শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৬ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

শবে মেরাজ: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

মাওলানা সাইদ আহমাদ হাফি. (হাটহাজারী)

 প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

শবে মেরাজ: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

সাধারণ জনগণের মাঝে রজব মাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, ২৭ তারিখ শবে মেরাজ এবং কোন কোন পুস্তক-পুস্তিকায়ও তা স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে। 

নিশ্চয় মেরাজ একটি মহান অলৌকিক ঘটনা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম মহান মু’জিযা। এতে কোন সন্দেহ নেই; এর উপর বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। 

অর্থাৎ প্রথ‌মে মক্কা থে‌কে বাইতুল মুকাদ্দাস গি‌য়ে‌ছেন, যা‌কে কুরআ‌নে 'ইসরা' ব‌লেছে। এ পর্যন্ত বিশ্বাস করা ফরয; অস্বীকার কুফর। তারপর সেখান থে‌কে ‌তি‌নি সশরী‌রে আসমা‌নে উর্ধ্বজগ‌তে প‌রিভ্রমণ করে‌ছি‌লেন, এর নাম 'মিরাজ'। এটিও বিশ্বাস করা জরু‌রি। ত‌বে এ অং‌শে স‌ন্দেহ করলে বিদআত পন্থীদের মধ্যে গণ্য, পথভ্রষ্ট ও গুনাহগার এবং বাহাত্তর দলের মধ্যে গণ্য হয়ে জাহান্নামী।

তবে মেরাজ কোন মাসে কত তারিখে হয়েছিল-এ সম্পর্কে কোন বিশুদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায় না, বরং এ প্রসঙ্গে অনেক মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। 

তন্মধ্যে প্রথম মতভেদ হচ্ছে, মেরাজ নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল না পরে? 

দিত্বীয়ত: নবুওয়াতের পরে হিজরতের কত বছর বা কয় মাস পূর্বে? হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. ‘ফাতহুল বারী’তে ৭/২৬০ বলেন, এতেই রয়েছে দশটির অধিক মত। 

তৃতীয়ত: কোন মাসে? রবিউল আউয়াল, রবি. আখের, রজব, রমযান, শাওয়াল, জিলকাদ ও জিলহজ সহ সাতটি মত রয়েছে। (দ্র. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১০৯, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, ১/২৭৩-৭৫ ও শরহুয যুরকানী আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, ২/৬৭-৭১) 

চতুর্থত: কত তারিখে? ১৭/২৭ই রবি. আখের, ১৭ই রমযান ও ২৭ই রজব এর অভিমত পাওয়া যায়। শেষ মতটি হাফেজ আব্দুল গণী মাকদেসী রাহ. (মৃ. ৬০০ হি.) গ্রহণ করেছেন। (আল-আয়াতুল কুবরা, সুয়ূতী পৃ. ২৩ ও আল-মাওয়াহিব, ১/২৭৪-৭৫) এছাড়া কোন দিনের দিবাগত রাত? এতেও মতানৈক্য হয়েছে। 

পর্যালোচনা: 

হাফেজ ইবনে কাসীর রাহ. (মৃ. ৭৭৪ হি.) বলেন, মাকদেসী রাহ. যে বর্ণনার ভিত্তিতে মেরাজ ২৭ই রজব হওয়ার মত গ্রহণ করেছেন, এর সূত্রটি বিশুদ্ধ নয়। (আল-বিদায়া, ৩/১০৯) ইবনে রজব রাহ.ও বলেন, ২৭ই রজব মেরাজ সংঘটিত হওয়ার সূত্রটি সহীহ নয়। ইব্রাহিম হারবীসহ অন্যরা এটি অস্বীকার করেছেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ পৃ. ২৩৩) 

মুহাদ্দিস ইবনে দিহয়া কালবী (মৃ. ৬৩৩ হি.) বলেন, রজব মাসে মেরাজ সংঘটিত হওয়ার মতটি ডাহা মিথ্যা। (আদায়ু মা ওজাব, পৃ. ৫৩) শায়খ ইবনুল আত্তার রাহ. ‘হুকমু সওমি রজব’ এ লিখেন, রজব মাস কুরআনে বর্ণিত সম্মানিত মাসের একটি। আর এ মাসে মেরাজের বিষয়টি প্রমাণিত নয়। 

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রাহ. (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন, 

لم يقم دليل معلوم لا على شهرها، ولا على عشرها، ولا على عينها، بل النقول في ذلك منقطعة مختلفة، ليس فيها ما يقطع به.

মেরাজ কোন মাসে, কোন দশকে ও কত তারিখে হয়েছে- এ বিষয়ে কোন প্রমাণিত দলীল নেই। এ সর্ম্পকে যে সমস্ত বর্ণনা রয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন ও মতভেদপূর্ণ, এতে নিশ্চিত হওয়ার মত কিছু নেই। (যাদুল মা’আদ, ইবনুল কায়্যিম ১/৫৮) 

এরপরেও যদি মেনে নেয়া হয় যে, ২৭ই রজব বা অন্য কোন সুনির্দিষ্ট তারিখে মেরাজ সংঘটিত হয়েছে। তখনও উক্ত তারিখ উদযাপন বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান কিংবা কোন আমল করার দলীল-প্রমাণ নেই। কেননা সাহাবা-তাবেঈন থেকে মেরাজ উপলক্ষে কোনো কিছু পালন বা আমল করার কোন দলীল পাওয়া যায় না। এতে করণীয় কিছু থাকলে অবশ্যই তাঁরা করতেন।

এভাবে মেরাজ উপলক্ষে মসজিদে সমবেত হওয়া, অধিক বাতি জালানো, ওয়াজের আয়োজন করা, ‘মেরাজের নামায’ হিসেবে নামায পড়া ও পরের দিন রোযা রাখা- এ সবই শরীয়ত বহির্ভূত ও বিদআতের অন্তর্ভূক্ত।

শায়খ আবু উমামা ইবনে নাক্কাশ রাহ. (মৃ. ৭৬৩ হি.) বলেন, 

وأما ليلة الإسراء فلم يأت فى أرجحية العمل فيها حديث صحيح ولا ضعيف. ولذلك لم يعينها النبى صلى الله عليه وسلم لأصحابه، ولا عينها أحد من الصحابة بإسناد صحيح، ولا صح إلى الآن ولا إلى أن تقوم الساعة فيها شىء، ومن قال فيها شيئا فإنما قاله من كيسه لمرجح ظهر له استأنس به، ولهذا تصادمت الأقوال فيها وتباينت، ولم يثبت الأمر فيها على شىء، ولو تعلق بها نفع للأمة - ولو بذرة - لبينه لهم نبيهم صلى الله عليه وسلم.

‘শবে মেরাজের আমল উত্তম হওয়া সম্পর্কে কোন সহীহ বা দুর্বল হাদীসও বর্ণিত হয়নি। এ কারণেই রাসূল সাহাবায়ে কেরামকে উক্ত রাত নির্ধারিত করে দেননি এবং কোন সাহাবীও তা নির্দিষ্ট করেন নি। এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে বিশুদ্ধ সূত্রে কিছুই বর্ণিত হয় নি এবং কেয়ামত পর্যন্তও হবে না। 

আর যে এ সম্পর্কে কিছু বলেছে, সে নিজ থেকেই বলেছে, যা তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। এ কারণেই এত মতভেদ হয়েছে, যার কোন সুরাহা নেই। অতঃপর বলেন, শবে মেরাজে যদি উম্মতের জন্য সমান্যও করণীয় থাকত, অবশ্যই রাসূল তা সাহাবায়ে কেরামকে বলতেন।’ (আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, কাসতাল্লানী, ৩/১৪) 

ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী রাহ. (মৃ. ৭৫৬ হি.) বলেছেন, ২৭ই রজব মেরাজ উপলক্ষে অনুষ্ঠান করা বিদআত। (আস-সায়ফুল মাসলূল পৃ. ৪৯২) 

ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, মেরাজ মনে করে কোন রাত নির্ধারণ করে ইবাদত বা অন্য কিছু করা মুসলমানদের জন্য জায়েয নেই। (যাদুল মা’আদ, ১/৫৮)

মুহাদ্দিস আজলূনী রাহ. (মৃ. ১১৬২ হি.) লিখেন,

وكذا صلاة عاشوراء وصلاة الرغائب موضوع بالاتفاق، وكذا صلاة ليالي رجب وليلة السابع والعشرين من رجب.

আশুরার নামায, সালাতুর রাগায়িব ও রজবের রাতসমূহে এবং রজবের ২৭ তারিখের রাতের নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো সর্বসম্মতিক্রমে জাল ও বানোয়াট। (কাশফুল খাফা ২/৪১০)

অনুরূপ ‘যে ব্যক্তি রজবের ২৭ তারিখে রোযা রাখবে, আল্লাহ তার আমল নামায় ৬০ মাস রোযা রখার সাওয়াব লিখে দিবেন।’ বর্ণনাটিও অগ্রহণযোগ্য। (দেখুন, আদ-দ্বীনুল খালিস, মাহমুদ সুবকী মালেকী ৮/৪৩০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৫/২১৪)

ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. লিখেন,

وأما الصيام: فلم يصح في فضل صوم رجب بخصوصه شيء عن النبي صلى الله عليه وسلم ولا عن أصحابه.

‘রজব মাসের সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখে রোযার ফযীলত সম্বলিত বিশুদ্ধ কোন হাদীস রাসূল ও সাহাবা থেকে বর্ণিত হয় নি।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ পৃ. ২২৮)

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (মৃত্যু ৮৫২ হি.) ‘তাবয়ীনুল আজব’ রিসালায় লিখেন, 

لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه، ولا في صيام شيء منه معين، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه حديث صحيح يصلح للحجة.

‘রজব মাসের ফযীলত ও রোযা অথবা এ মাসের সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখে রোযা কিংবা বিশেষ কোনো রাত্রি উদযাপন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি।’ (তাবয়ীনুল আজব বিমা ওরাদা ফী ফাযলি রজব, পৃ. ১১) 

সুতরাং নির্ভরযোগ্য হাদীসে রজব মাস অথবা এর কোনো দিন বা রাতের কোনো ফযীলত নেই। কাজেই ‘বার মাসের ফযীলত’ বা এ জাতীয় বই-পুস্তকে এ মাস সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। 

তবে কেউ কেউ صُمْ مِنَ الْحُرُمِ وَاتْرُكْ (আবু দাউদ ২৪২৮; ইবনে মাজা ১৭৪১) হাদীসটি থেকে উদ্ভাবন করে বলেছেন, এ মাসে অনির্দিষ্টভাবে কিছু দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। (দ্র. ফাযায়েলে আওকাত, বায়হাকী পৃ. ৮৯ ও তাবয়ীনুল আজব, পৃ. ১২-১৪) 

এছাড়া কিছু সাহাবা ও সালাফের মতে এ মাসে ওমরা পালন করা মুস্তাহাব। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩২)

আর কুরআনে কারীমে যে চারটি মাসকে আল্লাহ পাক বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন, তন্মধ্যে রজব মাস অন্যতম। (সূরা তাওবা ৩৬) আয়াতটির ব্যাখ্যায় অনেক মুফাসসির বলেছেন, জুলুম ও গুনাহের কাজ সবসময় অপরাধ হলেও উক্ত চার মাস তথা রজব, জিলকাদ, জিলহজ ও মুহাররম এ তা আরো মস্তবড়। তদ্রূপ এ চার মাসে নেক-আমলের প্রতিদানও অনেক বেশি। (দেখুন আয়াতটির ব্যাখ্যায়, তাফসীরে কাবীর, কুরতুবী, ইবনে কাসীর, রুহুল মা’আনী এবং মোল্লা আলী কারী রাহ. রচিত আল-আদব ফী রজব, পৃ. ২৫) 

সারকথা, রজব মাস কুরআনে বর্ণিত চার সম্মানিত মাসের একটি, সুতরাং এর পুরোটাই বরকতময়। তাই এ মাসের সবকটি দিন ও রাতেই ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া চাই এবং বর্ণিত দু’আটি পড়া যায়। আর কোন নির্দিষ্ট রাতে বা দিনে বিশেষ আমল বা নামায-রোযা এবং রসম-রেওয়াজ পরিত্যাগ করা অপরিহার্য।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রসম-রেওয়াজ ও বিদ'আতকে ইবাদত মনে করে আমল করা থেকে হেফাজত করুন।

মুসলিম বাংলা

মন্তব্য করুন: