পশুপাখি, নদী-জলাশয় ও বন সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন পাখিচিত্রীরা

পাখিচিত্রীরা বন, নদী ও পশুপাখি রক্ষায় নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পাখিচিত্রীরা পশুপাখি ও প্রকৃতির প্রতি সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। তারা একেকজন যেন হাঁটাচলা করা তথ্যভান্ডার। দেশের কোথায়, কোন বছর, কোন পাখি এসেছে বা কত বছর পর আবার ফিরে এসেছে—এসব তথ্য তাঁদের হাতের মুঠোয়। কোন পাখি কোন মৌসুমে বাচ্চা দেয়, কী খায়, বা তাদের বৈশিষ্ট্য কী—এসব বিষয়ে তাঁরা সুপটু। এমনকি প্রবল ঝড়ের সময় কোন সামুদ্রিক পাখি নদীতে এসে পড়ে তাও জানেন তারা।
যাঁরা গণমাধ্যমে পাখি নিয়ে লেখালেখি করেন, তাঁদের অনেকেই ছবি তোলার সঙ্গেও যুক্ত। পাখিচিত্রীরা কেবল পাখি নিয়েই নয়, বন্য প্রাণী নিয়েও আগ্রহী। দেশের নানা বনে কোন প্রাণী বাস করে, সেটাও তাঁদের জানা। সেই অর্থে তাঁরা প্রকৃত অর্থেই বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী। পাশাপাশি তাঁরা জনসচেতনতা তৈরিতেও কাজ করছেন।
তবে কখনও কখনও ভালো ছবি তোলার উদ্দেশ্যে পাখিকে বিরক্ত করার প্রবণতাও দেখা যায়, যদিও সংখ্যায় তা কম। তবুও এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
পাখিচিত্রীদের উপস্থিতির কারণেই দেশে পাখি শিকার অনেক কমেছে। এমন উদাহরণও আছে—যিনি একসময় শিকার করতেন, তিনি এখন পাখির ছবি তুলে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। বর্তমানে দেশে ৭৩২ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে, যার অধিকাংশ তথ্য এসেছে এসব পাখিচিত্রীদের কাছ থেকে।
রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীরে শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। অতীতে এই এলাকায় শিকার ছিল ব্যাপক। কিন্তু যখন থেকে পাখিচিত্রীরা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন, শিকার অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি নৌকার মাঝিরাও এখন এই কাজে সহায়তা করেন।
আমরা তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর তীরে ছবি তুলতে গেলে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বড় লেন্সের ক্যামেরা দেখে উৎসুক হয় তাঁরা। বন্দুকধারী শিকারির পরিবর্তে ক্যামেরা হাতে মানুষ দেখে অনেকেই অবাক হন। স্থানীয়রা শিকারির তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। এমনও হয়েছে, স্থানীয় কারও ফোন পেয়ে আমরা থানায় খবর দিয়েছি এবং পুলিশ গিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে।
একবার রাজারহাটে একটি দুর্লভ প্রজাতির পাখির আবাসস্থলে একটি ঘটনা ঘটেছিল—এক প্রভাবশালী ব্যক্তি শিকার করে পাখি নিয়ে গিয়েছিলেন। থানায় জানালে পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়ে অস্ত্র জব্দ করে। এরপর তিনি মামলার হাত থেকে বাঁচতে বন্দুক জমা দেন।
এমন ঘটনা আরও আছে। সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্রে নদে এক কুখ্যাত শিকারিকে বন্দুকসহ হাতে-নাতে ধরা হয় এবং তাঁর সাক্ষাৎকার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে সরকারি দপ্তর ও সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ জানানো হয় এবং মামলাও হয়।
পাখির ছবি তুলতে গিয়ে তাদের জীবনচক্র, আচরণ ও আবাসস্থলের প্রতি গভীর সংযোগ তৈরি হয়েছে। ঢাকার উপকণ্ঠে যেসব জলাশয় ধ্বংস হচ্ছে, সেগুলো রক্ষা করতে পাখিচিত্রীরা সরব। নদীর সুরক্ষাও তাঁরা চান।
চট্টগ্রামের হাজারিখিলে নাহিদুল ইসলাম নামের এক তরুণ একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছেন। পাখিচিত্রীদের থাকার সুবিধার্থে তিনি দুই রুমের একটি বাসা তৈরি করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, বন রক্ষার ক্ষেত্রে পাখিচিত্রীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি উদ্বিগ্ন যে বন কর্মকর্তারা অনেক সময় বনকে বাগানে রূপ দিতে চান, যা বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। সে কারণে তিনি চান, পাখিচিত্রীরা যেন সেখানে এসে প্রকৃতির সুরক্ষায় ভূমিকা রাখেন।
একসময় দেশের নানা প্রান্তে খোলামেলায় পাখির মাংস বিক্রি হতো, এখন তা অনেকটাই কমেছে। এসব বন্ধে পাখিচিত্রীরা ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা কেবল পাখি নয়, বন, নদী ও জলাশয়েরও প্রহরী।
পাখি ও বন্য প্রাণী নিয়ে গবেষকরা যেমন প্রকৃতি সুরক্ষায় কাজ করছেন, তেমনি পাখিচিত্রীরাও নিবেদিত। তবে রাষ্ট্র এখনো তাঁদের মতামত বা অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় না। বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কিছু যোগাযোগ থাকলেও তা সীমিত।
পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে পাখিচিত্রীদের মতামত অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। সরকারি খরচ ছাড়াই তাঁরা প্রকৃতির পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। আইইউসিএন যদিও কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের সম্পৃক্ত করেছে, তবুও আরও সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
আমরা চাই—সরকার, পাখিচিত্রী, গবেষক ও সাধারণ নাগরিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশের পশুপাখি, বন, নদী ও জলাশয় রক্ষা পাক।