শিশু অধিকার ও আমাদের প্রত্যাশা
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। বিশ্বে শতকরা ২৬ ভাগ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশই শিশু। এদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এক জরিপে দেখা গেছে, দরিদ্র শিশুদের ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়োঃনিস্কাশন সুবিধা, ৫৯ শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১ শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫ শতাংশ শিশু বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
‘বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোকে দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দারিদ্র্য, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যু, পিতৃবিয়োগ, বাবা-মা দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষিত হয় । বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। বর্তমান আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলেই শিশু।
শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা আছে। এই উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের পরিচর্যা ও সরকার শিশুদের সেবা এবং সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন: শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ সবধরনের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
শিশু অধিকার সংরক্ষণ ও শিশু কল্যাণে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ, পুষ্টি, শিক্ষা ও বিনোদনের কোন বিকল্প নেই। তাই শিশু-কিশোর কল্যাণে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার সংরক্ষণ, শিশুর জীবন ও জীবিকা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসুচি পরিচালনাসহ শিশু নির্যাতন বন্ধ, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের বৈষম্য বিলোপ সাধনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শিশু স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা এবং শিশু কল্যাণের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে ‘জাতীয় শিশু নীতি’। এছাড়া নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘পারিবারিক সহিংসতা আইন’।
শিশুশ্রম নিরসনকল্পে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ঝুকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের বিরত রাখার জন্য শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে আগামী তিন বছরে ৪০ হাজার শিশুকে ঝুকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে এনে তাদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করা হবে। যাতে তারা পিতামাতাকে তাদের কাজে সহায়তা করতে পারে।
পারিবারিক অসচ্ছলতা কাটাতে শ্রমজীবী শিশুদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে হোসিয়ারি শিল্প কারখানার মতো ধূলিময় পরিবেশে কাজ করলে তাদের শ্বাসকষ্ট ও ব্রংকাইটিস রোগ হতে পারে। এ ছাড়া ওয়ার্কশপের মতো কারখানায় মেটাল ডাস্টের মধ্যে যদি শিশুরা কাজ করে তবে ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১ থেকে ১৪ এবং ১৯৭৫ সালের শিশু আইনে বলা হয়েছে, শুন্য থেকে ১৬ বছরের শিশুদের ভারী কাজ করানো যাবে না। কিন্তু কোথাও এ আইন মানা হচ্ছে না।
আইনে যেহেতু বলা আছে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু। তাহলে ১৮ বছরের আগের সকল শিশুর ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। তবেই হয়তো একদিন আমাদের সমাজ থেকে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হবে।