োজনের ‘পার্থক্যে’ হতাশা প্রকাশ করলেন তিনি।
আনিসুর বলেন, “অন্যসময় রাত থেকেই এখানে অনেক ধরনের আচার অনুষ্ঠান থাকে, আয়োজন থাকে। যেহেতু এখন সিচুয়েশনটা একটু ভিন্ন—এ কারণে এমন হতে পারে। অথবা মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা বা ভীতি রয়েছে; যারা এটাকে পালন করতো, তাদের মধ্যে কী হয়েছে আমি জানি না, মনে হচ্ছে সবকিছু মিলিয়ে অবশ্যই একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের জায়গাটা ‘নার্সিং করা দরকার’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “হয়তো একসময় এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে। তো সেই বাড়াবাড়িটাকে একদম বাদ দেওয়া, কিন্তু একদম ভুলে যাওয়ার সুযোগ তো নেই। এটা তো আমাদের চেতনার বিষয়। যে যাই আসুক, এই দেশকে চালাতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদীয়া আলিম মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা মোনাজাত করেন।
ওই মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ওবায়দুল্লাহ বলছিল, “আমরা একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমাদের হুজুররা আমাদেরকে নিয়ে এসেছেন।”
স্থানীয় মেধা বিকাশ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়ামও বলছিল, স্কুলের অনেক ছাত্র মিলে শিক্ষকদের সাথে এসেছেন শ্রদ্ধা জানাতে।
রায়েরবাজারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ডাকসু নেতৃবৃন্দ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, জুলাই যোদ্ধা সংসদ, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
সদ্য সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঢাকা-১০ আসনের ভোটারদের সঙ্গে নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, পালন করেন এক মিনিটের নীরবতা।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আসিফ মাহমুদ বলেছেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের এদেশের সাহসী বীররা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তারা যেই প্রত্যাশার জায়গা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেখান থেকে প্রাপ্তির পরিমাণটা অনেক কম। তবে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি।
“সেটা প্রতিষ্ঠার লড়াইটা আমাদেরকে গত ৫৪ বছর করে যেতে হয়েছে, সর্বশেষ এডিশন হচ্ছে ২০২৪। যেখানে আরো শত-সহস্র মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য।”
গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রনেতা হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া আসিফ বলেন, “আজকের এই দিনে আমরা দেখেছি, গত দুই দিনে বাংলাদেশে কী ঘটেছে। আমরা দেখেছি—ঠিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে পরাজিত হওয়ার আভাস পেয়ে এদেশকে মেধাহীন করতে চেয়েছিল; ঠিক একইভাবে ২০২৪ এর পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট শক্তি তারা পরাজিত হওয়ার পর এদেশকে নেতৃত্বহীন করার জন্য আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদেরকে টার্গেট করছে।
“তারই অংশ হিসেবে ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এখন জীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এবং আমরা জানতে পেরেছি যে আরো অনেককে হিটলিস্টে রাখা হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, একাত্তরে যেমন হানাদার বাহিনীর এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি, ঠিক একইভাবে এবারেও পরাজিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হবে না।”
গণসংগতি আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “৭১ সালের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি, সাম্য-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সকল নাগরিকের জন্য। ৫৪ বছর ধরে আমরা এই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত প্রতিশ্রুতির বিপরীতে হাঁটতে দেখেছি। এই দেশের শাসন ব্যবস্থা জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।”
তার ভাষ্য, “ক্ষমতা গদি টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা দেখেছি—কীভাবে সরকারগুলো এবং বিশেষভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার তারা একটা ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, আবারো হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।
“আমরা দেখছি যে, অনেকেই একাত্তর সাল আর চব্বিশকে একটা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা একাত্তর সালের আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতা।”
যারা চব্বিশকে একাত্তরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছে, তারা বাংলাদেশে এ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা-আকাঙ্ক্ষার বাইরে চলে যেতে চাইছে বলে মন্তব্য করেন জোনায়েদ সাকি।
তিনি বলেন, “পতিত ফ্যাসিস্টরা আজকে পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে অভ্যুত্থানের অর্জন, সেটাকে ব্যর্থ করে দিতে চাইছে এবং তারা কিলার বাহিনী নিয়োগ করে, তারা বিভিন্ন ভাবে আজকে সারাদেশে একটা অরাজকতা-আতঙ্ক তৈরি করছে।
“ওসমান হাদিকে আক্রমণ করা হয়েছে এবং তারা আরো অনেক প্রার্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হামলা করতে চায়, হত্যা করতে চায়।”
এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়ের বাজারে জনসাধারণের উপস্থিতি কমকে কোনো সংকট হিসেবে দেখতে নারাজ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেছেন, “এখানে লোক কম থাকলেও মিরপুরে ব্যাপক সমাগম রয়েছে। তাই লোক কম বা বেশি দিয়ে কিছু বিচার করার সুযোগ নেই। ইনস্টিটিউশনালি বা কাঠামোগতভাবে আমি কোনো ব্যত্যয় দেখতে পাচ্ছি না।”