নাছোড় বিএনপির ‘বঞ্চিতরা’, রাজশাহীর ৩ আসন ‘উত্তপ্ত’
রাজশাহীর তিনটি সংসদীয় আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের সমর্থক নেতা-কর্মীরা মাঠ ছাড়ছেন না, তারা লাগাতার বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছেন।
এ অবস্থায় ওই তিন আসনে বিএনপির প্রার্থীরা নিজেদেরই দলের একাংশের নেতা-কর্মীদের ‘অসহযোগিতার’ মধ্যে ভোটের প্রচার চালাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন।
জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে উত্তেজনা বেশি রাজশাহী-১, রাজশাহী-৩ ও রাজশাহী-৫ আসনে। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিকে কেন্দ্র করে মারমুখী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে; সংঘর্ষও হয়েছে কয়েক দফা।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গেল ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে।
তার পর থেকে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে কোথাও মশাল মিছিল, কোথাও মহাসড়ক অবরোধ, কোথাও কাফনের কাপড় শরীরের জড়িয়ে সড়কে শুয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের সমর্থক নেতাকর্মীরা।
এরকম বিক্ষোভের মুখে মাদারীপুর-১ আসনের প্রার্থী মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। ৪ ডিসেম্বর এ আসনে অন্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে রাজশাহীর তিন আসনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ‘সমাধানের’ চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। মাঠের অচলাবস্থা দূর করতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দ্রুত কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
রাজশাহী-১: মাঠে ‘বিভক্ত’ বিএনপি
গোদাগাড়ী-তানোর এলাকা নিয়ে রাজশাহীর এ আসনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক সামরিক সচিব, বর্তমানে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শরিফ উদ্দিনকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি বিএনপির প্রয়াত মন্ত্রী আমিনুল হকের ছোট ভাই। পরিবারের জনপ্রিয়তা ও জনগণের আস্থা কাজে লাগিয়েই শরিফ উদ্দিন নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদেরও একটি বড় অংশ তাকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দেখছে।
তবে মনোনয়ন না পাওয়া সুলতানুল ইসলাম তারেকের সমর্থক নেতাকর্মীরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
সবশেষ ২৫ নভেম্বর তানোরে মশাল মিছিলকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। এর আগে ২২ নভেম্বর গোদাগাড়ীতে কাফনের কাপড় পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আট নেতা।
তাদের অন্যতম সুলতানুল ইসলাম তারেকের সমর্থক দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, শরিফ উদ্দিন মাঠের রাজনীতিতে নতুন মুখ। তাকে প্রার্থী করায় জামায়াতের প্রার্থী লাভবান হতে পারেন।
‘জিয়া মঞ্চের’ রাজশাহী জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের দাবি, দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর শরিফ উদ্দিন হঠাৎ রাজনীতিতে এসেছেন।
“তার আশপাশে যারা আছেন, তাদের মানুষ পছন্দ করেন না। এদের অনেকে আওয়ামী লীগের দোসর, দখলবাজ, চাঁদাবাজ ও মাদক সিন্ডিকেটের অংশ।
“তাই ত্যাগী এবং দুর্দিনে দলের পাশে থাকা নেতাকেই আমরা প্রার্থী হিসেবে চাই।”
গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সদস্য, বাংলাদেশ জিয়া ফাউডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলতানুল ইসলাম তারেক বলেন, “নেতাকর্মীরা আন্দোলনে নামলে তাদের থামানো যায় না; কারণ তৃণমূলের দাবি, জনপ্রিয় প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেওয়া। হাই কমান্ডের উচিত সেই দাবির প্রতি সম্মান জানানো।”
এ বিষয়ে জানতে রাজশাহী-১ আসনের প্রার্থী শরীফ উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
তার সমর্থক তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান মিজান বলেন, “যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করে, তারা দলের জন্য নিবেদিত নেতা হতে পারেন না।
“দল শরীফ উদ্দিনকে প্রার্থী করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তার পরিবারের বিএনপি ও তানোর-গোদাগাড়ীবাসীর জন্য অনেক অবদান রয়েছে।”
রাজশাহী-৩: ‘বহিরাগত-স্থানীয়’ ইস্যু
পবা ও মোহনপুর নিয়ে এই সংসদীয় আসনে বিএনপি ‘বহিরাগত’ সমস্যায় পড়েছে। এখানে তাদের প্রার্থী শফিকুল হক মিলন দলের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহসম্পাদক।
তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
মনোনয়ন না পাওয়া রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রায়হানুল আলম রায়হানের সমর্থক নেতা-কর্মীরা মিলনকে ‘বহিরাগত’ দাবি করে তার মনোনয়ন বাতিল চেয়েছে।
এই দাবিতে ২২ নভেম্বর পবা উপজেলার খড়খড়িতে তারা রাস্তার উপর শুয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এরপর ৩০ নভেম্বর কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হলেও খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। তাদের মূল দাবি, স্থানীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন চার নেতা; তাদের তিনজন ‘বহিরাগত’, একজন স্থানীয়।
রায়হানুল আলম রায়হান বলছেন, “এলাকার মানুষ এমন প্রার্থী চান, যাকে বিপদের সময় কাছে পাওয়া যায়। তাই স্থানীয় প্রার্থীই হতে হবে তাদের সংসদ সদস্য। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তার বাড়ি শহরে এবং তিনি শহরের ভোটার।”
অবশ্য প্রার্থী পরিবর্তন না হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কোনো ভাবনা তার নেই, বলেছেন রায়হান।
দলের একাংশের বিরোধিতার বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী শফিকুর মিলন বলেন, “প্রার্থী ঘোষণার পর মনোনয়নপ্রত্যাশী সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নেতাকর্মীরা সবাই আমার সঙ্গে ধানের শীষের প্রচার চালাচ্ছেন।
“যে দু-একজন অভিমান করে আছেন, তফসিল ঘোষণা হলে তারাও ধানের শীষের পক্ষে নেমে পড়বেন।”
রাজশাহী-৫: ‘বঞ্চিতরা’ এক মঞ্চে
প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে উত্তেজনা চলছে। বিএনপির রাজশাহী জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী ১২ জনের বেশিরভাগই তার বিরোধিতায় মাঠে নেমেছেন।
বিশেষ করে আবু বকর সিদ্দিক, গোলাম মোস্তফা, রোকনুজ্জামান আলম, ইসফা খাইরুল হক ও জুলকার নাইম মোস্তফার সমর্থক নেতাকর্মীরা যৌথভাবে প্রায় প্রতিদিনই মহাসড়ক অবরোধ, মশাল মিছিল ও সমাবেশ করছেন।
২৫ নভেম্বর দুর্গাপুরে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আওয়াজ তোলেন। ২১ নভেম্বর পুঠিয়ায় তারা মশাল হাতে বড় জমায়েত করে মহাসড়ক অবরোধ করেন।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন নির্যাতন-জেল-হুলিয়া সহ্য করে দলের পাশে থাকা নেতাদের বাদ দিয়ে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ একজনকে মনোনীত করা হয়েছে। এতে তৃণমূলে ‘ক্ষোভ বাড়ছে’ এবং নির্বাচনি মাঠেও মনোনীত প্রার্থী বাধার মুখে পড়ছেন।
তবে এ আসনে মনোনয়ন না পাওয়া আব্দুস সাত্তার ও মাহমুদা হাবিবার সমর্থকরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমেছেন।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “যেহেতু তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রার্থী বদলের দাবিতে আন্দোলন করছে, তাই দলের উচিত নিরপেক্ষ জরিপের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা যাচাই করে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া। দলকে নেতাকর্মীদের মনের ভাষা বুঝতে হবে।”
এ আসনের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বলছেন, নির্বাচনি প্রচার নিয়ে তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন।
প্রার্থী পরিবর্তনের আন্দোলন নিয়ে তার ভাষ্য, “বিষয়টি দলের হাই কমান্ড দেখছে। তফসিল ঘোষণার পর সবাই এক সঙ্গে ভোটের মাঠে নামবে এবং ধানের শীষকে বিজয়ী করে প্রমাণ করে দেবে পুঠিয়া-দুর্গাপুর বিএনপির ঘাঁটি।”
বিরোধ দেখা যাচ্ছে না তিন আসনে
রাজশাহীর তিনটি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর তৃণমূলে কোনো ধরনের বিরোধ বা ক্ষোভ দেখা যায়নি। রাজশাহী-২, রাজশাহী-৪ এবং রাজশাহী-৬ নম্বর আসনে মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেউ আপত্তি তোলেননি; বরং স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে নির্বাচনি প্রচারে নেমে পড়েছেন।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিনু, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডি এম জিয়াউর রহমান জিয়া এবং রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবু সাঈদ চাঁদ ধানের শীষের টিকিট পেয়েছেন।