তারেক রহমান সংস্কারক ও দূরদর্শী নেতা
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শুধু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনই ঘটেনি, এ দেশের রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে সুবর্ণ সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবল গণআন্দোলন দেশবাসীর মানসিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যা শেখ হাসিনার ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে ভেঙে পড়েছিল।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সংস্কারের দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ। আজকের সংস্কারমুখী পরিবেশ সৃষ্টিতে তার ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
২০১৪ সালে তারেক রহমানই প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ৫৫ শতাংশ থেকে মাত্র ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার চিন্তা করেন। পরে শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন। ২০১৪ সালের ১৫ জুলাই লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি কোটা ব্যবস্থা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত, যাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে সুযোগ পায়।’
শেখ হাসিনার পতনের পর সংস্কারের যে দাবি ওঠেছে, সেটির রূপরেখা বিএনপি আগেই উপস্থাপন করেছিল। এটি মূলত তারেক রহমানের চিন্তার ফসল।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। লাখ লাখ মামলা, হামলা, নির্যাতন, গুম এবং হত্যাকাণ্ডও বিএনপি নেতৃত্বকে তাদের সংস্কারের দাবি থেকে সরাতে পারেনি। বরং বারবার তারা জনগণের সামনে সংস্কারের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ- গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের জন্য দলটি ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করে, ২০২২ সালে ২৭ দফা কর্মসূচি এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৩১ দফা রূপরেখা প্রণয়ন করে। বর্তমানে সংস্কারের যে বড় দাবিগুলো আলোচিত হচ্ছে, তার প্রায় সবই বিএনপির ৩১ দফায় রয়েছে।
তারেক রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের উদ্দেশ্যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন। এতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার (বিশেষ করে কৃষক, তথ্যপ্রযুক্তি এবং পুঁজিবাজারের জন্য), পরিবেশগত টেকসই উন্নয়ন (সবুজ বনভূমি ও নদী পুনরুদ্ধার), বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য নারী নেতৃত্বাধীন খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো নীতিমালা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে জবাবদিহিতা ও নাগরিক অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তারেক রহমান প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার কথা বলেননি, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দিয়েছেন। তার প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে- গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য স্থাপন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা।
তিনি জোর দিয়েছেন একই ব্যক্তি যেন টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, যাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ করা যায়।
৩১ দফা রূপরেখায় বিভিন্ন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’, ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’, ‘জুডিশিয়াল কমিশন’, ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’, ‘মিডিয়া কমিশন’ এবং ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে।
রূপরেখায় বিদ্যমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০১১, আরপিও, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংশোধনের পরিকল্পনা রয়েছে এবং একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি দলটি একটি উচ্চকক্ষ আইনসভা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে, যা দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
দলটি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও দায়িত্বের যথাযথ সমন্বয় নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিএনপি সব কালো আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- আইসিটি আইন-২০০৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং অন্যান্য সব আইন যা মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নেয়।
দলটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে সবার জন্য ‘স্বাস্থ্য কাডর্’ চালু করা, শিক্ষা খাতে বিশৃঙ্খলা দূর করা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করেছে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া এবং কৃষকদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান, কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন খাত উন্নয়ন এবং রপ্তানিমুখী কৃষি-প্রক্রিয়াজাত শিল্পে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনাও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তারেক রহমান সম্প্রতি আট দফার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে এবং বিএনপির কর্মসূচিকে অন্যান্য সরকারের কর্মসূচি থেকে আলাদা করে।
‘জাতি পুনর্গঠনের পরিকল্পনা’ শিরোনামে সপ্তাহব্যাপী আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। এসব অনুষ্ঠান ঢাকার ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সামনে এসব পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এই পরিকল্পনায় কৃষি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া এবং সামাজিক সুরক্ষা জালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তারেক রহমান তার উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষক ও কৃষিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তিনি অনুধাবন করেছেন, কৃষক ও কৃষিকে অবহেলা করে বাংলাদেশকে উন্নত করা সম্ভব নয়। কৃষি খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি ‘কৃষক কার্ড’ চালুর কথা বলেছেন, যাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয়, সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় এবং সহজ ঋণ সুবিধা দেওয়া যায়।
তিনি সারাদেশে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন, চাহিদাভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সনদ প্রদানের মাধ্যমে তরুণদের দেশ ও বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য প্রস্তুত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একটি সুস্থ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। তিনি সারাদেশে প্রায় এক লাখ নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন (যাদের ৮০ শতাংশ হবে নারী), মহানগর ও জেলা পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী মোতায়েন করে রোগ শনাক্তকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ সরবরাহ করা, ক্যান্সার, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের জন্য কম খরচে ওষুধ প্রদান এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বিতরণের পরিকল্পনা করেন।
তারেক রহমান ধর্মীয় নেতাদের কল্যাণ, নদী-খাল ও পরিবেশ সংরক্ষণ, ক্রীড়া উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং ‘ফ্যামিলি কার্ড’ নিয়ে কথা বলেছেন।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো বিএনপির শীর্ষ নেতা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সদিচ্ছা রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রকৃত সংস্কারের দিককে নির্দেশ করে। দলের ৩১ দফা কর্মসূচি এবং আট দফা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রচারের পাশাপাশি তিনি এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যাতে বাংলাদেশে শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও পদক্ষেপগুলো স্পষ্টভাবে তার নেতৃত্বগুণের বিকাশকে প্রদর্শন করেছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের আগে ও পরে তার দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান বাংলাদেশকে স্থিতিশীলতার পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেছে।
তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার যেন করতে না পারে। ’একই সময়ে তিনি বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে- মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং একজন ওমবাডসম্যান নিয়োগ। তার বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
তারেক রহমানের বক্তব্য স্পষ্ট, রাজনীতি কেবল ক্ষমতা লাভের বিষয় নয়, বরং জনগণের কল্যাণে সেবা করার বিষয়। এভাবেই তার পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন এবং তাতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার রাজনীতি তাকে তার পিতার মতোই বিপুল জনপ্রিয়তার পথে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তিনি নতুন রাজনৈতিক সমঝোতায় পথ হারাননি। আগামীতেও তারেক রহমান এবং তার দল বিএনপি পথ হারাবে না- এটাই এখন বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন।