শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বাংলা সংস্কৃতির তীর্থভূমি
কুষ্টিয়া, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অনন্য স্বাক্ষর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি।
পদ্মার তীরঘেঁষা এই ঐতিহ্যবাহী ভবনে কবিগুরু জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। যা তাঁকে শুধু সাহিত্যচর্চায় নয়, মানবজীবন ও প্রকৃতিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছে। এখানেই রচিত হয়েছে তাঁর গীতাঞ্জলির বহু পঙ্ক্তি, ‘চিঠিপত্র,’, অসংখ্য কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও গল্প। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি তাই শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঠাকুর পরিবার ১৮০৭ সালে শিলাইদহের জমিদারি কেনার পর থেকেই এই অঞ্চলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগের সূত্রপাত হয়। ১৮৯০ সালে জমিদারি তদারকি করতে এসে তিনি প্রথম শিলাইদহে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। এরপর প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে আসতেন। কুঠিবাড়িতে অবস্থানকালে কবিগুরু পদ্মা নদীতে নৌকায় ঘুরে ঘুরে গ্রামীণ জনজীবন, প্রকৃতি ও কৃষকের বাস্তবতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। যা তাঁর সৃষ্টিতে অপরূপ মহিমায় প্রতিফলিত হয়েছে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি প্রায় তিনতলা বিশিষ্ট নকশা করা একটি ভবন। যার প্রতিটি ইট কাঠে এখনও বহন করে চলেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর অমূল্য সৃষ্টির স্মৃতি চিহ্ন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকা জাদুঘরটিতে কবিগুরুর ব্যবহৃত কাঠের আসবাবপত্র, ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী, পুরোনো ফটোগ্রাফ, চিত্রকর্ম, জমিদারির নথি ও নৌকার প্রতিরূপ রয়েছে। যা দর্শনার্থীরা কুঠিবাড়ির বিভিন্ন ঘর ঘুরে দেখতে পারেন। সেখানে আজও সংরক্ষিত আছে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের অমূল্য উপাদান।
প্রতিদিনই শত শত দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন কবিগুরুর স্মৃতি স্পর্শ করতে। বিশেষ করে ছুটির দিন, পহেলা বৈশাখ এবং রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে দর্শনার্থীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে কুঠিবাড়ি চত্বরে।
সংস্কৃতি কর্মীদের মতে, শিলাইদহ বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক তীর্থভূমি। এখানে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সুবিধা তৈরি হলে প্রতি বছর লাখো পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু অবহেলা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কুঠিবাড়ির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
রবীন্দ্রপ্রেমী হারুন অর রশীদ বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীর সময় আবহাওয়া খারাপ থাকে। এ কারণে দর্শনার্থীরা এখানকার অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন না। তাই তারা এখানে স্থায়ী অডিটোরিয়াম-এর দাবি করেন।
কুঠিবাড়ি পরিদর্শনে আসা রবিন হোসেন বাসসকে বলেন, এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
আরেক দর্শনার্থী মোহনা দাশ বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে শিক্ষা সফরের জন্যে এসেছি। এতে আমার একাডেমিক কাজে অনেক অগ্রগতি হবে।’
দর্শনার্থী সুলতানা বলেন, পাঠ্য বইয়ের সাথে আমরা সব সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কে জেনেছি। এখানে সরাসরি এসে তার সম্পর্কে আরো ভালো করে জানতে ও বুঝতে পারলাম।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রানু বিশ্বাস বলেন, আমরা রবীন্দ্র সংগীত ভালোবাসি। এই ভালোবাসাকে ধারণ করে আগত দর্শনার্থীদের রবীন্দ্র সংগীত শোনাই। তবে এখানে সবকিছু খাকলেও গানের কোনো ভালো মঞ্চ নাই। এখানে শিল্পীদের মূল্যায়ন করা হয় না।
ধামরাই সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আসমা বলেন, এখানে সবকিছু খাকলেও গান গাওয়ার জন্য ভালো কোনো মঞ্চ নেই। নিয়মিত কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় না।
শিলাইদহের এই কুঠিবাড়িতে থাকা পুরোটা সময়ই রবি ঠাকুর মগ্ন ছিলেন সাহিত্য রচনায়। এখানে বসেই লিখেছিলেন অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্য। সেই কুঠিবাড়ির জরাজির্ন্যতা, কবিকে নিয়ে গবেষণাসহ পর্যটকদের থাকা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষোভ রয়েছে গবেষকদেরও। বাংলা সাহিত্যের মহাপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের এই কুঠিবাড়িকে দ্রুত সংস্কার, কবিকে নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার দাবি রবীন্দ্রপ্রেমী ও গবেষকদের।
কুঠিবাড়ির কাষ্টোডিয়ান মো: আল-আমীন বাসকে বলেন, এখানে আগত দর্শনার্থী ও গবেষকদের জন্য স্বল্প পরিসরে রেস্ট হাউজ, গবেষণাগারসহ সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে।
আরো বড় পরিসরে এসব সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে। প্রতিবছর কবিগুরুর জন্মদিন (২৫ বৈশাখ) ও প্রয়াণ দিবস (২২ শ্রাবণ) উপলক্ষে কুঠিবাড়ি চত্বরে তিন দিনব্যাপী নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। গান, আবৃত্তি, আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীতে অংশ নিতে দেশ-বিদেশের রবীন্দ্রপ্রেমীরা ছুটে আসেন শিলাইদহে।