শিশুর সুস্থতায় শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম
ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য তাদের পুষ্টিমান উন্নয়ন অপরিহার্য। সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা গেলে শিশুদের বয়স অনুযায়ী-উচ্চতা ও ওজন ঠিক থাকবে।
তাদের শেখার সক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এ কারণে বলা হয়, শিশু পুষ্টির উন্নয়ন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের অন্যতম ভিত্তি।
শিশুর জীবনের প্রথম ২৪ মাসে পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু প্রথমত মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পুষ্টি পায়। শিশুর বয়স ছয়মাস হলে মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি পরিপূরক খাদ্য দিতে হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অপুষ্টির কারণে অনেক শিশু খর্বকায় ও কৃশকায় হচ্ছে। এ ধরণের শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অপেক্ষকৃত কম থাকে। ফলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবার আগে মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃদুগ্ধ পানে জোর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবদেহের সবকয়টি উপাদান সচল রাখার জন্য পুষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। দুধ হলো তাদের মধ্যে অন্যতম একটি খাবার, যার কোন বিকল্প নেই। দেহ গঠনের প্রয়োজনীয় সকল প্রোটিন দুধে পাওয়া যায়। শিশু, বাড়ন্ত বয়সী, অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়ের জন্য প্রতিদিন দুধ অপরিহার্য। শিশু ও বাড়ন্ত বয়সে হাড়, দাঁতের গঠন ও মজবুতের জন্য এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ করার জন্য দুধ খুবই প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের দুই বছর বয়সের পর থেকে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন। আঁশযুক্ত খাবার মূলত অশোষিত শর্করা জাতীয় খাবার। এর বেশির ভাগ আসে উদ্ভিদ জাতীয় খাবার থেকে। যেমন-দানাদার শস্য, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি। এই সকল খাবার পরিপাকতন্ত্রে অপাচ্য হিসেবে থাকে। মল হিসেবে নির্গত হওয়ার আগে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে বৃহদন্ত্রে পৌঁছায়। যদিও আঁশযুক্ত খাবার দেহে তেমন পরিমাণে ক্যালরি বিতরণ করে না, তবুও শিশুদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এর ভূমিকা বহুমুখী ও গুরুত্বপুর্ণ।
আঁশযুক্ত খাবার শরীরের জন্য দরকার কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে-
১) বৃহদন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া এসব আঁশযুক্ত খাবারের সংগে বিক্রিয়া করে তৈরি করে প্রোবায়োটিকস, যা অন্ত্রে থাকা উপকারী জীবাণুগুলোকে পুষ্টি জোগায়।
(২) পরিপাকতন্ত্রে থাকা বিষাক্ত পদার্থ বা টক্সিন এবং ক্যান্সার তৈরির উপাদান বিনষ্ট করে।
(৩) মলের আয়তন ধরে রাখে। ফলে শিশুর কোষ্ঠবদ্ধতার নিরসন হয়।
(৪) আঁশ পাকস্থলী থেকে খাবার অন্ত্রে যাওয়ার সময় বৃদ্ধি করে পরিপাকতন্ত্রের চলনকে ধীর করে এবং এটা শিশুর খিদে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
(৫) ফলমূল-শাকসবজি খাওয়া হলে শর্করাজাতীয় পানীয় পানের ফলে দেহে হঠাৎ করে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকি কম থাকে।
(৬) শিশুর দৈনন্দিন খাবারে আঁশযুক্ত ফলমূল, শাকসবজি বা দানাদার খাবার শিশু বয়সে ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, রক্তে উচ্চ কোলেষ্টেরল নিয়ন্ত্রণ, কোলন ক্যান্সার ও আইবিডির মতো অন্ত্রেও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উপকারী।
শিশু কতটুকু আঁশ খাবে-
শিশুর খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন ন্যূনতম আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ নির্ণয়ে নিম্নোক্ত ফর্মুলা ব্যবহার হয়। শিশুর বয়স (বছর) + ৫ = আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ (গ্রাম হিসাবে)। যেমন-০১ বছর বয়সের একটি শিশুর জন্য আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ হবে- ১ + ৫ = ৬ গ্রাম/প্রতিদিন।
পুষ্টিকর খাবার শুধু খাদ্যই নয়, ওষুধ হিসেবেও কাজ করে।
খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। নানা প্রকার রাসায়নিক ও ভেজালের কারণে খাদ্য দূষিত হচ্ছে। দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে এখন রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।
দেশের মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিয়ে জ্ঞানের অভাবই মূলত দায়ী, অর্থনৈতিক কারণ নয়। অনেকেরই ধারনা বেশি বেশি দুধ ও মাংস খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিন্তু প্রতিটি মানুষেরই সুষম খাবার অর্থাৎ খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি খাবারে থাকতে হবে, এমন খাবার খাওয়া উচিত। সে জন্য মাংস ও দুধের পাশাপাশি মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, ফলমূল সবই খেতে হবে।
সার্বিকভাবে দেশে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের অপুষ্টি দূর করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, উপযুক্ত সম্পুরক খাবার খাওয়ানো, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো-এই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তাহলে শিশুদের অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিশোর বয়সে অপুষ্টির শিকার কম হবে। ভাতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল, শাকশবজি, দেশীয় ফলের আবাদ বাড়াতে হবে। দেশের পুষ্টিমান উন্নয়নের জন্য সরকারের সাথে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাত সমন্বিতভাবে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।